Advertisement
E-Paper

ইমিউনিটি কতটা জরুরি?

সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ‘ইমিউনিটি’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত প্রায় সকলেই। কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ালেই কি করোনাকে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব? জেনে নিনইমিউনিটি কখন জরুরি আর কতটা জরুরি, সেটা আগে জানতে হবে, বুঝতে হবে।

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২০ ০১:২১

বছর সাতাশের অর্ক রোজ জিমে যায়। ডায়াটিশিয়ানের পরামর্শ মেনে ডায়েটও মেনে চলে সে। কাঁচা হলুদ থেকে শুরু করে মুসাম্বিও থাকে রোজের খাদ্যতালিকায়। সম্প্রতি তাঁর করোনা টেস্ট রিপোর্ট পজ়িটিভ আসায় বাড়ির সকলেই অবাক। ইমিউনিটি থাকতেও করোনা হল কী করে?

এরকম উদাহরণ কম নেই। ওষুধের দোকান বা অনলাইন মার্কেট... সর্বত্রই বিকোচ্ছে ইমিউনিটি বুস্টার। খাদ্যতালিকাও সাজানো হচ্ছে ইমিউনিটি বর্ধক খাবারে। কিন্তু সেগুলো কি করোনা প্রতিরোধে ১০০ শতাংশ কার্যকর? ইমিউনিটি কখন জরুরি আর কতটা জরুরি, সেটা আগে জানতে হবে, বুঝতে হবে।

ধরুন, একটা যুদ্ধ চলছে। অস্ত্রশস্ত্র, সেনা নিয়ে দুই পক্ষ যুদ্ধে নামল। কিন্তু জয়লাভ তো কোনও এক পক্ষই করবে। তা হলে কি অস্ত্রের দরকার নেই? আছে। কিন্তু সেটাই যুদ্ধের পরিণতি স্থির করবে না। এ ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সে রকমই। এক দিকে রয়েছেন রোগী, তার হাতে অস্ত্র ইমিউনিটি। প্রতিপক্ষ করোনা, তার অস্ত্র অ্যান্টিজেন। ইমিউনিটি আছে বলেই সে ১০০ শতাংশ সুরক্ষিত নয়। তা হলে ইমিউনিটি কেন জরুরি? তা বোঝার জন্য তার কাজের প্রক্রিয়া জানতে হবে।

ইমিউনিটি কী ভাবে কাজ করে?

মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘করোনাভাইরাস বা অন্য কোনও ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলেই আমাদের শরীর সতর্ক হয়ে যায়। তখন সেই অ্যান্টিজেনকে বাধা দিতে শরীর অ্যান্টিবডি উৎপাদন করে। তখন অ্যান্টিবডি লড়াই করে অ্যান্টিজেনকে মেরে ফেলে। কিন্তু অনেক অসুখের অ্যান্টিবডি শরীরে না-ও থাকতে পারে। কোনও ইনফেকশন হলে তা আমাদের শরীরের মেমরি সেল মনে করে রেখে দেয়। তাই ফরেন প্রোটিন শরীরে প্রবেশ করা মাত্র সে সতর্ক হয়ে যায়। ধরুন, কেউ ছোটবেলায় কোনও অসুখের টিকা নিয়েছিলেন বা অসুখটি খুব ছোটবেলায় হয়ে গিয়েছে। অনেক বছর পরে পরিণত বয়সে সেই ভাইরাস আবার আপনার শরীরকে আক্রমণ করলে, শরীরের মেমরি সেল তাকে চিনে ফেলে। তখন মেমরি সেল এমন সিগন্যাল দিতে শুরু করে যে, দশটা মেমরি সেল থেকে হাজারটা সেল তৈরি করে ফেলে। সে চিনে যায় শরীরের পুরনো শত্রুকে। তৎপর হয়ে সেই ভাইরাসের মোকাবিলা করে।’’

ইমিউনিটির ধরন

সাধারণত মানুষ কিছু ইমিউনিটি নিয়েই জন্মায়। একে বলে ইনেট ইমিউনিটি। আর প্রকৃতিতে থাকতে থাকতে অর্জন করে অ্যাডাপ্টিভ ইমিউনিটি। এই ইমিউনিটিও দু’ভাগে বিভক্ত। একটা হল ন্যাচারালি অ্যাকোয়ার্ড। পরিবেশে থাকতে থাকতে বিভিন্ন ভাইরাসের বিপক্ষে শরীর অনাক্রম্যতা তৈরি করে। একে বলে ন্যাচারালি অ্যাকোয়ার্ড অ্যাডাপ্টিভ ইমিউনিটি। অন্যটি হল আর্টিফিশিয়ালি অ্যাকোয়ারড বা কৃত্রিম ইমিউনিটি। এ ক্ষেত্রে সেই রোগের ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রয়োজন হয়। এরাও আবার অ্যাক্টিভ ও প্যাসিভ এই দু’টি ভাগে বিভক্ত। ইমিউনিটি সক্রিয় হলে তা সারাজীবন সুরক্ষা দিতে পারে। আর প্যাসিভ হলে কয়েক মাসের ব্যবধানে ইমিউনিটি বুস্টার ডোজ়ের প্রয়োজন পড়ে।

করোনার মোকাবিলায় ইমিউনিটি কতটা কার্যকর?

এ বার প্রশ্ন হল, একজন মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তপোক্ত হলেই কি সে করোনাকে জয় করতে সক্ষম? অন্য কোনও ভাইরাস তাঁকে আক্রমণ করবে না? পালমোনালজিস্ট ও ক্রিটিকাল কেয়ার স্পেশ্যালিস্ট ডা. অনির্বাণ নিয়োগী বললেন, ‘‘প্রত্যেকটি ব্যাকটিরিয়া ও ভাইরাসের বিপক্ষে শরীরে ইমিউনিটি তৈরি হয়। একটি সেল-মেডিয়েটেড ইমিউনিটি। এ ক্ষেত্রে ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে লিম্ফোসাইটস। আর এক ধরনের ইমিউনিটি পাওয়া যায় অ্যান্টিবডির মাধ্যমে। কিন্তু করোনা ভাইরাস নতুন। আমাদের শরীরের মেমরি সেলে এর ইমিউনিটি নেই। আর শরীরে কোনও অ্যান্টিবডিও নেই। কারণ এটা তো আগে হয়নি। ফলে রোগীর শরীরে করোনা প্রবেশ করায় নানা ইনফেকশন ও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। আর একটি বিষয় দেখা যাচ্ছে, অনেক রোগীর (বিশেষত ৩০-৬০ বয়সে) শরীরে অতিরিক্ত মাত্রায় ইন্টারলিউকিন বেরোচ্ছে। এতে মানুষের শরীরে এত বেশি ইমিউন রেসপন্স হচ্ছে যে, সাইটোকাইন স্টর্ম হয়ে সমস্যা আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। করোনা মারতে গিয়ে সে নিজের শরীরের ক্ষতি করে ফেলছে। লাং, কিডনি, লিভার, ব্রেন ড্যামেজ করছে। তখন লাইফ সাপোর্টে রাখতে হচ্ছে রোগীকে।’’

এ বিষয়ে জেনারেল ফিজিশিয়ান ডা. সুবীর কুমার মণ্ডলও সহমত। তাঁর কথায়, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একজন করোনা পজ়িটিভ রোগী ভর্তি হয়েছেন, যাঁর রোগ প্রতিরোধ শক্তি বেশ ভালই। ভাইরাস দমনে সেই ইমিউন রেসপন্স বেড়ে যাচ্ছে। ইন্টারলিউকিন, ফেরিটিন ইত্যাদি ইমিউন মার্কার এতটাই বেড়ে যাচ্ছে যে, পাল্স রেট বাড়ছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে অর্থাৎ ট্যাকি কার্ডিয়াক হচ্ছে। তখন ইমিউন রেসপন্স কমানোর জন্য ওষুধ ব্যবহার করে রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই জন্য অটো ইমিউন ডিজ়িজ় আগে বুঝতে হবে, যেখানে আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেম আমাদের অঙ্গগুলিকে চিনতে না পেরে শরীরের ক্ষতি করে ফেলে। যেমন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। সে ক্ষেত্রে যেমন ইমিউন রেসপন্স কমিয়ে চিকিৎসা করা হয়, এ ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই।’’ সুতরাং ইমিউনিটি থাকলেও করোনা বা ভাইরাসবাহিত অসুখ প্রতিরোধে সে একটি ফ্যাক্টর মাত্র, একমাত্র ফ্যাক্টর নয়। রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলতে হবে রোগকে দূরে রাখতে। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হলে ইনফ্ল্যামেটরি ইমিউন রেসপন্স বেড়ে যাওয়ার মতো চিন্তার বিষয়ও কিন্তু থাকছে।

অন্য বিপদ বাড়ছে না তো?

ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য অনেকেই বেশি পরিমাণে পাতিলেবু, মুসাম্বি, কাঁচা হলুদ খেতে শুরু করেছেন। এ প্রসঙ্গে ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল বললেন, ‘‘অনেকের ধারণা, বেশি করে ভিটামিন সি খেলেই তিনি সুরক্ষিত। কিন্তু একজন কিডনির অসুখে আক্রান্ত রোগী যদি রোজ বেশি পরিমাণে পাতিলেবুর রস খেতে শুরু করেন, তাঁর শরীরে পটাশিয়াম লেভেল বেড়ে গিয়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার সম্ভাবনা পর্যন্ত থাকে। ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্টও অনেকে খাচ্ছেন। কিন্তু শরীরে ভিটামিন ডি-র অভাব রয়েছে কি না, তা হয়তো জানেন না। শরীরে ভিটামিন ডি একটা সীমা ছাড়িয়ে গেলে, তা কিন্তু টক্সিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কোনও ল্যাব থেকে ভিটামিন ডি টেস্ট করালে দেখবেন, সীমা দেওয়া থাকে। ঊর্ধ্বসীমা পেরোলেই তা টক্সিক বলে চিহ্নিত করা থাকে।’’ অতিরিক্ত কাঁচা হলুদ খেলেও ডায়রিয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই কী খাচ্ছেন, কেন খাচ্ছেন, তা আদৌ দরকার কি না, তা বুঝে খান। না হলে একটা অসুখের মোকাবিলা করতে গিয়ে অন্য বিপদ হতে পারে। বরং চিকিৎসকদের মতে, করোনার মোকাবিলায় ফুসফুসের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। তার জন্য জরুরি ব্রিদিং এক্সারসাইজ়। নিয়মিত প্রাণায়াম করতে পারেন। গানও গাইতে পারেন। গান গাইলেও ব্রিদিং এক্সারসাইজ় হয়। এ ছাড়া দূরত্ব বজায় রেখে, মাস্ক পরে, সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে।

রোজই বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়ার সম্মুখীন হই সকলে। শরীর নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় তার সঙ্গে যুঝতেও সক্ষম। তাই ইমিউনিটি হেলাফেলার নয়, তা জরুরিও বটে! কিন্তু ইমিউনিটি নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা মনে বাসা বাঁধতে দেবেন না। একটা অসুখের হাত থেকে বাঁচতে অন্য বিপদে যেন পড়তে না হয়! ইমিউনিটিকে ব্যবহার করুন বর্মের মতো। কিন্তু মনে রাখুন, তার সঙ্গে মাস্ক, স্যানিটাইজ়ারের মতো অন্যান্য অস্ত্রও সমান প্রয়োজন।

Immunity Coronavirus
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy