E-Paper

কম বয়সে কৌতূহল বেশি

বাচ্চাদের মধ্যে এখন কম বয়স থেকেই প্রেম, যৌনতা সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হচ্ছে। অভিভাবকরা কী ভাবে সামলাবেন তা?

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:৫৭

—নিজস্ব চিত্র।

অরণ্য তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মাকে জানাল, সহপাঠী তনিশা তার গার্লফ্রেন্ড। অরণ্যর মা তো কী বলবেন বুঝে পাচ্ছেন না। রেজ়াল্টে ভাল নম্বর পাওয়ার আনন্দে ষষ্ঠ শ্রেণির সপ্তর্ষি তার সহপাঠী রিয়াকে জড়িয়ে ধরল। সারা স্কুলে রটে গেল যে তারা প্রেম করছে।

এমন ছোট ছোট অজস্র ঘটনা রয়েছে আমাদের সামনে। এই প্রজন্মের বাচ্চারা কি একটু তাড়াতাড়ি পরিণত হয়ে যাচ্ছে? নাকি প্রেমের বয়স এগিয়ে আসছে? বিষয়টাকে কী ভাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা?

বাচ্চারা প্রেমের কথা বললে

এডুকেটর ও কাউন্সেলর ড. জোনাকি মুখোপাধ্যায় বললেন, “স্কুলের সঙ্গে দীর্ঘ দিন যুক্ত থাকায় এমন অনেক ঘটনাই দেখেছি। ক্লাস টু-এর বাচ্চা, সে হয়তো ভাল করে কথাই বলতে পারে না, এ দিকে সহপাঠীকে বলছে ‘আই লাভ ইউ’। অনেকের আবার ছোট বয়সেই গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড নিয়ে কৌতূহল। মা-বাবারা এ সব শুনলে রেগে যান, বকুনি দেন। সেটা উচিত নয়। চারপাশের জগৎ এখন পাল্টে গিয়েছে। ছোটদের কার্টুন, অ্যানিমেশন মুভিতেও বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড দেখা যায়। ওরা সেই চরিত্রগুলোর সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু সেই বয়ফ্রেন্ড আর গার্লফ্রেন্ডের সম্পর্ক কী, অত ওরা বোঝে না। তাই ওদের মতো করেই বিষয়টা বোঝাতে হবে।”

আর একটা বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সেটা হল আন্তর্জালে যে কোনও জিনিস যেন বাচ্চারা না দেখে, সেই নিয়ন্ত্রণটা অভিভাবকের হাতে রাখতে হবে। অনেকেই বাড়িতে ছোট বাচ্চাদের হাতে মোবাইল বা টিভির রিমোট তুলে দেন। কিন্তু সে কী দেখছে, খেয়াল রাখেন না। মোবাইলে কিন্তু নানা রকমের বিষয় থাকে এবং পুরোটাই স্ক্রিনিং ছাড়া সে দেখছে। তাই প্রয়োজনে মোবাইল বা টিভিতে চাইল্ড লক ব্যবহার করুন।

এ ক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকাও কম নয়, মনে করালেন পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ। তিনি বললেন, “অনেক সময়ে মা-বাবারা সন্তানের সামনে এমন বিষয়ে আলোচনা করেন, এমন সিরিজ়-সিনেমা দেখেন, যা বাচ্চার দেখার বা শোনার কথা নয়। ছোট বলে আমরা খেয়াল করি না, কিন্তু ওরা সব দেখে-শোনে। আবার অনেক বাড়িতে ঠাকুরমা-ঠাকুরদা বা গৃহসহায়িকা টিভিতে যা দেখছে, বাচ্চাটিও দেখছে। অনেক সময়ে দেখেছি বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে হয়তো মা বা বাবা জড়িত। তা নিয়ে বাড়িতে অশান্তি হচ্ছে বাচ্চার সামনেই। সেটাও কিন্তু শিশু হৃদয়ে প্রভাব ফেলে। তাই সন্তানের সামনে নিজেদের আচরণ নিয়েও সতর্ক থাকতে হবে।”

আর একটু বড় হলে সমস্যা বেশি

সন্তানের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা বিষয়ে কৌতূহলও বাড়ে। তার উপরে এখন বয়ঃসন্ধি এগিয়ে এসেছে। ফলে ওদের মনোজগতেও একটা বিরাট পরিবর্তন চলতে থাকে। সে সময়ে কড়া শাসন করতে গেলে ওরা দূরে সরে যাবে। যদি এমন কোনও বিষয়ে কথা বলে, যা ওদের মুখে বেমানান, সে বিষয়ে ওদের বুঝিয়ে বলতে হবে, এড়িয়ে গেলে হবে না।

জোনাকি বললেন, “এই বয়সে অনেকেই এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়, যে সারা জীবন তার ভার বইতে হয়। এমন একটি ঘটনা একবার সামনে এসেছিল, যেখানে দশম শ্রেণির দু’টি ছেলে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রের শ্লীলতাহানি করে। ফলে ছেলেটি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। তার রেজ়াল্টেও প্রভাব পড়ে। ব্যাপারটা জুভেনাইল কোর্ট অবধি গড়িয়েছিল।” প্রত্যেক স্কুলেই এখন সেক্স এডুকেশন পড়ানো হয়। মা-বাবাদেরও সন্তানকে অনেক সচেতন ভাবে বড় করতে হবে। নিজের সন্তানের যেন ক্ষতি না হয়, সেটা যেমন দেখতে হবে, অন্যের সন্তানেরও যেন কোনও ক্ষতি না করে, সে দিকেও নজর রাখতে হবে।

এই প্রসঙ্গে পায়েল উল্লেখ করলেন, “অনেক সময়ে দেখা যায় ক্লাস সিক্স, সেভেনের ছেলেমেয়েরা নিষিদ্ধ সাইট দেখছে। একটি বাচ্চার কাছ থেকে তার বন্ধুদের মধ্যেও সেটা ছড়িয়ে যাচ্ছে। নিষিদ্ধ বিষয়ে সব মানুষের কৌতূহল থাকে। সেখানে একটা বাচ্চা প্রথম যদি এমন কিছু দেখে, তখন কৌতূহল বাড়বেই। কিন্তু সেটা যেন নেশায় পরিণত না হয়। সে ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং করাতে হবে।” অনেক সময়ে মা-বাবারা নিজেরা বিষয়টা কড়া হাতে দমন করতে গিয়ে সমস্যা আরও জটিল করে তোলেন। তখন বাচ্চারা কথাই শুনতে চায় না, ভুল পদক্ষেপও করে ফেলতে পারে। সেই পরিস্থিতি তৈরি না করে বরং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

নগরজীবনের সমস্যা যেমন এক রকম, গ্রামের বাচ্চাদের মধ্যে এই সমস্যা আরও বেশি চিন্তাজনক। “গ্রামের দিকে দেখেছি সিক্স, সেভেনে পড়া মেয়েরা প্রেম করে পালিয়ে চলে যায়। অনেক সময়ে বিয়ে করে নেয় নাবালিকা বয়সেই। ফলে পড়াশোনা তো বন্ধ হয়ে যাচ্ছেই। তার সঙ্গে কম বয়সে তারা অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক সময়ে মা-বাবারা হয়তো ঘুম থেকে উঠে কাজে বেরিয়ে যাচ্ছে, সন্ধের মুখে ফিরছে। বাচ্চারা সেখানে নিজের কাজ থেকে বাড়ির কাজ সবই সামলায়। ফলে তারা সময়ের আগে অনেক পরিণত,” বললেন পায়েল।

উপায় কী?

ছোট থেকে ছেলে ও মেয়েদের একসঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে দিন।

স্কুল ও রোজকার পড়াশোনার বাইরে যে সময়টা থাকে, সেটা যেন একটা শিশু মোবাইল বা টিভি দেখে না কাটায়, সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। পাড়ায়, কমপ্লেক্সের মধ্যে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে দিন। মাঝেমাঝে বাচ্চার বন্ধুদের সঙ্গে মা-বাবারাও গিয়ে কথা বলুন, গল্প করুন, সময় কাটান। তা হলে ওর বন্ধুবৃত্তে কী ধরনের আলোচনা হচ্ছে, তার আন্দাজ পাবেন।

সন্তানের সঙ্গে রোজ কম করে হলেও আধ-এক ঘণ্টা কথা বলার মতো সময় রাখুন। তা হলে ওর মনোজগতের পরিবর্তনের হদিস পাবেন। সে যদি প্রেম বা শরীর সম্পর্কে কোনও বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করে, তার মতো করে সেটা বুঝিয়ে দিন। ‘ও সব বড়দের ব্যাপার’ বলে এড়িয়ে যাবেন না।

বাচ্চারা যা শিখছে তা এই সমাজ থেকেই শিখছে। ফলে তাদের দোষারোপ করলে হবে না। বরং সামাজিক ভাবে তাকে বড় করার জন্য অভিভাবককে সময় দিতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Parenting Tips Young Generation Generation Z Love Relationship Relationship Advice

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy