Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
COVID19

‘ভিডিয়ো কলে আর মন ভরছে না। কবে নাতনিকে স্পর্শ করতে পারব, সেই আশায় বসে আছি’

ফের বিশ্বজুড়ে চালু হয়েছে নানা রকম বাধা-নিষেধ। তাই অনেকে চাইলেও বাড়ি ফিরতে পারছেন না।

অতিমারির কারণে বিদেশ থেকে বাড়ি আসতে পারছেন না অনেকেই।

অতিমারির কারণে বিদেশ থেকে বাড়ি আসতে পারছেন না অনেকেই। ফাইল চিত্র

পৃথা বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২১ ২০:৩৪
Share: Save:

মৌমিতা রায়চৌধুরী আমেরিকার ইন্ডিয়ানাপোলিসের বাসিন্দা। তাঁর বাবা-মা থাকেন কসবায়। ২০১৯ সালের অগস্ট মাসের পরে আর দেখা হয়নি বাবা-মায়ের সঙ্গে। মৌমিতা পেশায় মনোবিদ। ইন্ডিয়ানাপোলিসের দু’টি নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত। বিয়ের পর থেকে বছরে অন্তত একবার করে কলকাতা আসতেন। গত বছর ফিরতে পারেননি। ভেবেছিলেন বাবা-মায়ের প্রতিষেধক নেওয়া হয়ে গেলে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন। কিন্তু তা আর হল না। ‘‘বাবার দ্বিতীয় দফার প্রতিষেধক নেওয়া বাকি ছিল। তার মধ্যে চারদিকে এমন সংক্রমণ বাড়ল যে, এখন আর দেখা হওয়ার কোনও আশা নেই,’’ বললেন মৌমিতা।

মঙ্গলবার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার আমেরিকার নাগরিকদের উপদেশ দিয়েছেন, প্রতিষেধক নেওয়া হয়ে গেলেও এই মুহূর্তে কেউ যেন ভারত-সফরে না যান। গত বছর বহু প্রবাসী ভারতীয় দেশে ফেরেননি। তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন প্রতিষেধকের জন্য। কিন্তু ভারতে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ সব ওলটপালট করে দিল। নতুন ভারতীয় প্রজাতির সংক্রমণ নিয়ে চিন্তিত বহু দেশই। ফের বিশ্বজুড়ে চালু হয়েছে নানা রকম বাধা-নিষেধ। তাই অনেকে চাইলেও বাড়ি ফিরতে পারছেন না।

অসমের ছেলে শাকিল শোভন নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। ২০১৯ সালের পরে দেশে পা রা‌খেননি তিনিও। মার্কিন সরকারের এই নির্দেশে তার কী প্রতিক্রিয়া? ‘‘আমি আমেরিকার নাগরিক নই। আমি ভারতে ফিরতে চাইলে কেউ আমাকে হয়তো আটকাতে পারবে না। কিন্তু বিমান পরিষেবা কতটা চালু থাকবে, থাকলেও টিকিটের দাম কোথায় গিয়ে পৌঁছোবে, বুঝতে পারছি না। দেশের বাইরে একটানা বহুদিন রয়েছি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কী বা করার আছে? অসহায় লাগছে,’’ বললেন শাকিল।

মৌমিতা-শাকিলদের কাছে ভিডিয়ো কলই এখন বাড়ির সঙ্গে একমাত্র যোগসূত্র। মৌমিতার কথায়, ‘‘আমার দাদার মেয়ের নাম সারা। মনে হচ্ছে সে ভিডিয়ো কলেই বড় হয়ে গেল! নেটমাধ্যমের এই সুবিধেগুলির জন্য আমি খুব কৃতজ্ঞ। কিন্তু যখন বুঝতে পারি বাবা-মায়ের জীবনে অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে আর সেগুলো চোখে দেখার বদলে ক্যামেরাতেই দেখতে হচ্ছে, তখন প্রচণ্ড খারাপ লাগে।’’

নিউ ইয়র্কের তরুণ-জুটি মীনাক্ষী-অনুরাগ। দু’জনেই পড়াশোনার পরে কর্মসূত্রে ওই শহরেই থেকে গিয়েছেন। তাঁদের গত নভেম্বরে বিয়ের জন্য কলকাতা ফেরার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আর হয়নি। করোনা-ভয়ে পিছিয়ে গিয়েছিল তাঁদের বিয়ে। এ বছর তাঁদের পরিকল্পনা ছিল দেশে ফিরে আনুষ্ঠানিক বিয়েটা সেরে ফেলবেন। কিন্তু সেটাও এখন অনিশ্চিত। মীনাক্ষী বললেন, ‘‘অনুরাগের আত্মীয়েরা দিল্লিতে থাকেন। আমার সকলে কলকাতায়। বিয়ের সময়ে দেশে ফিরেও বেশ কয়েক বার সফর করতে হবে। সব ভেবেই গত বছর বিয়েটা পিছিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এবারও যদি পিছিয়ে যায়, তা হলে কী হবে, সেটা আর ভাবতে পারছি না। অনুরাগের দাদু-ঠাকুরমার এটা নিয়ে খুবই মন খারাপ। তা-ও আমরা বিয়ে পিছিয়ে নভেম্বরে করেছি। আমার অন্য বন্ধুরা যাঁরা এখানে থাকেন, এ বছর গরমের ছুটিতে বিয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁদের সকলকেই টিকিট বাতিল করে বিয়ের সব অনুষ্ঠান বাতিল করে দিতে হল। সকলেই এই নিয়ে খুব ভেঙে পড়েছেন।’’

রাজারহাটের বাসিন্দা তুলতুল বন্দ্যোপাধ্যায় অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। তাঁর মেয়ে-জামাই-দুই নাতনি থাকেন আমেরিকায়। নাতনিদের বড় হওয়া ভিডিয়ো কলে দেখা ছাড়া উপায় নেই। মেয়ের আসার কথা ছিল এই গরমের ছুটিতেই। প্রচুর টাকা দিয়ে টিকিট কেটেও তা বাতিল করে দিতে হয়েছে। তিনি বললেন, ‘‘সারাদিন বসে থাকি কখন মেয়ে-জামাই ভিডিয়ো কল করবে। ছোট নাতনিকে মুখে ভাতের পরে আর দেখিনি। সেদিন আমার স্বামী বললেন, ভিডিয়ো কলে আর মন ভরছে না। কবে ওদের সামনে থেকে দেখতে পাব, একটু স্পর্শ করতে পারব, বল তো?’’ মেয়ে-জামাইয়ের জন্য যতই মন খারাপ করুক না কেন, তাঁদের আসতে জোর করারও কোনও উপায় নেই তুলতুলের কাছে। দেশে এসে আটকা পড়ে যাবে কি না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই একাকিত্ব কাটাতে হাতের কাজ করে সময় কাটানোর চেষ্টা করছেন তিনি। তুলতুলের কথায়, ‘‘এখন আমার একটাই প্রার্থনা। অতিমারি কেটে যাক। আর আমি যেন নাতনিদের ফের দেখতে পাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE