প্রাক্তন স্বামী। সেই স্বামীর অত্যাচারের আখ্যানও গোটা দেশ জানে। করিশ্মা কপূর নিজেই অভিযোগ করেছিলেন, কী ভাবে সঞ্জয় কপূর তাঁর উপর মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন চালাতেন। গায়ে হাত তোলা থেকে শুরু করে মধুচন্দ্রিমায় বন্ধুর শয্যাসঙ্গিনী হতে জোর করা, এমনকি, বন্ধুদের কাছে স্ত্রীকে নিলামে তুলতেও বাধেনি সঞ্জয়ের! সেই সঞ্জয়ের মৃত্যুতে প্রকাশ্যে ভেঙে পড়তে দেখা গিয়েছে করিশ্মার বোন করিনা কপূর খানকে। করিশ্মার সঙ্গে দেখা করে ফেরার পথে কাঁদতে দেখা গিয়েছে তাঁর দুই বন্ধু মালাইকা অরোরা এবং অমৃতা অরোরাকেও। অতএব, করিশ্মার মানসিক অবস্থা অনুমানযোগ্য। কিন্তু যে স্বামী প্রাক্তন, যাঁর সঙ্গে সুখস্মৃতির থেকে অত্যাচারের ভয়াবহ অভিজ্ঞতাই জড়িয়ে রয়েছে বেশি, তাঁর প্রয়াণে কি স্ত্রী সন্তপ্ত হতে পারেন? মনোবিদ বলছেন, হতে পারেন। এমনকি, এই ধরনের শোক বা সন্তাপের একটি নামও রয়েছে।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যাওয়ার পরেও দেখা গিয়েছে, মন থেকে কেউ কাউকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেননি। ছবি: সংগৃহীত।
অপ্রিয় সম্পর্কেও কেন শোক হয়?
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক শ্রীময়ী তরফদার মনে করেন, অপ্রিয় সম্পর্কে থাকা সত্ত্বেও প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যুতে সন্তপ্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয় একেবারেই। তিনি বলছেন, ‘‘অনেক সময়েই দেখা যায়, দু’টি মানুষ পরস্পরকে ঘৃণা করতেন, অথচ এক জন অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে অন্য জন তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন। সেটাও এক ধরনের ক্লোজ়ার বা সম্পর্কের বৃত্তের সম্পূর্ণ হওয়া। আবার হয়তো দেখা গিয়েছে, মা এবং মেয়ের মধ্যে মুখ দেখাদেখি নেই। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে ভেঙে পড়েছেন মেয়ে। কারণ তখন তাঁর মনে হয়েছে, অনেক কিছু বলার ছিল। সেটা বলা হয়ে ওঠেনি। আবার স্বামী-স্ত্রী বা জীবনসঙ্গীর মধ্যে সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যাওয়ার পরেও দেখা গিয়েছে, মন থেকে কেউ কাউকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেননি।’’ এর ব্যাখ্যাও রয়েছে। শ্রীময়ীর কথায়, ‘‘প্রত্যেকটি সম্পর্ক নিয়েই আমাদের মনের ভিতরে একটা নির্মাণ থাকে— সেই সম্পর্ক কেমন হতে পারত, আর কী কী বলতে পারতাম। সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলেও শেষটা কী ভাবে হলে ভাল হত, এমন নানা ভাবনা আমাদের মনের গভীরে থেকে যায়। একটা আকস্মিক মৃত্যু সেই ভাবনা আর পরিকল্পনায় হঠাৎ একটা দাঁড়ি টেনে দেয়। শোক বা সন্তাপ সেই অসম্পূর্ণতা থেকে আসতেই পারে।’’

সম্পর্কে শুধুই খারাপ মুহূর্তই ছিল আর কোনও ভাল মুহূর্ত তৈরি হয়নি— এমন হতে পারে না। ছবি: সংগৃহীত।
করিশ্মার ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তার পরেও কি শোক স্বাভাবিক?
একটা সম্পর্কে শুধুই খারাপ মুহূর্তই ছিল আর কোনও ভাল মুহূর্ত তৈরি হয়নি— এমন হতে পারে না, বলে মত মনোবিদের। তিনি বলছেন, ‘‘দুটো মানুষ একসঙ্গে অনেক দিন থেকেছেন, তাঁদের সন্তান হয়েছে। মানে, কিছু ভাল মুহূর্ত তৈরি হয়েছে নিশ্চয়ই। আবার এমনও হতে পারে, যখন তাঁরা সন্তানদের মানুষ করেছেন, বিচ্ছিন্ন হয়েও বাবা-মা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন ভাল সময় কাটিয়েছেন। এক জন মানুষের জীবন ঠিক কী ভাবে কেটেছে, তা তো দূর থেকে পুরোপুরি অনুমান করা সম্ভব নয়। এমন তো হতেই পারে যে, স্বামী-স্ত্রী হিসাবে সম্পর্কে থেকে যা পাননি, তা বিচ্ছেদের পরে বাবা-মা হিসাবে পেয়েছেন। কোনও মানসিক যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। সে ক্ষেত্রেও শোকার্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।’’
বস্তুত মনোবিজ্ঞানের দুনিয়ায় এই ধরনের শোক এবং তার জটিলতাকে একেবারেই অস্বাভাবিক মনে করা হয় না। বরং সমাজের চোখে অস্বাভাবিক মনে হওয়া এই ধরনের শোকের মনোবিদ্যায় একটি নাম আছে। তাকে বলা হয় ‘ডিসএনফ্র্যানচাইজ়ড গ্রিফ’।

করিশ্মার ক্ষেত্রেও প্রাক্তন স্বামীর মৃত্যুতে শোকার্ত হওয়া নিয়ে বিস্মিত হয়েছে সমাজ। ছবি: সংগৃহীত।
এই ‘ডিসএনফ্র্যানচাইজ়ড গ্রিফ’ বিষয়টি কী?
‘ডিসএনফ্র্যানচাইজ়ড গ্রিফ’ হল এমন শোক বা সন্তাপ, যাকে সমাজের অধিকাংশ মানুষ ‘স্বীকৃত’ বলে মনে করেন না। ধরুন, আপনি আপনার সহকর্মীর সঙ্গে কোনও গোপন সম্পর্কে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে আপনার যে শোক, তাকে সমাজ স্বীকৃতি দেয় না। আবার কোনও পরিবারের সদস্য বা বিবাহবিচ্ছিন্ন স্বামী অথবা স্ত্রী, যিনি আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন বলে সকলে জানে, তাঁর মৃত্যুতেও আপনার শোককে সমাজ ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে করে না। কিংবা কোনও প্রিয়জন, যিনি সমাজের চোখে ‘অপরাধী’, তাঁর মৃত্যুতে শোকার্ত হওয়াও সমাজের কাছে স্বাভাবিক নয়।
আমেরিকার এক খ্যাতনামী মনোরোগ চিকিৎসক এবং শোকবিষয়ক বহু বেস্টসেলার বইয়ের লেখক কেনেথ জে ডোকা তাঁর বইয়ে প্রথম এই ধরনের শোকের কথা উল্লেখ করে তার একটি নাম দেন। পরবর্তী কালে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কর্মরত বহু গবেষকই এই ধরনের শোক বা সন্তাপকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এমনকি, আমেরিকার ফেডেরাল হেল্থ ইউনিভার্সিটিও ‘ডিসএনফ্র্যানচাইজ়ড গ্রিফ’ নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছে তাদের মনোরোগ বিষয়ক জার্নালে।
করিশ্মার ক্ষেত্রেও প্রাক্তন স্বামীর মৃত্যুতে শোকার্ত হওয়া নিয়ে বিস্মিত হয়েছে সমাজ। তবে মনোবিজ্ঞান বলছে, এই শোকে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। সম্পর্ক, তা যতই তিক্ত হোক, মনে গভীর ছাপ রেখে যায় সব সময়।