বাংলার অন্যতম সমাজ সংস্কারক গোপীনাথ বসু (পুরন্দর খাঁ) ছিলেন গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের উজির। সুলতানি দরবার থেকে গোপীনাথ এবং তাঁর ভাই বল্লভ ‘মালিক’ উপাধি লাভ করলেন। কালক্রমে ‘মালিক’ রূপান্তরিত হল ‘মল্লিক’-এ। ফলে পরিবারের পদবি দাঁড়ায় বসুমল্লিক। গোপীনাথ ছিলেন মাহিনগরের বাসিন্দা। কিন্তু বাংলায় মোগল শাসন শুরু হলে পরিবারের অনেকেই বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েন। একটি শাখা হুগলি জেলার পাণ্ডুয়ার কাছাকাছি কাঁটাগড় গ্রামে বসবাস করতে শুরু করে।
আরও পড়ুন:
১৭৯৪ সালে পরিবারের সদস্য রামকুমার বসুমল্লিকের সঙ্গে কলকাতার সাবেক পটলডাঙার (বর্তমান কলেজ স্কোয়্যার এলাকা) কৃষ্ণরাম আইচের কন্যা শঙ্করীর বিয়ে হল। তাঁদের পুত্র রাধানাথ পটলডাঙা বসুমল্লিক পরিবারের প্রাণপুরুষ। রাধানাথ জাহাজ ও অন্যান্য ব্যবসা করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন। তিনি ১৮৩১ সালে সাবেক ক্যাথিড্রাল মিশন লেনে ঠাকুরদালান-সহ ভদ্রাসন নির্মাণ করে (বর্তমানে ১৮এ, রাধানাথ মল্লিক লেন) দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। উল্লেখ্য, পরিবারের দুই শরিকি বাড়িতেও (২২, রাধানাথ মল্লিক লেন এবং ৪৬, শ্রীগোপাল মল্লিক লেন) যথাক্রমে ১৮৯১ এবং ১৮৯৬ সালে দুর্গাপুজো শুরু হয়।
বসুমল্লিক বাড়ির ঐতিহাসিক ঠাকুরদালান। ছবি: সংগৃহীত।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বসুমল্লিক পরিবারের এই ঠাকুরদালান একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯০৫ সালের ২৭ অক্টোবর সেখানে ছাত্রসভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বক্তৃতা করেছিলেন। রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিকও এই পরিবারের সন্তান। পাঁচ খিলান ও দুই দালান বিশিষ্ট ঠাকুরদালানটির স্তম্ভের উপরে বিষ্ণুর দশ অবতারের মাটির মূর্তি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সিঁড়ির সামনে চারটি বাতিস্তম্ভে পরির অবস্থান। এক সময়ে দুর্গাপুজো উপলক্ষে এখানে পারিবারিক নথিপত্রের প্রদর্শনী হত।
বসুমল্লিক পরিবারের প্রতিমা একচালার। প্রতিমাসজ্জা মূলত ডাকের সাজের। তবে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশকে বেনারসি সিল্কের শাড়ি ও ধুতি পরানো হয়। সিংহের মুখ ড্রাগনাকৃতির। পুজো হয় প্রতিপদ কল্পে। অমাবস্যা বা মহালয়ার পরের দিন শুরু হয় বোধন।
বসুমল্লিক পরিবারে পুজোয় কলাবৌ স্নান। ছবি: সংগৃহীত।
কলাবৌ স্নান এই পরিবারের পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাধারণত এই রীতির জন্য কেউ গঙ্গায় যান, আবার কেউ মণ্ডপেই কলাবৌ স্নানের পর্ব সারেন। বসুমল্লিক পরিবারের কলাবৌকে ঠাকুলদালানেই স্নান করানো হয়। তবে বিভিন্ন তীর্থ থেকে সেই জল সংগ্রহ করা হয়। পরিবারের তরফে গৌতম বসুমল্লিক বললেন, ‘‘সারা বছর ধরে পরিবারের সদস্যেরা বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে গেলে সেই জল সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। সব মিশিয়ে কলাবৌ স্নান করানো হয়।’’
বসুমল্লিক পরিবারের পুজোয় দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয় না। পরিবর্তে ভোগ হিসেবে গোটা ফল, গোটা আনাজ, চাল এবং মিষ্টি দেওয়া হয়। অতীতে পুজোয় পশুবলির রীতি ছিল। কিন্তু এখন তা বন্ধ। সন্ধিপুজো এবং মহানবমীতে চালকুমড়ো বলির সময়ে এখনও রীতি অনুযায়ী পারিবারিক বন্দুক ছোড়া হয়। দশমীর দিন বরণের পর নিমতলা ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।