Advertisement
E-Paper

ভেক ধরেছে ভাইরাস, নাজেহাল ডাক্তারেরা

এ যেন অভিমন্যুর চক্রব্যূহে ঢোকার মতো অবস্থা। প্রবেশের মন্ত্র জানা আছে। প্রস্থানের শর্ত অজানা। সপ্তরথীর হাতে শেষ পর্যন্ত নিহত হয়েছিলেন অভিমন্যু। কিন্তু এই ‘অভিমন্যু’কে কাবু করতে পারছেন না রথী-মহারথীরাও। বরং মানুষের দেহে অজানা এক ব্যূহ তৈরি করে ফেলেছে সে-ই।

সোমা মুখোপাধ্যায় ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৩

এ যেন অভিমন্যুর চক্রব্যূহে ঢোকার মতো অবস্থা। প্রবেশের মন্ত্র জানা আছে। প্রস্থানের শর্ত অজানা।

সপ্তরথীর হাতে শেষ পর্যন্ত নিহত হয়েছিলেন অভিমন্যু। কিন্তু এই ‘অভিমন্যু’কে কাবু করতে পারছেন না রথী-মহারথীরাও। বরং মানুষের দেহে অজানা এক ব্যূহ তৈরি করে ফেলেছে সে-ই। শরীরের সব প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি সেরে যাচ্ছে নিজের কাজ। বাইরে থেকে অতিরিক্ত বাহিনী এনেও বধ করা যাচ্ছে না এই যোদ্ধাকে।

এই অভিমন্যু আসলে এক ধরনের ভাইরাস। শরীরের ভিতরে ঢোকার গোপন পথটা তার জানা। বার বার জিনের গঠন বদলে ফেলে সে দেহের প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ছে দেহের মধ্যে। রক্তের মধ্যে ঢোকার পরেও শ্বেত রক্তকণিকা এবং অন্য যোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থার মুখে পড়েও এই ভাইরাস অবিচল। চরিত্র বদলে ফেলায় প্রথমে তাকে চিনতেই পারছে না রক্তের নিরাপত্তারক্ষীরা। আর যখন চিনতে পারছে, তত ক্ষণে ভাইরাস নিজের কাজ শুরু করে দিয়েছে শরীরের ভিতরে। তাকে না যাচ্ছে মারা, না বের করে দেওয়া যাচ্ছে শরীর থেকে।

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

এই সব ভাইরাসকে কুপোকাত করার জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। নেই কোনও প্রতিষেধক। আবার মশা-মাছির মতো কোনও বাহকের মাধ্যমে তা আসছে কি না, সে বিষয়টাও অজানা। যে ভাবে এই সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে তাতে পরজীবী-বিশেষজ্ঞদের কারও কারও ধারণা, ভাইরাসগুলি বায়ুবাহিত কিংবা জলবাহিত।

কী কী সমস্যার সৃষ্টি করছে এই ভাইরাসগুলি? টানা দশ দিন বাড়িতে বন্দি হয়ে রয়েছেন দমদমের বাসিন্দা ৭২ বছরের সুব্রত দেবনাথ। গায়ে জ্বর, বুকে বসে গিয়েছে সর্দি। কাশির সঙ্গে উঠছে কফ। কথা বলতে গেলেই শুরু হয়ে যাচ্ছে কাশি। বেহালার ৬৩ বছর বয়সি রাধারানিদেবীও সাত দিন ধরে কাশি, গলাব্যথায় ভুগছেন। সঙ্গে জ্বর। খাবারে অরুচি। রক্ত পরীক্ষায় ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি কিছুই মেলেনি। আরও যে কত দিন এ ভাবে চলবে... দুশ্চিন্তায় প্রৌঢ়া।

পরজীবী-বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, শুধু হাল্কা জ্বর, কাশি, কফ বসে যাওয়া নয়, নতুন ধরনের ওই ভাইরাসগুলি দেহের পাচনতন্ত্রকে এতটাই কাবু করে দিচ্ছে যে আক্রান্তদের একটা বড় অংশকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে। কারও কারও জ্বরের সঙ্গে গায়ে-হাত-পায়ে ব্যথা। সঙ্গে পেট খারাপও। উপসর্গ ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া-র। অথচ রক্ত পরীক্ষায় কোনও জীবাণু মিলছে না। এক পরজীবী বিজ্ঞানীর মন্তব্য, ‘‘রোগটা না জানলে চিকিৎসা করব কী করে! তাই কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ জ্বরের ওষুধ দিচ্ছি রোগীকে। যে জীবাণুটা শরীরে ঢুকেছে সেটা অনেক ক্ষেত্রেই শরীর থেকে অতিরিক্ত জল শুষে নিচ্ছে। তাই গলা মাঝে মাঝে শুকিয়ে আসছে। জিভ শুকনো হয়ে যাচ্ছে। ঘন ঘন জল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে রোগীকে।’’

কেন ওষুধ দিয়ে মোকাবিলা করা যাচ্ছে না সাম্প্রতিক ভাইরাল জ্বর?

স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা পরজীবী বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী বলেন, ‘‘বহু ক্ষেত্রে ভাইরাসের প্রাকৃতিক ভাবে মিউটেশন ঘটে যায়। এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মিউটেশনের ফলে ভাইরাস যে চেহারা নেয়, সেটা সম্পর্কে ডাক্তাররা ওয়াকিবহাল না হলে, তা বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।’’

সেটা কী রকম?’’ অমিতাভবাবু বলেন, ‘‘উপসর্গ দেখে ডাক্তারদের বুঝতে হবে রোগের গতিপ্রকৃতি কী। যেমন ইদানীং বহু ক্ষেত্রে হচ্ছে জ্বর-হাঁচি-কাশি, পরীক্ষায় দেখা গেল ডেঙ্গি। আবার অন্য একটি ক্ষেত্রে জ্বর রয়েছে, কিন্তু হাঁচি-কাশির বালাই নেই, গায়ে সামান্য লালচে দাগ, পরীক্ষায় জানা গেল সেটাও ডেঙ্গি। দু’টি ক্ষেত্রে ডেঙ্গির চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। এই জন্যই ডাক্তারদের আরও বেশি করে সতর্ক হতে হবে। তা না হলেই রোগটা বিপদে ফেলতে পারে। মোদ্দা কথা হল, সাধারণ জ্বরেও নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকার আর উপায় নেই।’’

কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা নাইসেড-এর ভাইরোলজিস্ট প্রভাস সাধুখাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘কিছু কিছু ভাইরাসের মূল বৈশিষ্ট্যই হল তারা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কোণঠাসা করে ফেলে, যাতে তারা টিকে যেতে পারে দিনের পর দিন। ডেঙ্গি, জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের ভাইরাসগুলো নিজেদের দ্রুত বদলে ফেলে। ফলে তাদের পক্ষে ছদ্মবেশে মৌরসিপাট্টা গেড়ে ফেলা সহজ হয়। প্রভাসবাবু বলেন, ‘‘একই ধরনের জিন থেকে একাধিক চরিত্র তৈরি হচ্ছে। কারও বোঝার আগেই আবার সেই চরিত্র বদলে যাচ্ছে। যা পরিস্থিতি, তাতে এর সঙ্গে লড়ার খুব বেশি সুযোগ নেই।’’

তাঁর কথায়, ‘‘যেমন, ডেঙ্গির ভাইরাস। যত দিন না প্রতিষেধক টিকা আসছে, তত দিন কিছু করার নেই। বিদেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চললেও এ দেশে এই ধরনের টিকা নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়নি। তাই অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে আমাদের।’’

প্যাথোলজিস্ট শুভেন্দু রায় বলছিলেন, ‘‘বেঁচে থাকার তাগিদ হল জীবের ধর্ম। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসও সেই তাগিদে তাদের অ্যান্টিজেনিক চরিত্র বদলে ফেলে। যখন ওরা দেখছে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে ওর মেটাবলিজম-এ বার বার আঘাত করে বংশবৃদ্ধি রুখে দেওয়া হচ্ছে, তখন সে-ও জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে সেই অতিব্যবহৃত, কার্যকরী অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসছে।’’

দেখা যাচ্ছে, ১৫ দিন, ২১ দিন এমনকী এক মাস পার হয়ে যাচ্ছে, অথচ ভাইরাল ফিভার কমছে না! জ্বর উঠলেই থার্মোমিটারের পারদ ১০৩ বা ১০৪ ডিগ্রি ছুঁয়ে ফেলছে! প্যারাসিটামল দিয়ে, মাথায় লাগাতার জলপট্টি দিয়ে বা জল ঢেলেও সেই জ্বর নামাতে কালঘাম ছুটছে। ডেঙ্গি হয়নি তা সত্ত্বেও সাধারণ ভাইরাল ফিভারে রোগীর প্লেটলেট কমছে হু-হু করে। কমছে ডব্লিউবিসি কাউন্ট বা নিউট্রোফিল কাউন্ট-ও!

এ বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ভাইরাল ফিভার (ডেঙ্গিও এক ধরনের ভাইরাল জ্বর)-এর মরসুমে রোগীদের শরীরের এমন কিছু উপসর্গ চিন্তায় ফেলেছে চিকিৎসকদের। কারণ, এই জ্বরের এই রকম উপসর্গ দেখতে তাঁরা অভ্যস্থ নন। তাই তাঁরা এক রকম নিশ্চিত, ডেঙ্গি-সহ সব ধরনের ভাইরাসের জিনগত চরিত্র বদলাচ্ছে। ফলে চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রাথমিক ভাবে হকচকিয়ে যেতে হচ্ছে তাঁদের। যে হেতু ভাইরাল জ্বরের সেই অর্থে কোনও সরাসরি ওষুধ এখনও নেই, উপসর্গ-ভিত্তিক সহযোগী চিকিৎসাই একমাত্র সম্বল, তাই চিকিৎসার ঝক্কি ও ঝুঁকি দুই-ই বাড়ছে।

জ্বরের কী ধরনের পরিবর্তন বেশি দেখা যাচ্ছে? শুভেন্দুবাবু জানিয়েছেন, প্রথমত, এখন বেশির ভাগ ভাইরাল জ্বর অনেক বেশি দিন ধরে থাকছে। দ্বিতীয়ত, প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকে অনেক ক্ষেত্রে কাজ হচ্ছে না। তৃতীয়ত, চিকিৎসায় দ্রুত সাড়া পাওয়া মুশকিল হচ্ছে। চতুর্থত, কারও ক্ষেত্রে ডেঙ্গিতে র‌্যাশ একেবারেই বেরোচ্ছে না, আর যাঁদের বেরোচ্ছে, তাঁদের ক্ষেত্রে তা মারাত্মক আকার নিচ্ছে। তিনি আরও জানান, শুধু ডেঙ্গি নয়, যে কোনও ভাইরাল জ্বরে এখন প্লেটলেট অনেক কমে যেতে পারে।

চিকিৎসকদের মতে, ভারতের মতো দেশে জনসংখ্যা বেশি, দূষণ বেশি, বেশির ভাগ মানুষের জীবনধারণের মান খারাপ। এই রকম পরিস্থিতিতে জীবাণু বা ভাইরাসের নতুন করে জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে শক্তিমান হয়ে ফিরে আসার সুযোগ বেশি থাকে।

স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ভাইরোলজিস্ট নিমাই ভট্টাচার্য অবশ্য জানিয়েছেন, জিনের মিউটেশন বেশি ঘটছে ডেঙ্গির ক্ষেত্রেই। তাঁরা প্রধান চার ধরনের ডেঙ্গির সাব-টাইপ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছেন, চতুর্থ সাবটাইপ বা হেমারেজিক ডেঙ্গিতে ঝুঁকি সব চেয়ে বেশি। তাঁর মতে ডেঙ্গি ও চিকুনগুনিয়া থেকে এনসেফ্যালাইটিসের আক্রমণও হতে পারে। এ ছাড়া, গলা-বুকে সংক্রমণ ও হারপিসের কারণও কোনও না কোনও ভাইরাস।

স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা পতঙ্গবিদ অমিয় কুমার হাটি বলেন, ‘‘গলাব্যথা, পাতলা পায়খানা, পেটব্যথা নিয়ে অনেকে আসছেন। পরে পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে তাঁদের ডেঙ্গি হয়েছে। কিন্তু এগুলি ডেঙ্গির সাধারণ উপসর্গ নয়।’’ চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারের অভিজ্ঞতা, ‘‘প্যাংক্রিয়াটাইটিস, হেপাটাইটিস বা কার্ডাইটিস-এর মতো অসুখ নিয়ে রোগী এসেছেন। পরীক্ষার পর দেখা গিয়েছে তাঁদের আসলে ডেঙ্গি হয়েছে। কিন্তু উপসর্গ ওই রকম।’’ চিকিৎসক ও পরজীবী বিশেষজ্ঞদের কথায়, ‘‘ভাইরাল জ্বর এ বছর অনেক দিন ধরে থাকছে, জ্বর চলাকালীন কারও কারও শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে, কারও আবার কফ জমে যাচ্ছে বুকে। কাশির দমকে তা উঠে আসছে।’’

এই ভাইরাস সংক্রমণই পুজোর কলকাতার নতুন বিপদ। কোনও ওষুধ নেই, কোনও প্রতিষেধক নেই। উপসর্গ দেখে চিকিৎসা করাই একমাত্র পথ।

soma mukhopadhyay parijat bandyopadhyay viral fever genetically modified virus kolkata life dangerous virus dengue virus new dengue virus new virus abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy