Advertisement
E-Paper

কেন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে বাঘ? আটকানোর পথই বা কী? বাঘে-মানুষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই বাঁচাবে বহু প্রাণ

বিশ্বের মোট বাঘের ৭০ শতাংশেরই আবাসস্থল এখন ভারত। সংখ্যার হিসেবে যা ৩,৭০০-রও বেশি। বছরের পর বছর ধরে বাঘ সংরক্ষণেরই সুফল বলা যায় একে।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২৫ ১৩:৩৬
India now shelters over 70 percent of the world’s tigers, more than 3,700, a milestone achieved through decades of conservation

বাঘও বাড়বে, মানুষের সঙ্গে সংঘাতও কমবে, উপায় কী? ছবি: ‘ফুডপ্রেনর’ এবং ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফার শিলাদিত্য চৌধুরীর সংগ্রহ থেকে।

জ়িনতের বাংলা অভিযান, মৈপীঠের গ্রামরাস্তায় দক্ষিণ রায়ের বারংবার আনাগোনা, ওয়েনাড়ে মানুষখেকোর আবির্ভাব— গ্রামে বা লোকালয়ে ‘বাঘ পড়া’র ঘনঘটার কাছে রোমাঞ্চকর গল্পও ফিকে। বন দফতর বলে, বাঘের সংখ্যা বেড়েছে দেশে, তাই দেখাও মিলছে ঘন ঘন, বাঘ নিয়ে গল্পও বাড়ছে। বিশ্বের মোট বাঘের ৭০ শতাংশেরই আবাসস্থল এখন ভারত। সংখ্যার হিসেবে যা ৩,৭০০-রও বেশি। বছরের পর বছর ধরে বাঘ সংরক্ষণেরই সুফল বলা যায় একে। তবে বাঘের বাড়বৃদ্ধিতে বন দফতেরর মুখে যতই হাসি ফুটুক না কেন, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাঘে-মানুষে সংঘাতের ঘটনাও। অথচ দুইয়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্রের জন্য জরুরি। এখানে আরও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। গত পাঁচ বছরে এক মাসে সর্বাধিক বাঘের মৃত্যুর রেকর্ড গড়েছে ২০২৫-এর জানুয়ারি। ২৪টি রয়্যাল বেঙ্গলের শব মিলেছে বছরের প্রথম মাসে। বাঘসংখ্যা বাড়লে মৃত্যুর পরিসংখ্যানও বাড়বে। তা ঠেকানোর উপায়? কী ভাবে মানুষ ও বাঘের দ্বন্দ্ব মেটানো যায়, সে নিয়ে আলোচনায় উঠে এল নানা তথ্য।

বাঘ সংরক্ষণ নিয়ে সচেতনতার প্রচার চলেই। সম্প্রতি একটি আলোচনাসভা ও ছবির প্রদর্শনী হল এ নিয়ে। নেপথ্যে ছিলেন ‘ফুডপ্রেনর’ এবং ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফার শিলাদিত্য চৌধুরী। আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠানের নাম ‘লর্ড অফ দ্য জাঙ্গল’। বাঘ সংরক্ষণের নানা পদ্ধতি নিয়ে বার্তা রাখেন জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া–র (জ়েডএসআই) অধিকর্তা ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায়, মহারাষ্ট্রের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মুখ্য বনপাল সুনীল লিমায়ে এবং বাংলার প্রাক্তন মুখ্য বনপাল প্রদীপ ব্যাস। হলদে-ডোরাকাটার নানা মেজাজের প্রায় ৩৬টি ছবি দেখান শিলাদিত্য। বলেন, “বন থেকে বেরোনোর কারণে মানুষ ও সভ্যতার সঙ্গে সংঘাতে বাঘের মৃত্যু ঘটছে। উদ্বেগের বিষয়টি হল, বাঘেদের মৃত্যুতে মানব-ঘটিত কারণ বাড়ছে। মানুষ ও বাঘকে একযোগে রক্ষার দায়িত্বই আসল। পন্থা এমন হবে, যাতে বাঘের বিচরণের ক্ষেত্রটিও নিরাপদ হয় এবং সেখানে যেন মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি দ্বন্দ্বেও না পড়তে হয় তাদের।”

‘ফুডপ্রেনর’ এবং ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফার শিলাদিত্য চৌধুরীর ছবির প্রদর্শনী থেকে।

‘ফুডপ্রেনর’ এবং ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফার শিলাদিত্য চৌধুরীর ছবির প্রদর্শনী থেকে।

গত তিন দশকের নিয়ম মেনে, প্রতি সাড়ে তিন বছর অন্তর দেশ জুড়ে বাঘশুমারির পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করছে, বাঘের সংখ্যাবৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প এলাকাও তার ব্যতিক্রম নয়। ১৯৭৩-এ কেন্দ্রীয় সরকার ‘প্রোজেক্ট টাইগার’ হাতে নেয়। প্রকল্পের শুরুতে বাঘের সংখ্যা ছিল ১৮২৭, এখন তা বেড়ে ৩৭০০-রও বেশি। কেন্দ্রীয় গণনার পাশাপাশি সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের তরফেও প্রতি বছর নিজেদের মতো করে একই ভাবে জঙ্গলে ক্যামেরা বসিয়ে এলাকায় বাঘের পরিসংখ্যান নেওয়া হয়। এখন অনেক নিত্যনতুন প্রযুক্তি চলে এসেছে। এই ব্যাপারে আলোকপাত করলেন বাংলার প্রাক্তন মুখ্য বনপাল প্রদীপ ব্যাস। দীর্ঘ সময় বক্সা জাতীয় উদ্যানের ফিল্ড ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব সামলেছেন। বাঘেদের মতিগতি বুঝেছেন কাছ থেকে। তিনি বলেন, “এখন তিন পদ্ধতিতে বাঘ গণনা করা হয়। জঙ্গলে বসানো হয় সিসিটিভি ক্যামেরা, ড্রোন ক্যামেরায় শুধু বাঘ নয়, চোরাশিকারিদের উৎপাত হচ্ছে কি না, তা-ও বোঝা যায়। সেই সঙ্গেই ব্যবহার করা হয় স্যাটেলাইট ক্যামেরা। একে বলে স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং পদ্ধতি, যা বাঘের সংখ্যা গোনা, তাদের গতিবিধি দেখা ও বাঘেদের অন্দরমহলে ঢুকে তাদের সংসারে নজর রাখতেও কাজে আসে।”

ছবির প্রদর্শনীতে শিলাদিত্য চৌধুরী, অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরী ও জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া–র অধিকর্তা ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায়।

ছবির প্রদর্শনীতে শিলাদিত্য চৌধুরী, অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরী ও জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া–র অধিকর্তা ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাঘ নিয়ে ভয় যেমন আছে, তেমনই কৌতুহলও। সুন্দরবনে ঘুরতে গিয়ে বাঘের দেখা না পেলে মনখারাপ হয়ই। বাঘ দেখার অদম্য কৌতূহল যতটা, তাদের বাঁচানোর তাগিদ বোধ হয় তার চেয়েও কম। জঙ্গলের বাঘ বিচরণেই বেরোবেই। একে বলে ‘টাইগার ডিসপারজ়াল’। জ়িনতের মতো কেউ দূরভ্রমণে পাড়ি দেবেই। এটাই তাদের সহজাত প্রবৃত্তি। প্রদীপবাবু জানান, বাঘ এলাকা ছেড়ে অন্য জঙ্গলে সঙ্গিনী খোঁজে। সেখানকার বাঘের সঙ্গে লড়াই হয়, এবং তার জেরে বাঘের মৃত্যু হয়। আবার আবাসস্থল খোঁজার তাগিদও থাকে। কমবয়স্ক বাঘ বা বা বাঘিনী পূর্ণবয়স্কদের সঙ্গে লড়াইয়ে এঁটে উঠতে পারে না। তাই তারা ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য আস্তানার খোঁজে যায়। এই যাত্রাপথেই সংঘাত হয় মানুষের সঙ্গে। ফলে বিপদ বাড়ে উভয়েরই। খেতখামারে বনশূকরকে ঠেকাতে বৈদ্যুতিক বেড়া দেন কৃষকেরা। বাঘ এলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তাদের মৃত্যু হয়। জঙ্গল ছেড়ে বেরোনো বাঘ ভুলবশত লোকালয়ে ঢুকলে, সেখানে পিটিয়ে মারার প্রবণতাও বাড়ে। তাই বাঘের এই যাত্রাপথ নিরাপদ করাটাই প্রধান কর্তব্য।

বাঘেদের বিচরণভূমির প্রায় ৪৫ শতাংশেই মানুষ থাকে বা তার গতিবিধি রয়েছে। তাই সংরক্ষিত এলাকার বাইরেও বাঘের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বাঘকে শত্রু ভাবা, পিটিয়ে মারা, বিষ দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে জঙ্গল সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের। সে জন্য সচেতনতার পাঠ দেওয়া জরুরি। বৈদ্যুতিক বেড়ার ভোল্টেজ-সীমা নির্দিষ্ট থাকুক, পশু চমকালেই যথেষ্ট, প্রাণঘাতী যেন না হয়। জীববৈচিত্র ঠিক রাখতে, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে স্থানীয় মানুষের যোগদান জরুরি। সংরক্ষিত এলাকাগুলিতে বাঘের আলাদা বিচরণক্ষেত্রে ঠিক করতেই হবে। যেখানে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সহাবস্থান সম্ভব নয়, সেখানে অধিবাসীদের নিয়ে পুনর্বাসন প্রকল্প তৈরি ও তার সঠিক প্রয়োগ করা দরকার। তা হলেই বাঘে-মানুষে ঘাত-প্রতিঘাত অনেক কমে যাবে।

Tiger Conservation Tiger Count
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy