বিরিয়ানি আর চাপের জন্য বিখ্যাত চিৎপুরের রয়্যাল ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ, সঙ্গে ঐতিহ্যের প্রতীক 'ব্লু প্লেক'। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
'রয়াল হোটেলে খাবারের অর্ডার দিয়ে ফেলুদা চন্দনা চুরির ব্যাপারে একটা বিজ্ঞাপনের খসড়া করে ফেলল'। তোপসের কথা থেকেই জানা যায়, সপ্তাহে একদিন তাদের রেস্তোঁরায় খাওয়া ছিল 'রেগুলার' ব্যাপার। অনুমান করতে অসুবিধে নেই, তার মধ্যে রয়্যাল ছিল বিশেষ পছন্দের। সত্যজিৎ রায়ের সেই 'নেপোলিয়নের চিঠি' গল্পটা মনে পড়ছে? সেই যে বারাসতে ১৫০ বছরের প্রাচীন বিলিতি ধাঁচের জমিদার বাড়িতে খাঁচা থেকে চন্দনা চুরির রহস্য উদ্ঘাটনে ফেলুদার যাওয়া, তাঁর উপস্থিতিতেই সবার অলক্ষ্যে প্রাক্তন ব্যারিস্টার ও মুঘল আমলের দাবা বোড়ে, ওয়ারেন হেস্টিংসের নস্যির কৌটো, নেপোলিয়নের চিঠির মতো কিউরিও সংগ্রাহক পার্বতীচরণ হালদারের খুন হয়ে যাওয়া এবং ফেলুদার তদন্ত ঘিরে উত্তেজনায় টানটান কাহিনী। তদন্ত অভিযানে নেমে রহস্যের 'ক্লু' পেতে কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাঘুরির ফাঁকে তোপসে আর লালমোহনবাবুকে নিয়ে খাওয়ার জন্য ফেলুদা কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন চিৎপুরে নাখোদা মসজিদের কাছে রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেলকে।
আর এটিও আমাদের জানতে বাকি থাকে না, যে তাঁরা সেদিন নিয়েছিলেন বিরিয়ানিই। খুঁটিনাটি বর্ণনা দিতে গিয়ে সত্যজিৎ লিখছেন, 'বিরিয়ানি খেতে খেতে একটা নলী হাড় কামড় দিয়ে ভেঙে ম্যারোটা মুখে পুরে ফেলুদা বলল, রহস্য যে রকম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বলা মুশকিল।' আর অপরাধের সূত্র খুঁজে পেতে তোপসের এক বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্যে ফেলুদা বলে ওঠে, 'রয়েলের খাওয়া যে ব্রেন টনিকের কাজ করে সেটা তো জানতাম না। তুই ঠিক বলেছিস তোপসে।' বোঝাই যাচ্ছে, সত্যজিৎ রায়ের কাছে রয়্যাল আর তার বিরিয়ানি ঠিক কতটা প্রিয় ছিল। তাই ফেলুদাকে দিয়ে তিনি রয়্যালের খাবারের জব্বর প্রশস্তি করিয়ে নিলেন। আমরাও জেনে গেলাম, শুধু সুস্বাদুই নয়, রয়্যালের খাবার খেলে তৃপ্তির মাত্রা এমনই তূরীয় অবস্থায় পৌঁছে যায়, যে কঠিন পরিস্থিতেও দারুণ বুদ্ধি খোলে।
ফেলুদা অ্যান্ড কোং-কে যে তোফা বিরিয়ানি মুগ্ধ করেছিল, সেই একই বিরিয়ানি সমান ভাবে মজিয়ে রেখেছে একালের সমঝদার খাদ্য রসিকদেরও। সপ্তাহের সাত দিনই দু'বেলা তাই রেস্তোঁরার একতলা ও দোতলার হল তিনটি খদ্দেরদের ভিড়ে ঠাসা। স্বাভাবিক ভাবেই রন্ধনশিল্পের ঐতিহ্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ (ইনট্যাক), প্রতিষ্ঠার প্রায় ১২০ বছরের মাথায় রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেলকে সম্প্রতি নীল রঙা ঐতিহ্য ফলক দিয়ে সম্মানিত করল। রয়্যালের মেনুতে হাল আমলে বিরিয়ানি ও মাটন চাপ ছাড়াও আরও নানারকম লোভনীয় পদের সমাহার হয়েছে ঠিকই, তবে জেনে অবাক হতে হয়, শুরুতে কিন্তু তুমুল জনপ্রিয় এই বিরিয়ানির কোনও অস্তিত্বই ছিল না।
১৯০৫ সাল। যাবতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ ঘটালেন। কলকাতা তখন উত্তাল। বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল, মিটিং, বিলিতি জিনিস বয়কটের ডাক। সেই অস্থিরতার মধ্যেও, ওই বছরেই ভবিষ্যৎ কলকাতার খাদ্য সংস্কৃতির ইতিহাসে সকলের অজান্তে সূচিত হল নতুন এক অধ্যায়। লখনউ থেকে এসে কলকাতার মাটিতে পা রাখলেন 'পেহলেওয়ান চাপওয়ালে'। নতুন আসা এই আগন্তুক কলকাতায় ছিলেন একেবারে অপরিচিত। তবে আদতে কুস্তিগির আহমেদ হুসেনকে গোটা লখনউ চিনত তাঁর ওই ডাকনামে। পালোয়ান হলেও রান্নার দিকে ছিল তাঁর বিশেষ ঝোঁক। নবাবদের পাকশালায় মাঝেমধ্যেই তলব হত। মোগলাই নয়, উচ্চমার্গের অওধি রন্ধনে সেখানেই তাঁর একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও পারদর্শিতা অর্জন। মাংসের চাপ বানিয়ে সেকালের নবাবি শহরে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাই মুখে মুখে তাঁর পরিচিতি ছড়িয়েছিল 'পেহলেওয়ান চাপওয়ালে' নামে।
যাবতীয় উত্তেজনা ও অস্থিরতা সত্ত্বেও কলকাতা তখনও ব্রিটিশদের রাজধানী। তার জৌলুসই আলাদা। ব্যবসা-বাণিজ্য সবেতেই সেরা। সেই শহরে এসে একবার হাজির হতে পারলে কোনও না কোনও ভাবে সবারই ভাগ্য খুলে যায়। স্বাভাবিক কারণেই আহমেদ হুসেনও তাই এসেছিলেন ভাগ্য অন্বেষণে। কুস্তির আখড়ায় তেমন সুযোগ না পেয়ে, চিৎপুর অঞ্চলে অভিরাম মল্লিকের বাড়ির একতলার একটি ঘর ভাড়া নিয়ে, সেখানে খুলে ফেললেন ছোট একটি খাবারের দোকান।
ওই অঞ্চলে এবং আশপাশ এলাকায় তখন ছিল অনেক হিন্দুর বাস। মল্লিকদের মার্বেল প্যালেস, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িও তো সব কাছাকাছি। ভেবে অবাক হতে হয়, অভিরাম মল্লিকের মতো এক হিন্দু বাড়িওয়ালা বহিরাগত এক মুসলমানকে সেই সময় ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন। ঘটনাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, তখনকার সমাজে মুসলমানের ছোঁয়ায় হিন্দুদের জাত-ধর্ম সহজে খোয়া যেত।
উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিম্নজাতের মানুষ বা অন্য সম্প্রদায়ের কারও কাছে জলগ্রহণ করতেন না। সেই সংস্কার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা রয়েছে নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর লেখায়। একবার ট্রেনে যেতে যেতে একই কামরায় দুই মুসলমান ব্যক্তির উপস্থিতিতে তিনি কমলা খাচ্ছিলেন বলে, তাঁর হিন্দু সহযাত্রী শিউরে উঠে বলেছিলেন, কমলালেবুতেও তো জল রয়েছে! ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯২৭ সালে। হিন্দুদের এমন আচরণে মুসলমান জাতিসত্তার ক্ষোভও চাপা থাকেনি। মৃণাল সেনের দাদার বন্ধু ছিলেন পল্লীকবি জসিমউদ্দিন। মৃণাল সেনের মা তাঁকে নিজের ছেলের মতো স্নেহ করলেও, খেতে বসাতেন বাড়ির বাইরে। জসিমউদ্দিন একবার নিজেই জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণের কারণ কী? মৃণাল সেনের মা তাঁকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, বাড়ির ভিতরে বসিয়ে তাঁকে খাওয়ালে, চাকর-বাকরেরা ব্যাপারটিকে সহজ ভাবে নেবে না।
মুসলমানি খানাদানার বিষয়েও মেছো হিন্দু বাঙালিদের অনেকের বিরূপ সংস্কার ছিল। রেলের আধিকারিক রায় সাহেব বিজ্ঞান চন্দ্র ঘোষ ১৯৪২ সালে প্রকাশিত 'আহার' বইতে লিখেছিলেন,"আমাদের অনেকে মুসলমান রাজত্বের কাল হইতে পোলাও, মাংসের কালিয়া, কোপ্তা, কোৰ্ম্মা, কাবাব এবং চপ, কাটলেট, মামলেট ইত্যাদি দুষ্পাচ্য ইংরেজি খানা খাইতে অভ্যস্ত হইয়াছে।' তিনি যে সব খাবার ইংরেজি বলে দাগিয়েছেন, সেগুলি আদৌ ওই পর্যায়ভুক্ত না হলেও সেকালের হিন্দু সমাজে যাবতীয় যাবনিক ও বিলিতি খাবারই ছিল সমগোত্রীয় ও ম্লেচ্ছ। অস্বীকার করার উপায় নেই, মধ্যবিত্ত হিন্দু ও মুসলমান বাঙালি পরিবারের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে সাংস্কৃতিক ব্যবধান তৈরি করে দিয়েছিল মাংসের ব্যবহার। উচ্চবর্ণের সচ্ছল হিন্দু পরিবারে রোজের আহারে থাকত ভাত, নানা রকম নিরামিষ তরকারি আর মাছ। আর মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারে ঘরোয়া খাবারের ছবিটি আমরা পাই বিশ শতকের গোড়ায় প্রকাশিত সাহিত্যিক ও মুসলিম নারী সংগঠনের নেত্রী নূরুন্নেছা খাতুনের একটি উপন্যাসে। সেখানে এক মুসলমান উকিলের বাড়িতে রোজই রান্না হয় অন্তত আট-দশ রকমের কোর্মা, কালিয়া, চপ ও কাবাব।
হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বাড়ির সাধারণ খাবারের সংজ্ঞার ফারাকটা এভাবে বোঝা যায়। অধিকাংশ মুসলমান পরিবারে মাংসই ছিল প্রধান খাদ্য। মাংস সম্পর্কে হিন্দুদের বিরূপতা এবং নিরামিষ খাবারের প্রতি বিশেষ অনুরাগের প্রতিক্রিয়াতেই যেন মুসলমানদের ঘরে ঘরে মাংসের বিভিন্ন পদের বাহুল্য, নিয়মিত রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল।
এমনই এক পরিস্থিতি ও রক্ষণশীল সামাজিক পরিবেশে আহমেদ হুসেন তাঁর খাবারের দোকানটি খুলেছিলেন হাতে গোনা তিন-চারটি পদ নিয়ে - মাটন চাপ, মাটন কালিয়া, খুশকা আর রুমালি রুটি। বিরিয়ানি নয়, খাস অওধি ঘরানার পোলাও যার সঙ্গে রাজযোটক ছিল কালিয়ার। আর রুটির সঙ্গে চাপ। সেই জিনিস তখন কলকাতায় একেবারে প্রথম। তাই শুরুতেই বাজিমাত। সেই খাবারের অভিনবত্বে আর আকর্ষণে তার বিক্রি আর জনপ্রিয়তা বেড়েই চলল। ব্যবসা বাড়তে থাকায়, আহমেদ বাড়িওলার কাছ থেকে দোতলার কয়েকটি ঘর ভাড়া নিয়ে বাইরে থেকে কলকাতায় নানা কাজে আসা অতিথিদের থাকার ব্যবস্থাও করলেন। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা একই জায়গায়। তাই নাম দিলেন রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল।
স্মরণীয়, এর প্রায় ৫০ বছর আগে ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশদের চক্রান্তে ক্ষমতাচ্যুত ও লখনউ থেকে নির্বাসিত হয়ে কলকাতার মেটিয়াবুরুজে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন শেষ স্বাধীন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। কলকাতার দক্ষিণ-পশ্চিম উপান্তে গঙ্গার তীরে গড়ে তুলেছিলেন আর একটা ছোটখাটো লখনউ। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর বিশাল পরিবার, হাতিঘোড়া, অগুনতি বেগম-বাঁদি-বাঈজি-গাইয়ে-বাজিয়ে-লোকলস্কর-পাত্রমিত্র-অমাত্য-পারিষদ-মোসাহেব-কবি-নৌকর, এমনকি আস্ত একটি চিড়িয়াখানা পর্যন্ত।
নবাবের সঙ্গে লখনউ ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন বহু অভিজাত ব্যবসায়ী এবং জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি। নৃত্যগীত-শিল্পকলা-কবিতা-শায়েরি, খানাপিনা - সব মিলিয়ে সেই সময় নতুন এক মিশ্র সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল মেটিয়াবুরুজ। নবাব, তাঁর সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন শতাধিক রকাবদার ও খানসামাকে। তাদের হাতের রান্না ছিল স্বর্গীয়। নানা রকম নবাবি পদের সমারোহে উল্লেখযোগ্য ছিল বিভিন্ন ধরণের পোলাও, বিরিয়ানি, চাপ, কাবাব, কোফতা, কোর্মা, কালিয়া ইত্যাদি। কলকাতার নব্য বাবুসমাজের গণ্যমান্যদেরও নিয়মিত আনাগোনার পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল নবাবের প্রাসাদ।
অওধি রন্ধনশৈলীর অমৃতসম নানা নবাবি খানার স্বাদ পেয়েছিলেন কলকাতার সব জমিদার ও সম্ভ্রান্ত মানুষ। ১৮৮৭ সালে নবাবের মৃত্যুর পরেও রয়ে গেল নবাবি খানার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। কলকাতার অভিজাত মহলে উৎসবে অনুষ্ঠানে বিশেষ সব রান্নার জন্য ডাক পড়তে শুরু হল ওস্তাদ বাবুর্চিদের। নবাবি রসুইখানা থেকে বের হয়ে সেই রন্ধনশিল্প ছড়িয়ে পড়ল শহরের নানা প্রান্তে। তবে নবাবি খানার স্বাদ পেতে সাধারণ মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও কিছুদিন। কারণ, ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান খাবারের কেতাদুরস্ত সাহেবি রেস্তোঁরা থাকলেও, নবাবি খানার কোনও রেস্তোঁরা গড়ে ওঠেনি। সেই শূন্যস্থানটি ভরিয়ে দিল আহমেদ হুসেনের রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল।
গোঁড়া হিন্দু সমাজে ম্লেচ্ছ খাবারের বিরুদ্ধে প্রচলিত সংস্কার ঘুচিয়ে উদার মানসিকতার প্রসারে মোগলাই খাবারের দোকানগুলির এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। উনিশ শতকের শেষ দিকে শ্রীহট্ট থেকে কলকাতা এসে বিভিন্ন মেসবাড়িতে কাটিয়েছেন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক বিপিন চন্দ্র পাল। তাঁর আত্মজীবনীতে সেই সময় কলকাতার খাওয়াদাওয়া নিয়ে নানা আকর্ষণীয় কাহিনী রয়েছে। প্রেসিডেন্সি কলেজের এক ছাত্রের জ্যাঠতুতো দাদার বাড়িতে কয়েকজন সহপাঠী বন্ধু সহ নিমন্ত্রিত হয়ে জীবনে প্রথম 'মুরগির কারি' আস্বাদনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা আমরা জানতে পারি। বিপিন পালের বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন তাঁরই সঙ্গে শ্রীহট্ট জেলা স্কুল থেকে বৃত্তি নিয়ে পড়তে আসা তারাকিশোর চৌধুরি। পরে তিনি হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী হন। রাসবিহারী ঘোষের যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে বহু মামলা লড়েছেন। ওই ভোজে রাতে মুরগি খেয়ে পরদিন সকালে তারাকিশোর বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে হাতের পেশি পরীক্ষা করছিলেন। শুনেছিলেন, মুরগি খেলে গায়ে জোর হয়। আবার নরেন্দ্রনাথ দত্তের বাবা বিশ্বনাথ দত্তের বাড়িতে ছিল মুসলমান বাবুর্চি। নরেন্দ্রনাথ তার কাছে বিভিন্ন মোগলাই রান্না শিখেছিলেন। বাড়ির কাছে পিরুর হোটেলে ফাউল কাটলেটের তিনি ছিলেন নিয়মিত খদ্দের। সন্ন্যাসী হওয়ার পরেও স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন একজন আদ্যন্ত ভোজনরসিক এবং যাবতীয় ছুৎমার্গের ঊর্ধ্বে।
মোগলাই খানার বিস্তারিত বিবরণ সম্রাট আকবরের বন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী আবুল ফজলের লেখা ফার্সি ভাষার আইন-ই-আকবরি বইতে পাওয়া যায়। সেই বইয়ের সাতটি 'আইনে' শুধু খানাপিনা নিয়ে বিশদ আলোচনা। কিন্তু মুসলমান রন্ধনশৈলী নিয়ে বাংলায় বইয়ের অভাব মিটিয়েছেন সৈয়দা হাফেজা খাতুন। তাঁর লেখা 'মোসলেম পাক-প্রণালী' প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। বইটির ভূমিকা লেখেন তাঁর স্বামী মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দিন আহমেদ। সেখানে তিনি লিখছেন, মুঘল আমলে রন্ধনশিল্প উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছয়। অনেক নতুন ও সুস্বাদু পদের সৃষ্টি হয় সেই সময়ে।
সম্রাজ্ঞী নূরজাহান নিজেও বেশ কয়েকটি উৎকৃষ্ট পদ উদ্ভাবন করেন। মুদ্রণযন্ত্রের অভাবে বহু রান্নার রেসিপি সংরক্ষিত হয়নি। অভিজাত মুসলমান পরিবারে কিছু রেসিপি হয়তো হাতে লেখা রয়েছে। তবে দিল্লি, আগ্রা, লাহোর, লখনউ ও মুর্শিদাবাদে বহু গ্রন্থগার ধ্বংসের ফলে ফার্সি ভাষায় লেখা দুষ্প্রাপ্য রান্নার বই ও অনেক মূল্যবান পান্ডুলিপি পুরোপুরি হারিয়ে গিয়েছে। লখনউ, কানপুর, দিল্লি, আগ্রা ও পাঞ্জাব থেকে সংগৃহীত বাদশাহী আমলের বিভিন্ন রান্নার বই থেকে মূল্যবান তথ্য আহরণ করে হাফেজা খাতুন বইটি লেখেন। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মোগলাই রান্নার ঐতিহ্য বাঙালি মুসলমানদের জন্যে টিকিয়ে রাখা এবং একই সঙ্গে হিন্দু, ব্রাহ্ম ও ভারতীয় খ্রিস্টান মহিলাদেরও মোগলাই রান্নায় পটু হয়ে উঠতে সাহায্য করা। তাঁর বইটিতে মুর্গ পোলাও, নার্গিসি পোলাও, কাবুলি পোলাও, কোর্মা পোলাও, শাহজাহানি পোলাও ইত্যাদির বিস্তারিত রেসিপি রয়েছে। সবগুলিই মাংস দিয়ে রান্নার।
হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মোগলাই ও অওধি খানা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল বলেই বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতি অতিক্রম করেও শতবর্ষ অতিক্রান্ত রয়্যালের বিরিয়ানি ও চাপের ঐতিহ্য আজও অটুট। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, আহমেদ হুসেনের পুত্র মেহবুব আলি খুশকা পোলাওয়ের জায়গায় অওধি বিরিয়ানি চালু করেন ১৯৪০ সাল বা তার কাছাকাছি সময়ে। জাফরান, দেশি ঘি ও বিভিন্ন মশলায় জারিত লম্বা দানার সরু বাসমতি চালের ভাতের মধ্যে জড়িয়ে থাকা নরম তুলতুলে বড় এক খন্ড মাংস। সেই সহজপাচ্য বিরিয়ানির হালকা স্বাদ-গন্ধ মাতিয়ে দিল সকলকে। রয়্যালের বিরিয়ানিতে মাংসের খন্ডের সঙ্গে মাংসের ছোট ছোট কোফতাও সকলের বিশেষ প্রিয়। পরম সুস্বাদু বিরিয়ানির সঙ্গে আর দ্বিতীয় কোনও পদ নেওয়ার প্রয়োজনও হয় না অনেকের।
বলা বাহুল্য এই বিরিয়ানিতে আলু থাকে না। রয়্যালের বর্তমান কর্ণধার মহম্মদ ইরফান ও তাঁর দাদা মহম্মদ সোহেল বলছিলেন, তাঁদের দোকানের চাপের সুখ্যাতি আজও একই ভাবে চলে আসছে। খাসির রান থেকে বিশেষ ভাবে মাংস কেটে পাথরে পিষে দু' ঘন্টা দই ও নানা মশলায় জারিয়ে নিয়ে কাঠের ধিকি ধিকি আঁচে অনেক সময় ধরে চাপ তৈরি হয়। খাসি আনা হয় উত্তর প্রদেশ থেকে। গড়ে দৈনিক ৩০০ কেজি মাংস প্রয়োজন হয় বিরিয়ানি ও মাংসের অন্যান্য পদের জন্যে। বিশেষ ভাবে মাংস কাটার জন্য তাঁদের রয়েছে নিজস্ব কসাই।
ইরফানের ঠাকুরদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপ্ত দিল্লির আইটিসি হোটেলের বিখ্যাত শেফ ইমতিয়াজ কুরেশি। রয়্যালের বিরিয়ানি ও চাপ ছিল তাঁর প্রিয়। কলকাতায় এলেই চলে যেতেন চিৎপুরে। তিনি একবার বলেছিলেন, রয়্যালের খাসির মাংস কাটার পদ্ধতি দেখার মতো। অনেক কিছু শেখার আছে। তিনি বলেছিলেন, কোনও প্রতিষ্ঠানে খাবারের গুণগত মান একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বজায় রাখা খুব কঠিন। তবে রয়্যাল সেই কাজে খুবই সফল। ইরফানের দাদা সোহেল জানান, রয়্যালের বিরিয়ানির উচ্চাঙ্গের মানের স্বীকৃতি হিসাবে হায়দরাবাদের নিজাম, বহু বছর আগে দিয়েছিলেন স্বর্ণপদক। কিন্তু ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক অশান্তির সময় আরও বহু মূল্যবান পারিবারিক ছবি ও নথিপত্রের সঙ্গে সেই সোনার পদকও খোয়া যায়।
ইরফান বলছিলেন, একেবারে গোড়া থেকে রয়্যালের খাবার যেত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। তবে এই কাহিনীর সত্যতা যাচাই করার উপায় আজ নেই। ঠাকুরবাড়ি ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কোনও লেখায় যেমন আমরা বিরিয়ানির উল্লেখ দেখি না, তেমনই রয়্যালের প্রতিষ্ঠা যে ১৯০৫ সালে, তারও কোনও প্রামাণ্য নথি মেলে না। হোটেলের ঘরে থেকে গিয়েছেন বড়ে গোলাম আলি খাঁর মতো শিল্পী। রাজ কাপুর, দিলীপ কুমার কলকাতায় এলে রয়্যালের খাবার খেতেন। উত্তমকুমার আসতেন নিয়মিত। এই পাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল সত্যজিৎ রায়ের। রয়্যালের ঠিক উল্টো দিকে ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘নিউ মোরাদাবাদি শপ’ থেকে 'শতরঞ্জ কে খিলাড়ি' ছবির সেটের জন্যে প্রাচীন গড়গড়া সহ বেশ কিছু সরঞ্জাম কিনেছিলেন। আর স্বাভাবিক ভাবেই খেয়েছিলেন রয়্যালের বিরিয়ানি। এসেছিলেন খুশবন্ত সিংহও। এছাড়া আশির দশকে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে টেস্ট সিরিজ খেলতে আসা ওয়াসিম আক্রম, জাভেদ মিঁয়াদাদ সহ পাকিস্তান ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়রা এসেছিলেন। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এসেছিলেন গুন্টার গ্রাস।
যুগের বিবর্তনের সঙ্গে রয়্যালের মেনুতেও বেশ কয়েকটি নতুন পদের সংযোজন ঘটেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাড়-বিহীন মাটন পাসিন্দা কাবাব যা অতি উপাদেয়, মাটন রান মসল্লম, শিরমল পরোটা ও গলৌটি কাবাব। চিকেন চাপ ও চিকেন লিভার কিংবা মাটন কিমা তো আছেই। আর আছে কুন্দন কোর্মা এবং প্রতি সোম ও শুক্রবার মাটন স্ট্যু। কয়েক বছর হল পার্ক সার্কাসে রয়্যাল একটি আউটলেট খুলেছে। ইরফান বললেন, অদূর ভবিষ্যতে রাজারহাট-নিউ টাউন এবং গড়িয়া-বারুইপুর এলাকাতেও তাঁদের নতুন শাখা খোলার পরিকল্পনা আছে। শুধু তাই নয়, বাংলার বাইরে বেঙ্গালুরুতেও একটি শাখা খোলার কথা ভাবনা চিন্তা করছেন।
ইরফানের কনিষ্ঠ পুত্র মহম্মদ আদনান কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে আপাতত সহকারি ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত। রয়্যাল আড়েবহরে বাড়লে আদনানকে হয়তো ভবিষ্যতে চাকরি ছেড়ে পারিবারিক ব্যবসার কোনও গুরুদায়িত্ব নিতে হবে।
বছর তিনেক আগেও, ‘ফুড ডেলিভারি অ্যাপ’ স্যুইগি-র 'স্ট্যাটইটস্টিক্স' বার্ষিক রিপোর্টে অর্ডার করা খাবারের শীর্ষে ছিল বিরিয়ানি। বিরিয়ানি-প্রীতিতে সেরা শহর লখনউ, কলকাতা, চেন্নাই ও হায়দরাবাদ। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, ইদানিং বাড়ছে ভেজিটেরিয়ান বা নিরামিষ খাবারের চাহিদা। স্যুইগি-র একটি হিসেবেই দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরে এ পর্যন্ত সারা দেশে যত খাবার অর্ডার করা হয়েছে, তার ৬০ শতাংশই নিরামিষ খাবার। আর নিরামিষের চাহিদায় একেবারে ওপরে রয়েছে বেঙ্গালুরু। কলকাতাতেও ‘ভেজিটেরিয়ান ফাইন ডাইনিং’ রেস্তোঁরার সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে কলকাতা এবং রাজ্য জুড়ে যত্র তত্র বিরিয়ানির চাহিদাও পাশাপাশি কিন্তু বেড়ে চলেছে। বিয়েবাড়ি থেকে শীতের পিকনিক বা গেট-টুগেদার, বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা সর্বত্র। তাই বিরিয়ানি যেন ক্রমেই হয়ে উঠেছে বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। তবে নবাবি হেঁশেল থেকে বেরিয়ে সর্বজনীন স্তরে মিশে যাওয়া বিরিয়ানির এই গণতন্ত্রীকরণে প্রকৃত অওধি বিরিয়ানি বা তার রন্ধনশৈলীর কৌলিন্য ও আভিজাত্যের ঐতিহ্য আর কতদিন টিকে থাকবে তা হয়তো সময়ই বলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy