E-Paper

প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে আসে পাখি

শীত-বসন্ত জুড়ে চলবে পাখি দেখার উৎসব! এর মধ্যে আছে এক অকৃত্রিম আনন্দ। তবে পাখিদেখিয়েরা সারা বছরই মেতে থাকেন এ কাজে।

ঊর্মি নাথ

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:১১

হাওড়ার বটানিক্যাল গার্ডেনে একটা বেঞ্চে বসে অনেকক্ষণ ধরে দুটো খঞ্জনার ওড়াউড়ি লক্ষ করছিলাম। মনঃসংযোগ ভেঙে গেল, উল্টো দিকের এক বার্ড ফোটোগ্রাফারের ইশারায়। হাত নেড়ে তিনি আমাকে বেঞ্চের উপরে পা তুলে বসতে বললেন। কিছু না বুঝেই তার কথা মেনে নিলাম। কিছুক্ষণ পরে খেয়াল করলাম, বেঞ্চের তলা দিয়ে একটা সাপ বেরিয়ে চলে গেল। ওই ফোটোগ্রাফার ভদ্রলোক ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করলে আমি হয়তো সাপের গায়ে পা দিয়ে ফেলতাম!

পাখির ছবি তোলা অ্যাডভেঞ্চারের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। এক বার সিকিমের বারফুংয়ের জঙ্গলে পাখির খোঁজে গিয়ে প্রথম দেখেছিলাম রাসেট স্প্যারো। এই প্রজাতির চড়াই আমাদের ঘরে আসা চড়াইয়ের চেয়ে একটু আলাদা। কিন্তু ছবি তোলার আগেই বৃষ্টি শুরু হল। ক্যামেরা বাঁচাতে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলাম। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারলাম না। বর্ষা ছিল না, তাই ছাতাও নিইনি। বৃষ্টিতে চড়াইগেল উড়ে। আমি ভিজে কাক! তা-ও লেগে রইলাম। বৃষ্টি থামল, রোদউঠল। ধৈর্যের পরীক্ষায় উতরেগেলাম। আবার ফিরে এল রাসেট স্প্যারোর দল।

শীতে ভ্রমণ, পিকনিক, বড়দিন, নতুন বছরের জন্য কমবেশি সকলেই প্রস্তুত। পরিযায়ী পাখিরাও প্রস্তুত, যারা এই সময় প্রবল ঠান্ডার জন্য তাদের আদি নিবাস ছেড়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যায় তুলনামূলক কম ঠান্ডার দেশে। শীত ফুরোলে ফিরে যায় নিজের আস্তানায়। প্রতি বছর শীতের মরসুমে ভারতে নানা দেশ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরা চলে আসে। তাদের দেখতে ভিড় জমান পক্ষিবিশারদ, বার্ড ফোটোগ্রাফার, বার্ডওয়াচার। কিছু দিন আগে ছোটদের নিয়ে পালিত হল ‘ইয়ং বার্ডার্স মান্থ’। জানুয়ারিতে সুন্দরবনে শুরু হবে পাখি উৎসব। গোটা শীত-বসন্ত জুড়ে চলবে পাখি দেখা, চেনার উৎসব! এর মধ্যে আছে এক অকৃত্রিম আনন্দ। তবে শুধু শীত নয়, পাখিদেখিয়েরা সারা বছরই মেতে থাকেন এ কাজে।

পাখি চেনার পাশাপাশি দরকার তাদের প্রতি ভালবাসাও। অক্টোবরের শেষে তিব্বত থেকে ভুটানের ফোবজিখা উপত্যকায় আসে ব্ল্যাক নেকড ক্রেন। এই পাখিরা যাতে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে তার জন্য এই উপত্যকার বিস্তৃত চারণভূমিতে মানুষের প্রবেশ নিষেধ। এমনকি নিয়ন্ত্রণ করা হয় কুকুর ও গৃহপালিত পশুদেরও। নির্দিষ্ট জায়গা থেকেই পাখিদের ওড়াউড়ি লক্ষ করতেহয় বার্ডওয়াচারদের। নিয়ম নামানলে শাস্তি।

পাখি দেখা সাধনার চেয়ে কম নয়। ঘরকুনো হলে চলবে না, বেরিয়ে পড়তে হবে। নতুন নতুন প্রজাতির পাখি দেখতে দেখতে তাদের সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ বাড়ে। পাখির জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা বাড়ায় ধৈর্য ও মনঃসংযোগ। পাওয়া যায় প্রকৃতির সান্নিধ্য। চেনা হয় বিভিন্ন গাছ, ফুল, পাতা,প্রজাপতি, মৌমাছি, ফড়িং, পোকামাকড়... তৈরি হয় সমমনস্ক বন্ধু। মনোবিদরা মনে করেন, বার্ডওয়াচিংয়ের মতো অ্যাক্টিভিটি ক্লান্তি, অবসাদ, চিন্তা দূরে সরিয়ে রাখতে অনেকটাই সাহায্য করে। পাখির ডানার রং, তার ডাক, মনের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

শুরু হয় বাড়ির আঙিনা থেকে

অধিকাংশেরই পাখি দেখা শুরু বাড়ির চারপাশের কাক, শালিক, পায়রা, চড়াই দিয়ে। ছুটির দিনে ছাদে উঠে দূরবিনে চোখ লাগিয়ে পাখি খোঁজা ছিল এক মজার খেলা। বাড়ির বড়রা থাকতেন পাখি চিনিয়ে দেওয়ার জন্য। এ ভাবেই চেনা হয়ে যেত ঘুঘু, দোয়েল, বক, ফিঙে, টিয়া, বেনেবউ, হাঁড়িচাচা, মৌটুসি, টুনটুনি, কাঠঠোকরা আরও কত কী! বইমেলা থেকে কিনে দেওয়া হত সেলিম আলির ‘কমন বার্ড’, অজয় হোমের ‘বাংলার পাখি’-র মতো বই। সময় বদলেছে, প্রযুক্তি বদলেছে, কিন্তু পাখির ডানার রং যেমন বদলায়নি, তেমন বদলায়নি পাখি দেখা

 পাখির ছবি: লেখক।

পাখির ছবি: লেখক।

এই কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যে পাখি কোথায়? আমরা সে ভাবে লক্ষ করি না। লক্ষ করলে কংক্রিটের জঙ্গলেও পাখি-প্রজাপতি খুঁজে পাওয়া যায়। পক্ষিবিশারদ বিক্রম গরেওয়াল বলছিলেন, “বার্ডওয়াচিংয়ের ইচ্ছে থাকলে তা নিজের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে শুরু করা যায়। যদি একটা দূরবিন থাকে তো ভাল, না থাকলেও অসুবিধা নেই। এখন বই ছাড়াও ইন্টারনেটে পাখির তথ্য পাওয়া যায়। অভয়ারণ্যে গিয়ে বাঘ-সিংহ, হাতি দেখতে যে পরিমাণ খরচ হয়, তার চেয়ে পাখি দেখার খরচ কম। অভয়ারণ্যে গিয়ে অনেক সময়ে পশুর দেখা না-ও পেতে পারেন, কিন্তু পাখি দেখার চোখ তৈরি হয়ে গেলে কয়েকটি প্রজাতি তো দেখে আসবেনই। এখন ছোট ছোট গ্রাম-শহরে পাখি দেখার ক্লাব হচ্ছে। আগে আমরা ১০-১২ জন পাখিদেখিয়ে ছিলাম, এখন দিল্লি বার্ড গ্রুপে এক লক্ষের বেশি সদস্য।”

পাখি নিরীক্ষণ করার মতো আপাত নিরর্থক বৃত্তিতেও কেউ যদি কায়মনোবাক্যে লেগে থেকে নিজেকে উজাড় করে দেন, তা হলে তাঁর প্রাপ্তির ঘর কিছুতেই ফাঁকা যাবে না।

সেলিম আলি

কোথায় যাবেন পাখি দেখতে?

পাখি দেখার উপযুক্ত সময় শীত থেকে বসন্ত। শহরের মধ্যে রবীন্দ্র সরোবর, সুভাষ সরোবর, নরেন্দ্রপুরে চিন্তামণি বার্ড স্যাংচুয়ারি আদর্শ। কলকাতার কাছাকাছির মধ্যে বকখালি, হেনরি দ্বীপ, ফ্রেজারগঞ্জ, সুন্দরবন, শান্তিনিকেতন ভাল জায়গা। যাওয়া যায় বর্ধমানের পূর্বস্থলী, বীরভূমের বক্রেশ্বর বাঁধ, উত্তরবঙ্গের গাজলডোবা, লাটপাঞ্চার ইত্যাদি জায়গায়। রাজ্যের বাইরে গুজরাতের কচ্ছের রণ, ওড়িশার মংলাজোড়ি, সাতকোশিয়া, রাজস্থানের ভরতপুরের মতো জায়গাও আছে।

ভারতের বার্ডম্যান সেলিম আলি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “পাখি নিরীক্ষণ করার মতো আপাত নিরর্থক বৃত্তিতেও কেউ যদি কায়মনোবাক্যে লেগে থেকে নিজেকে উজাড় করে দেন, তা হলে তাঁর প্রাপ্তির ঘর কিছুতেই ফাঁকা যাবে না।” পাখি দেখা যে কোনও বয়সেই শুরু করা যায়। এই ধরনের ভাল লাগা মোবাইল দেখার নেশা থেকে মুক্তি দেয়, একাকিত্ব, অবসাদ গ্রাস করতে দেয় না। ফোটোগ্রাফির মতো ভাল অভ্যেস তৈরি হয়। বাড়িতে বাচ্চা থাকলে পাখি দেখা ও প্রকৃতি পাঠের জন্য তাদের ছুটির দিনে নিয়ে যান কাছাকাছি গ্রামে, নদীর ধারে। সেখানে সে পাখি, প্রজাপতি খুঁজে বেড়াক, চিনুক গাছ, ফুল। খুঁজে পাক প্রকৃতির সান্নিধ্যে মনের আনন্দ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bird Watchers ornithologist

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy