কেমোথেরাপির পরে বছরও ঘোরেনি, ফের শরীরে সন্দেহজনক উপসর্গ! পরীক্ষা করাতেইআবার চিহ্নিত ক্যানসার। এ রোগের চিকিৎসায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ কেমোথেরাপি। ওই পদ্ধতির সাহায্যে রোগীর শরীরের ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলি নষ্ট করা হয়। কিন্তু অনেক সময়েই দেখা যায়, কিছু রোগীর দেহেকেমোথেরাপি সে ভাবে কাজ করছে না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক নতুন পথের সন্ধান দিলেন কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ (আইএসিএস)-এর একদল গবেষক। ক্যানসার আক্রান্তের দেহে কেমোথেরাপিকে আরও বেশি কার্যকরী করার উপায় বলে দিয়েছেন তাঁরা। বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা ‘সেল রিপোর্টস’-এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের গবেষণাপত্রটি।
আইএসিএস-এর ‘স্কুল অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্স’-এর বিজ্ঞানী তথা এই গবেষণার প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর বেণুব্রত দাস জানাচ্ছেন, কেমোথেরাপির সাহায্যে ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলিকে মেরে ফেলা হয়। কিন্তু, প্রত্যেক মানুষের দেহে নিজস্ব ডিএনএ মেরামতির কারখানা রয়েছে। যখন কেমোথেরাপি চলে,ক্যানসারের কোষগুলি নিজেদের মতো বাঁচার চেষ্টা করে। তখন সেই কোষগুলিকে সাহায্য করে ফেলে ওই মেরামতি-কারখানা। বেণুব্রত বলেন, ‘‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, কেমোথেরাপিতে (নিশানায় টোপোআইসোমারেজ-১) ক্যানসারের কোষগুলি ঠিক কেমন ভাবে কাজ করে এবং কী ভাবে ডিএনএ রিপেয়ারিং টুলবক্সের সাহায্যে সেগুলি ক্যানসার চিকিৎসার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।’’ তিনি জানান, নতুন আবিষ্কৃত চিকিৎসা পদ্ধতিতে ডিএনএরিপেয়ারিং টুলবক্স-এর কাজ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ফলে এটি কেমোথেরাপির পথে বাধা হতে পারছে না। ক্যানসার আক্রান্ত কোষের মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত করছে কেমোথেরাপি। গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখিকা সংহিতা ভট্টাচার্য। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন আরও অনেকে। কলকাতার বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই গবেষণায় কাজ করেছেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী জুলিয়া এম রিচার্ডসনও।ক্যানসার-রোধী চিকিৎসায় তাঁরা পিআরএমটি৫ প্রোটিন এবং টিডিপি১ উৎসেচককে নিশানা করেছেন।
বাজারে উপস্থিত ওষুধগুলি, যেমন ক্যাম্পটোথেসিন, টোপোটেকান, ইরিনোটেকাননিশানা করে টোপোআইসোমারেজ় ১ বা টপ ১-কে। এটি ডিএনএ-র প্রতিলিপি গঠনে সাহায্য করে। কোষ বিভাজনের জন্য ডিএনএ-র প্রতিলিপি গঠন জরুরি। ক্যানসার হলে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে এই প্রতিলিপি তৈরি হয়। বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতিতে ওষুধের সাহায্যে টপ ১-এর কাজকর্ম থামিয়ে দেওয়া হয়। এটি অকেজো হয়ে গেলে অসংখ্য কোষেরমৃত্যু হয়। যার মধ্যে থাকে ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলিও। কিন্তু এরই সঙ্গে যেটা হয় তা হল, শরীরের নিজস্ব কোষ মেরামতির ব্যবস্থাটি টিডিপি১ উৎসেচকের সাহায্যে অনেক ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ওষুধের বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করে।
আইএসিএস-এর বিজ্ঞানী সংহিতা বলেন, ‘‘ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলিতে পিআরএমটি৫ ভীষণ বেশি পরিমাণে থাকে। এই পিআরএমটি৫-কে নিশানা করে অল্প মাত্রায় ক্যাম্পটোথেসিন-সহ ওষুধের মিশ্রণ প্রয়োগ করলেক্যানসার কোষের মৃত্যু নিশ্চিত।’’ তিনি আরও জানান, পিআরএমটি৫ আবার সরাসরি টিডিপি১-কে নিয়ন্ত্রণ করে।
বেণুব্রত জানাচ্ছেন, গত ১০ বছর ধরে তাঁরা আইএসিএস-এ ডিএনএ রিপেয়ারিং সিস্টেম নিয়ে কাজ করছেন। শরীরের এই নিজস্ব ব্যবস্থাপনাটির জন্যই ক্যাম্পটোথেসিন ও সেটির মতো অন্যান্য ওষুধ ক্যানসার রোধে যথাযথ কাজ করে না। ২০১৮ সালে ডিএনএ সারাইয়ের জন্য দায়ী দু’টি প্রোটিন, টিডিপি১(টারোসিল ডিএনএ ফসফোডাইএস্টারেজ় ১) ও পিআরএমটি৫ (প্রোটিন আর্জিনিন মিথাইলট্রান্সফারেজ় ৫)-কে চিহ্নিত করা হয়। সেটা ছিল এই গবেষণার প্রথম যুগান্তকারী ধাপ। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের ‘নিউক্লিক অ্যাসিডস রিসার্চ জার্নাল’-এপ্রকাশিত হয়েছিল রিপোর্টটি। কিন্তু তখন এই প্রোটিন দু’টির কাজ করার ধরন বোঝা যায়নি। পরবর্তী পাঁচ বছরের একটানা গবেষণায় এ বার পরিষ্কার হল সেটাও।
ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কেমোথেরাপিতে অনেক সময়েই দেখা যায়, ক্যানসারের একই ধাপে থাকা দু’জন রোগীর মধ্যে একজন সুস্থ হলেন অনেকটা, অন্য জনের ক্ষেত্রে হয়তো তা কাজই করল না। তখন চিকিৎসকদেরও অসহায় লাগে। এই পদ্ধতিটি যদি কার্যকরী হয়, সে ক্ষেত্রে অনেকটাই উপকার হবে রোগীদের।’’
আইএসিএস-এর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ল্যাবরেটরির কাজ শেষ। প্রাণীদেহে পরীক্ষা চলছে।তার পরে মানবদেহে পরীক্ষা করে দেখা হবে। তবে পরীক্ষাগারে যথেষ্ট সাফল্য দর্শিয়েছে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতিটি।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।