E-Paper

জীবনযাপনের ধরন বদলে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য রক্ষায় নজর দেওয়ার বার্তা

অ্যালঝাইমার’স, অর্থাৎ মস্তিষ্কের ক্ষয়ের এই অসুখ হলে সারে না। তবে, এই রোগের গতিতে রাশ টানার মন্ত্র নিয়ে চর্চা করে চলেছেন চিকিৎসকেরা।

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:১৩
representational image

—প্রতীকী ছবি।

রাতে ঘুম হয় না। এ দিকে, কাজের সময়ে চোখ বুজে আসে। ঘুমের ওষুধ খাওয়ার আগে চেষ্টা করেছেন কি ‘স্লিপ হাইজিন’ মানতে? কিংবা, দিনের এক-তৃতীয়াংশ একটানা ঘুমের জন্য বরাদ্দ করছেন কি? কারণ, ঘুমের ব্যাঘাতে হতে পারে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ। বর্তমানে যা দ্রুত হারে ছড়াচ্ছে। অ্যালঝাইমার’সও হল এক ধরনের স্মৃতিভ্রংশের অসুখ। এই রোগ ভুলিয়ে দেয় মানুষের দীর্ঘদিনের অধ্যবসায়ে অর্জিত জ্ঞান বা জীবনের ন্যূনতম পাঠ।

অ্যালঝাইমার’স, অর্থাৎ মস্তিষ্কের ক্ষয়ের এই অসুখ হলে সারে না। তবে, এই রোগের গতিতে রাশ টানার মন্ত্র নিয়ে চর্চা করে চলেছেন চিকিৎসকেরা। রোগটির সচেতনতায় সেপ্টেম্বর মাসকে ‘বিশ্ব অ্যালঝাইমার’স মাস’ হিসেবে পালন করা হয়। ‘অ্যালঝাইমার’স ডিজ়িজ় ইন্টারন্যাশনাল’ চলতি বছরে তাদের প্রচারের শিরোনাম রেখেছে ‘নেভার টু আর্লি, নেভার টু লেট’। ‘অ্যালঝাইমার’স অ্যান্ড রিলেটেড ডিজ়অর্ডার্স সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’ (এআরডিএসআই)-র কলকাতা শাখা সেই প্রচার- বার্তাকেই সামনে রেখে রোগের ঝুঁকি এবং প্রাথমিক পর্যায়ে তাকে আটকে রাখার বিষয়ে রবিবার এক আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছিল। যেখানে রোগীদের উপস্থিতিতে অংশ নেন চিকিৎসকেরা।

সমীক্ষা বলছে, ভারতে ষাটোর্ধ্বদের মধ্যে ৮৮ লক্ষ নাগরিক ডিমেনশিয়া নিয়ে বেঁচে আছেন। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এবং গ্রামীণ এলাকায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। যার একটি কারণ, রোগ নিয়ে সচেতনতার অভাব এবং অবহেলা। এ দিন চিকিৎসকদের আলোচনায় উঠে আসে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রসঙ্গও। তাঁরা জানাচ্ছেন, ৪০ বছরের পর থেকে বছরে এক বার বা দু’বছর অন্তর মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতার পরীক্ষা করিয়ে নিলে আগাম সতর্ক থাকা যায়।

চিকিৎসকদের আশঙ্কা, ২০৫০ সালের মধ্যে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন বর্তমানের প্রায় তিন গুণ বেশি মানুষ। চিন ও ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশের বর্তমান কর্মক্ষম প্রজন্মকে যাতে বার্ধক্যে গিয়ে সামাজিক বোঝা না হতে হয়, সেই লক্ষ্যে পথ চলার কথা বললেন স্নায়ুরোগ চিকিৎসক অতনু বিশ্বাস।

ডিমেনশিয়া স্মৃতিভ্রংশ ঠিকই। তবে অতনুর কথায়, সব ভুলে যাওয়া কিন্তু আতঙ্কের নয়। প্রাত্যহিক ভুল আর রোগের ভুলের সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। চাবি রেখে ভুলে যাওয়া, কারও নাম ভুলে যাওয়া, কোনও জিনিস আনতে গিয়ে ভুলে যাওয়া— রোজকার জীবনে ইঁদুর দৌড়ের ফল। কিন্তু, চেনা রাস্তা ভুল করলে, বাজারে গিয়ে হিসাব জানা মানুষটির তা মেলাতে অসুবিধা হলে, চেক লিখতে ভুলে গেলে, ঘরের চৌহদ্দিতে দিক ভুল করলে সে সবই ক্লাসিক ভুল বা এপিসোডিক ভুল, যা অ্যালঝাইমার’স-এর ইঙ্গিত।

মনোরোগ চিকিৎসক সত্যজিৎ আশের মতে, তীব্র মানসিক চাপ তত আশঙ্কার নয়, যতটা দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা মানসিক চাপ। কারণ, সেই মানসিক চাপ থেকেই মস্তিষ্কের জটিল অংশ হিপ্পোক্যাম্পাসের ক্ষয় শুরু। যা স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যাহত করে। সত্যজিৎ জানাচ্ছেন, দীর্ঘদিনের উদ্বেগ ও অবসাদ থেকে আসতে পারে ডিমেনশিয়া। এই দু’টি উপসর্গ মস্তিষ্কের গঠনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। তাই, নেতিবাচক চিন্তা নয়।

ঘুম না হওয়ার সমস্যা নিয়ে আসা রোগীকে ওষুধ দিয়ে ঘুম আনার ক্ষতিকর দিকের কথা বলেন স্নায়ুরোগ চিকিৎসক অমিতাভ ঘোষ। তাঁর মতে, ঘুমের ওষুধ না খেয়ে বরং যথাযথ পরিবেশ তৈরি বাঞ্ছনীয়। আলো নিভিয়ে নিঃশব্দ করতে হবে ঘর। তাড়াতাড়ি শুতে যাওয়া ও তাড়াতাড়ি ওঠার অভ্যাস, শ্বাসের ব্যায়াম, মোবাইল বা ল্যাপটপের ব্যবহার বন্ধ করে টানা ঘুম জরুরি। এগুলিই মিলিত ভাবে ‘স্লিপ হাইজিন’। ওষুধে নির্ভরশীল হলে ঘন ঘন পড়ে যাবেন রোগী। সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা পরিকল্পনা নেওয়ার ক্ষমতা কমবে। মদ্যপান, ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস, স্থূলতায় রয়েছে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি।

জেরিয়াট্রিক (বার্ধক্যজনিত) মেডিসিনের চিকিৎসক পি কে পুভিয়ার পরামর্শ, শরীর ও মনের ব্যবহার কমলে তাদের কর্মক্ষমতা কমবে। তখন রোগের ঝুঁকি বাড়বেই। তাই অবসর জীবনে পছন্দের কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে। নতুন কিছু শেখা, সামাজিক মেলামেশা, হাঁটা ও শারীরচর্চা করতে হবে। শরীর ও মনের ক্রমাগত ব্যবহারে ডিমেনশিয়ার গতি ধীর করা সম্ভব।

এ দিন যার উজ্জ্বল প্রমাণ রাখলেন এআরডিএসআই-এর ছত্রচ্ছায়ায় থাকা, অশীতিপর ছবিনাথ মণ্ডল। অনুষ্ঠানের শুরুতে তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণে ধ্বনিত হল রবিঠাকুরের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। আবৃত্তির শেষে করতালিতে যখন মুখরিত সভাকক্ষ, অনেককেই দেখা গেল চোখ মুছতে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Dementia Sleep Disorder

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy