Advertisement
E-Paper

পুজো সকলের, মণ্ডপ থেকে ফুড স্টল, প্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের পুজো পরিক্রমার জন্য কর্মশালার আয়োজন

হুইলচেয়ারে বসলে কি মণ্ডপ ভ্রমণ নিষেধ? যাঁর ভিড়ে আতঙ্ক রয়েছে, তিনি কি প্যান্ডেলে পা-ই রাখবেন না? শরীরে ক্ষমতা কমে গিয়েছে বলে বয়স্কেরা আর উৎসবে শামিল হতে পারবেন না?

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২৩:৩২
পুজোয় সকলের অন্তর্ভুক্তির উদ্দেশ্যে কর্মশালা।

পুজোয় সকলের অন্তর্ভুক্তির উদ্দেশ্যে কর্মশালা। —নিজস্ব চিত্র।

ইউনেস্কোর তৈরি বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে দুর্গাপুজো। সেই ২০২১ সালে। তার পরও এই উৎসব কি 'সকলের' হয়ে উঠতে পেরেছে? পুজো প্যান্ডেল থেকে ঠাকুরদর্শন, মণ্ডপে বসে আড্ডা, অনুষ্ঠান দেখা, ফুচকা ও আইসক্রিমের স্টলে ভিড় জমানো— এ সমস্ত অভিজ্ঞতার অধিকার কি সকলের রয়েছে? ‘সাধারণ’ ও ‘অ-সাধারণ’দের মধ্যে বার বার বঞ্চিত হচ্ছেন দ্বিতীয় দলের মানুষেরাই। হুইলচেয়ারে বসলে কি মণ্ডপ ভ্রমণ নিষেধ? যাঁর ভিড়ে আতঙ্ক রয়েছে, তিনি কি প্যান্ডেলে পা-ই রাখবেন না? শরীরে ক্ষমতা কমে গিয়েছে বলে বয়স্কেরা আর উৎসবে শামিল হতে পারবেন না? তা হলে যতই বিশ্বের দরবারে সমাদৃত হোক না কেন, এই উৎসব 'সকলের' হয়ে উঠতে পারেনি। দায় কেবল অসচেতনতার। এই উৎসবকে প্রকৃত অর্থে সর্বজনীন করে তুলতে তাই পুজোর আয়োজনে কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন।

এগিয়ে এল পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ইউনাইটেড নেশনস এবং ইউনেস্কো। এই ত্রয়ী হাত মেলাল শহরের কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে, স্বয়ম, সঞ্চার, অঞ্জলি, শ্রুতি ডিজ়েবিলিটি রাইটস সেন্টার, মাসআর্ট, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি খড়্গপুর এবং ইন্ডিয়া অটিজ়ম সেন্টার। তৈরি হল কোর কমিটি। আর তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন আইআইটি খড়্গপুরের অধ্যাপিকা হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়। আয়োজিত হল এক কর্মশালা। শুক্রবার শিশিরমঞ্চে জড়ো হলেন ২৪টি পুজো কমিটির সদস্যেরা। সঙ্গে ছিলেন কমিটির স্বেচ্ছাসেবীরাও।

অধ্যাপিকার মস্তিষ্কপ্রসূত নির্দেশিকা বুঝিয়ে বলা হল অংশগ্রহণকারীদের। সাংস্কৃতিক উৎসবকে সকলের কাছে সহজগম্য করে তুলতে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর (এসওপি) বানিয়েছেন হৈমন্তী। যেমন, পুজোর প্যান্ডেলে বিশেষ ভাবে সক্ষম এবং বয়স্কদের জন্য আলাদা র‌্যাম্প তৈরি করা, র‌্যাম্পের উচ্চতা নির্দিষ্ট করা, রেলিং বসানো, প্যান্ডেলের ভিতরে ঠাকুর দর্শন করে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত সুগম পথ তৈরি করা, ভিড়ের বাইরে ফাঁকা একখানি জায়গা বরাদ্দ করা, যাতে কেউ চোট পেলে বা ভিড়কে ভয় পেলে বিশ্রাম নিতে পারেন, শৌচালয়ের আকার-আকৃতি নিয়ে ভাবা, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে মণ্ডপ ছেড়ে নিরাপদে বেরিয়ে আসার সুবিধা করে দেওয়া, দৃষ্টিহীনদের জন্য ব্রেলে লেখা পোস্টার তৈরি করা— এমনই নানাবিধ ছোটখাটো পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন হৈমন্তী। আর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির সদস্যেরা সে সবই বাস্তবায়িত করতে এই কর্মশালায় সকলকে প্রশিক্ষণ দিলেন।

কর্মশালার অন্যতম সঞ্চালক মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায় পুজো প্যান্ডেলগুলিতে স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। পাশাপাশি, পুজো কমিটির সদস্যদের নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তাঁদের প্রতিবন্ধকতাকে ঘিরে প্রচলিত ধারণার বদল ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁর কথায়, “উৎসব সবার জন্য, আর তার আয়োজনে সকলের অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য। যাঁরা নাগরিক, তাঁদের কারও না কারও হয়তো কোনও প্রতিবন্ধকতা আছে, কিন্তু যাতে তাঁরা উৎসব থেকে বাদ না পড়েন— সেটাই আমাদের সম্মিলিত উদ্দেশ্য।” কিছু আচরণবিধি তৈরি করেছেন হৈমন্তী। প্রথমে শুনে কঠিন মনে হলেও স্বেচ্ছাসেবক ও পুজো কর্মকর্তাদের আগ্রহের মধ্যেই আশার আলো দেখা যাচ্ছে। কেবল এই পুজোর জন্য নয়, আগামী প্রতিটি পুজো ও যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তা ব্যবহার করা যাবে। রত্নাবলী জানাচ্ছেন, যাঁরা এটিকে বাস্তবায়ন করবেন অর্থাৎ পুজো কমিটির সেচ্ছাসেবকেরা— তাঁরাও কিছু আশঙ্কার কথা তুলেছেন, যা ভেবে দেখা প্রয়োজন। কেউ কেউ বলেছেন, “আপনারা আচরণবিধি তৈরি করে ভাল করেছেন, কিন্তু অবাঞ্ছিত কিছু ঘটনা নিয়ে আমরা ভয়ে থাকি।” একজন প্রশ্ন তুললেন, “ভিড় সামলানোর সময়ে কারও গায়ে হাত লেগে গেলে, আমার নামে যদি যৌন হেনস্থার অভিযোগ ওঠে? অনেকেই নিয়ম মানতে চান না, আমাদের আটকাতে হয়।” রত্নাবলী বলছেন, ‘‘আমরা তাঁদের বুঝিয়ে বলেছি যে, তাঁদের ইন্টেন্ট এখানে মুখ্য নয়। তাঁদের আচরণ অন্যকে কী ভাবে প্রভাবিত করছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবন্ধীরা যৌন হয়রানির শিকার হন না— এই ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। ভিড়ে যে কোন মানুষেরই এই ঝুঁকি থেকে যায়। আর সেখানেই স্বেচ্ছাসেবীদের শিখতে হবে, কী ভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে নিয়ম মেনে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। সেই সচেতনতার পাঠ দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমরা।”

যৌন হেনস্থার ঘটনা ক্ষমাযোগ্য নয়— প্যান্ডেলে এমন বার্তাও দেওয়ার কথা হয়েছে। এ সব বিষয় নিয়ে পুজো কমিটির কর্তাব্যক্তিরা ভাবছেনও। আশা করা যায়, অন্তত কিছু জায়গায় এসওপিগুলি নিশ্চয়ই বাস্তবায়িত হবে।

ইউনেস্কোর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান আশুতোষ সামাল জানালেন, তাঁরা দিল্লি এবং কলকাতায় এই কর্মশালার আয়োজন করছেন। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিকে একজোট করে এই মডেলের বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে, যাতে কেউ বাদ না পড়েন এই উৎসব থেকে। সঞ্চার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মনোমিতা চৌধুরীর কথায়, ‘‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করছি আমরা সবাই মিলে। সেই চেষ্টা তো নতুন নয়! কিন্তু এ বার সরকারের পাশাপাশি ইউনাইটেড নেশনস এবং ইউনেস্কোও এই প্রচেষ্টায় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যা আমাদের মতো সংস্থাগুলির জন্য খুব অনুপ্রেরণামূলক। এসওপি তো আসলে অনেক তৈরি হয়, কিন্তু সে সব মানুষের কাছে পৌঁছয় না। তাই এ বারের এই কর্মশালা হওয়ার ফলে আমাদের মনে খানিক আশা জাগছে। পুজো কমিটির মানুষেরা এসে প্রশ্ন করছেন, বক্তব্য রাখছেন, উত্তর পাচ্ছেন, সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছেন। যেগুলি খুব দরকার ছিল।’’

এ বার থেকে তা হলে আশা করা যেতে পারে, উৎসবের ভিড় থেকে বঞ্চিত হবেন না কেউ। আশা করা যেতে পারে, প্রবল আলো, হইহট্টগোল, শব্দে আর ভয় পাবেন না কেউ। কারণ, যাঁদের সাহায্যের প্রয়োজন, তাঁদের হাত ধরার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছেন আরও শয়ে শয়ে মানুষ। ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির তালিকায় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে শারদোৎসব।

Durga Puja 2025 Specially abled people UNESCO United Nations Ratnaboli Ray
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy