ঘুম থেকে উঠতেই সঙ্গী হাজির চায়ের ট্রে নিয়ে। নিয়ম করে সপ্তাহে এক কিংবা একাধিক দিন টেডি, চকলেট বা অন্য কোনও দামি উপহার দিচ্ছে। রেস্তরাঁ, কাফেতে গেলে দরজা খুলে দেওয়া, চেয়ার টেনে দেওয়া, অর্ডার করার দায়িত্বও নিজের কাঁধেই নেয় সে। আর বিল? সঙ্গিনীর সে দিকে তাকানোর প্রয়োজনও পড়ে না। অনেকেই ভাবেন, প্রেমিকার প্রতি এমন আচরণ সিনেমা বা রূপকথাতেই দেখা যায়। তা কিন্তু নয়। আধুনিক প্রজন্ম ‘প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট’ নিয়ে বেশ উৎসাহী। আশপাশেও এই ট্রেন্ড নজরে পড়বে।
বছর ৩৭-এর ইনফ্লুয়েন্সার কার্টনি পামারের ভিডিয়োর জেরেই কার্যত ভাইরাল প্রিন্সেস ট্রিটমেন্টের বিষয়টি। কার্টনির মতে, তিনি রেস্তরাঁয় গেলে কোনও দিন দরজা নিজে খোলেন না, খাবারের অর্ডারও দেন না। ঘর-সংসার সামলে বাইরেও যদি তাঁকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তা হলে তাঁর স্বামী কী করতে আছেন! তাঁর স্বামী এই সব কিছু করে দেওয়ায় যেন তাঁর নারীত্বেরই জয় হয়। শুধু কার্টনি নয়, এ প্রজন্মের অনেকের মতে, সঙ্গী পুরুষটি যদি তার সব কিছুর খেয়াল না রাখে, উপহারের পাহাড় না হাজির করে, সব খরচ না বহন করে, তা হলে সেই সম্পর্কে থাকা অর্থহীন।
‘প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট’-এর ঠিক উল্টো দিকে রয়েছে ‘বেয়ার মিনিমাম’। এর অর্থ হল, প্রেমিকাকে সম্মান করা এবং প্রয়োজনে পাশে থাকা। অতিরিক্ত যত্নআত্তি এখানে গুরুত্ব পায় না। এর উল্টো দিকে রয়েছে প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট। তবে পার্টনারের প্রতি ঠিক কতটা যত্নবান হলে সেটাকে প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট বলা যায়, তা নিয়ে নানা জনের নানা মত। একাংশের কাছে এর অর্থ হল, সঙ্গিনীর প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগী হওয়া, নিয়মিত দামি উপহার দেওয়া, জনসমক্ষে ভালবাসা প্রকাশ... রাজকুমারীরা যেমন প্রাচুর্য আর বিলাসিতার মধ্যে জীবনযাপন করতেন, প্রেমিকাকে সেই অভিজ্ঞতা দেওয়া। চার দিকে গার্হস্থ হিংসা, নারীবিদ্বেষের ঘটনার মধ্যে এই যত্ন নেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখাই ভাল।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষক নবমিতা দাস বলছেন, “কোনও নারীকে যদি তাঁর সঙ্গী নিরাপদ, সুরক্ষিত ভাবে রাখতে চান, তাতে খারাপ কিছু নেই। বিশেষত সেই মহিলাদের জন্য যাঁরা সঙ্গীর মধ্যে অভিভাবকের ভূমিকা পছন্দ করেন।” জেন জ়ি-র একাংশের মতেও, ‘আলফা মেল’ বা ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’র চেয়ে এমন পুরুষ ঢের ভাল যে, তার সঙ্গিনীকে মাথায় করে রাখে। কিন্তু অতিরিক্ত বাহুল্যও কি ভাল?
এখানে বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, এই আতিশয্যে লাভ কার? মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মীনাক্ষী খুরানার মতে, ব্যক্তিগত পরিসরে কে কেমন ভাবে থাকতে চান, তা নিয়ে অন্য কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট বিষয়টাই মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় ধারণার প্রতীক। বর্তমানে যেখানে নারী পুরুষতন্ত্রের শিকল ভেঙে নিজ
নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন, অর্থ উপার্জন করছেন— সেখানে এই ধারণা সমাজকে আরও পিছিয়ে
দেয়। অনেকে হোমমেকারই থাকতে চান, তাঁর সেই ইচ্ছেকেও মর্যাদা দেওয়া দরকার। কিন্তু ঝোঁকের বশে কোনও ট্রেন্ডের শরিক হতে গেলেই বিপত্তি বাধছে।
খেয়াল রাখতে হবে, নিজেকে রাজকন্যা ভাবতে গিয়ে নিজস্ব ব্য়ক্তিত্বের সঙ্গে আপস করা হচ্ছে না তো? প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট পেতে গেলে যে পুরুষ সঙ্গীটিকে সারাক্ষণ সন্তুষ্ট রাখতে হবে, কার্যত ‘প্রিন্স’ কিংবা ‘কিং ট্রিটমেন্ট’ দিতে হবে নেটমাধ্যমে সে কথা বোঝাচ্ছে বিতর্কিত ‘ট্র্যাডওয়াইফ’ অর্থাৎ বৈবাহিক জীবনে মধ্যযুগীয় আদর্শে বিশ্বাসী নারীরা। এই ট্র্যাডওয়াইফদের মতে, এক জন পুরুষের কাছ থেকে তখনই রাজকীয় আচরণ আশা করা যায়, যখন নারী তার সঙ্গীর ‘কর্তৃত্ব’ স্বীকার করে। অন্দরমহলে পুরুষটির কথা মতোই নারীকে সব কিছু করতে হয়। সর্বক্ষণ পুরুষটির যত্ন করতে হয়। এ ছাড়াও ধীরে ধীরে কথা বলা, সুন্দর করে সেজে থাকার মতো শর্তও রয়েছে। অর্থাৎ সুন্দর, প্রতিবাদহীন নারীই প্রিন্সেস ট্রিটমেন্টের যোগ্য! এতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ফাঁদেই পড়তে হচ্ছে নারীকে।
নবমিতার কথায়, “প্রিন্সেস ট্রিটমেন্টের মধ্যে পুঁজির একটা নিজস্ব প্রকল্পও লুকিয়ে আছে। কারণ, বস্তুগত সুবিধা হাজির করা, দামি উপহার দেওয়া বা বড় রেস্তরাঁয় নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে একমাত্র ভোক্তা-সংস্কৃতিতেই পৌরুষের অবস্থান, এমন একটি ধারণা তৈরি হচ্ছে। আর তার ফলে আদতে ‘প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট’-এর মাধ্যমে পুঁজিরই বিস্তার ঘটছে। তাই এই প্রবণতায় এক জন স্বামীর মাধ্যমে আর এক জন নতুন উপভোক্তাও তৈরি হচ্ছে।”
একটি সুস্থ সম্পর্কের জন্য প্রয়োজন সঙ্গীর সঙ্গে মনের মিল এবং পারস্পরিক সম্মান ও ভালবাসা। এ ধরনের ট্রেন্ড সেই সমীকরণকেই বিপন্ন করে তোলে। নারীর উপরে যেমন ‘আদর্শ’ সঙ্গিনী হয়ে ওঠার চাপ তৈরি হয়, ঠিক তেমনই পুরুষ সঙ্গীটিকেও ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে চাপে পড়তে হয়।
মীনাক্ষীর মতে, কোনও ট্রেন্ড যেমন ভাবে ঝড় তোলে, তেমনই ঝড়ের গতিতে চলেও যায়। আসলে প্রিন্সেস ট্রিটমেন্টের আক্ষরিক অনুবাদের বদলে বাস্তবসম্মত উপায় বার করা যায়, যেখানে নারী-পুরুষ লিঙ্গসাম্যের প্রয়োজনীয়তা বুঝবে।
ছবি: সর্বজিৎ সেন; মডেল: মন্দিরা দেবনাথ, সত্যব্রত মণ্ডল; মেকআপ ও হেয়ার: সোহরাব আলি; পোশাক (মন্দিরা): জুয়েল থিফ বাই সৌমালিনী বিশ্বাস; পোশাক (সত্যব্রত): ফিউশন টেলস বাই সুজিত চক্রবর্তী; লোকেশন: উষাবতী
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)