E-Paper

প্রতিরক্ষার বিকল্প পথ

কিছু কারণে শরীরে প্রতিষেধক কাজ না করলে বিকল্প উপায় কী হতে পারে?

সায়নী ঘটক

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:০৩

—প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।

আমাদের শরীরের সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে যে ভ্যাকসিন, তা বিভিন্ন কারণে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রতিষেধক নেওয়া থাকলেও রোগী বিপন্মুক্ত হন না পুরোপুরি। প্রাথমিক ও গৌণ কিছু কারণ রয়েছে, যার ফলে টিকা নেওয়া থাকলেও রোগ আক্রমণ করলে শরীরে তা কাজ করে না। এই কারণগুলি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

প্রাথমিক কারণ

প্রথমেই বুঝতে হবে, ভ্যাকসিন কী ভাবে কাজ করে। কোনও ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়ার একটি ছোট্ট অংশ শরীরে প্রবেশ করানো হয় ভ্যাকসিনের মাধ্যমে। এই অ্যান্টিজেন আমাদের দেহের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলে ও অ্যান্টিবডি তৈরি করে। পরবর্তী কালে যখন কোনও রোগ শরীরে আক্রমণ করে, সেই অ্যান্টিজেনকে আমাদের ইমিউন সিস্টেম শনাক্ত করতে পারে ও তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

কখন টিকা কাজ করে না?

টিকাকরণে কাজ না হওয়ার প্রাথমিক কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, দেহের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধসে পড়া। নানা কারণে তা হতে পারে। এগুলি হল—

  • কোনও কঠিন বা দীর্ঘকালীন অসুখে আক্রান্ত হওয়ার ফলে দেহের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবিটিস, ক্যানসার কিংবা কিডনির সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য।
  • দীর্ঘ সময় ধরে স্টেরয়েড নিলে সে ক্ষেত্রেও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কিছু প্রতিষেধক তার কার্যক্ষমতা হারায়। সেগুলিকে সময়মতো আবার নতুন করে না দিলে রোগী বিপন্ন হয়ে পড়ে।
  • ডায়ালিসিসের সময়ে দেহের অ্যান্টিবডি নষ্ট হতে পারে। সে ক্ষেত্রেও নতুন করে প্রতিষেধক নেওয়ার প্রয়োজন আছে।

সমাধান কী?

জেনারেল ফিজ়িশিয়ান সুবীর কুমার মণ্ডল এ প্রসঙ্গে জানালেন, কোনও রোগী যদি খুব বেশি দুর্বল হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন কাজ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয় না। ঝুঁকি এড়াতে তাঁদের ক্ষেত্রে যে অ্যান্টিবডি শরীর স্বাভাবিক ভাবে তৈরি করতে পারে না, তা-ই সরাসরি ভ্যাকসিন হিসেবে শরীরে প্রবেশ করানো হয়। ডা. মণ্ডলের কথায়, “ইমিউনো কনভার্শন ঠিক মতো কাজ না করলে আমরা ঝুঁকি নিই না। অ্যান্টিবডি সরাসরি প্রবেশ করালে সে ক্ষেত্রে শরীরের কোনও ভূমিকা থাকে না। খুব দুর্বল রোগীর ক্ষেত্রে যদি নন-ভিরুলেন্ট (খুব ক্ষতিকর নয় এমন) জার্মও প্রবেশ করানো হয়, তা হলে তা ক্ষতি করতে পারে। তাই সরাসরি অ্যান্টিবডি দেওয়াই একমাত্র সমাধান। তবে এঁদের ক্ষেত্রে লাইভ ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে না, ডেড ভ্যাকসিন দিতে হবে।” লাইভ ভ্যাকসিন বলতে ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়ার একটি দুর্বল অংশকে বোঝায়, যা শরীরে প্রতিষেধক হিসেবে প্রবেশ করলে দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা তৈরি করে। অন্য দিকে, ডেড ভ্যাকসিনের মাধ্যমে শরীরে কিছু নিষ্ক্রিয় প্যাথোজেন প্রবেশ করানো হয়, যা ইমিউন সিস্টেম শনাক্ত করে ও তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

এ প্রসঙ্গে ডা. মণ্ডল উল্লেখ করলেন হার্ড ইমিউনিটির কথা। যদি কোনও বিশেষ রোগের বিরুদ্ধে পুরো জনসমষ্টির প্রতিরোধ একসঙ্গে গড়ে ওঠে, সে ক্ষেত্রে যদি কিছু ব্যক্তির সেই রোগের টিকা না-ও নেওয়া থাকে, তা হলেও তাঁরা রোগে আক্রান্ত হবেন না। এ ক্ষেত্রে পোলিয়ো-র টিকার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। “পোলিয়ো-র ক্ষেত্রে যেমন ইনফেক্টিভ পোটেনশিয়াল অর্থাৎ সংক্রমণ প্রবণতা একেবারে শূন্য করে ফেলা হয়েছে। ল্যাবরেটরিতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চাষ করে করে ওর ভিরুলেন্সিটা (ক্ষতি করার প্রবণতা) একেবারে শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। এ বার নন-ভিরুলেন্ট স্ট্রেনটা আলাদা করে এনে বাচ্চাদের খাওয়ানো হয়। এর পরে শিশুদের শরীরে গিয়ে তা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে ও তাদের মলমূত্রের মাধ্যমে পরিবেশে গিয়ে মিশছে। হার্ড ইমিউনিটি এ ভাবেই তৈরি হচ্ছে,” বললেন ডা. মণ্ডল।

ভার্টিক্যাল ট্রান্সমিশন

যদি কোনও অন্তঃসত্ত্বাকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, কিছু ক্ষেত্রে গর্ভস্থ সন্তান প্লাসেন্টার মাধ্যমে সেই অ্যান্টিবডি পেয়ে যায়। জন্মের পরে মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমেও সন্তান অ্যান্টিবডি লাভ করে। সেই কারণেই শিশুর জন্মের পরে তৈরি হওয়া কোলোস্ট্রাম খাওয়ানোর উপরে জোর দেন চিকিৎসকেরা।

বড়দের টিকাকরণের সময়সূচি

ছোটদের সঙ্গে সঙ্গে এখন প্রাপ্তবয়স্কদের টিকাকরণের প্রয়োজন, যা সময়সূচি মেনে নিয়ে নেওয়া দরকার। বিশেষ করে শারীরিক ভাবে দুর্বল, এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সময় মতো টিকা নিয়ে নেওয়াই শ্রেয়। নির্দিষ্ট অসুখ না থাকলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাকসিন রিনিউ করা, বুস্টার ডোজ় নেওয়ার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, শিঙ্গলস ভ্যাকসিন সময়সূচি মেনে নেওয়া দরকার। যাঁদের কেমোথেরাপি চলছে, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবিটিসের জন্য ইনসুলিন নেন যাঁরা, সিওপিডি-র রোগী কিংবা অন্য কোনও জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিশেষ ভাবে এই শিডিউল মেনে চলতে হবে। বার বার ডায়ালিসিস করলে অ্যান্টিবডি নষ্ট হয়ে বেরিয়ে যায়। তাঁদেরও পুনরায় টিকাকরণ প্রয়োজন।

দামের ফারাক

সাধারণ প্রতিষেধক আর সরাসরি অ্যান্টিবডি ভ্যাকসিন আকারে দেওয়ার মধ্যে দামের ফারাক অনেকটাই। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, সাধারণ টিটেনাস টক্সয়েড ভ্যাকসিন যেখানে দশ টাকায় পাওয়া যায়, সেটারই অ্যান্টিবডি নিলে তার দাম পাঁচশো টাকার আশপাশে হতে পারে। অনেক সময়ে চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে অ্যান্টিবডি প্রবেশ করানোর পাশাপাশি অন্য হাতে টিটেনাস টিকাও দিয়ে দেওয়া হয়। এতে ভবিষ্যতে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে।

ভ্যাকসিন হল শরীরের প্রতিরক্ষার চাবিকাঠি। তাই তা সময়মতো নিয়ে নেওয়া, প্রতিষেধক শরীরে কাজ না করলে বিকল্প টিকাকরণের খোঁজ রাখা একান্ত প্রয়োজন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Vaccination Antibody Health Care Tips

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy