Advertisement
E-Paper

তিন মেডিক্যালে ভর্তির বাধা কাটাতে ফের অস্ত্র মুচলেকা

বারবার রাজ্যের তরফে মুচলেকা। প্রতি বারেই মুচলেকায় পরিকাঠামোর ঘাটতি পূরণের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু কোনও বারেই কথা রাখতে না-পারা। এবং আবার মুচলেকা! তা সত্ত্বেও রাজ্যের উপরে নিজেদের চাপটা আর রাখতে পারছে না মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)। বাংলা তিন-তিন বার ফেল করেছে। তবু রাজ্যের তিন মেডিক্যাল কলেজে আসন কমানো নিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে চলেছে এমসিআই।

সোমা মুখোপাধ্যায় ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৪ ০৩:০২

বারবার রাজ্যের তরফে মুচলেকা। প্রতি বারেই মুচলেকায় পরিকাঠামোর ঘাটতি পূরণের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু কোনও বারেই কথা রাখতে না-পারা। এবং আবার মুচলেকা!

তা সত্ত্বেও রাজ্যের উপরে নিজেদের চাপটা আর রাখতে পারছে না মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)। বাংলা তিন-তিন বার ফেল করেছে। তবু রাজ্যের তিন মেডিক্যাল কলেজে আসন কমানো নিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে চলেছে এমসিআই।

পরিকাঠামোগত শর্ত না-মানায় সাগর দত্ত, মালদহ ও মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে ৩৫০ আসন-সহ মোট ৭৫০ আসন বাতিল করার সুপারিশ করেছিল এমসিআই। কিন্তু রাজ্যে বিপুল চিকিৎসক-ঘাটতির কথা মাথায় রেখে ওই তিনটি মেডিক্যাল কলেজকে আগামী শিক্ষাবর্ষে ছাত্র ভর্তির অনুমোদন দেওয়ার কথা ভাবছে তারা। তার জন্য ওই তিনটি কলেজকে মুচলেকা দিতে হবে। চার মাসের মধ্যে পরিকাঠামো উন্নত করার কথা লিখতে হবে সেই মুচলেকায়।

আগের দু’বছর পরিকাঠামোগত মান বজায় না-রাখায় ওই তিনটি মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র ভর্তি বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছিল এমসিআই। এবং ওই দু’বারও মুচলেকা দিতে হয়েছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরকে। কিন্তু মুচলেকায় যে-সব কথা দেওয়া হয়েছিল, তা রাখা হয়নি। এ বারেও তার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। তা হলে বারবার এমন সুপারিশ পাঠানোর কী দরকার, উঠছে সেই প্রশ্নও।

রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার মন্তব্য, বারবার আসন বাতিলের সুপারিশ করবে এমসিআই। আর বারবার মুচলেকা দিয়ে পার পেয়ে যাবে রাজ্য সরকার। কিন্তু পরিকাঠামোর কোনও উন্নয়ন হবে না। উপযুক্ত পরিকাঠামো না-থাকায় সে-রকমই ডাক্তার বেরোবে। তিনি বলেন, “এ বারেও যে-মুচলেকা দেওয়া হবে, চার মাসের মধ্যে তা মানার সামর্থ্যই নেই রাজ্যের।

আগামী শিক্ষাবর্ষের আগে সেই একই সমস্যার সৃষ্টি হবে। কারও কোনও লাভ হবে না।”

তা হলে লাগাতার এই আসন বাতিলের সুপারিশ, তা থেকে রেহাই পেতে মুচলেকা এবং শেষ পর্যন্ত ছাত্র ভর্তিতে সায় এটা চলবে কেন?

দিল্লিতে এমসিআইয়ের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “চিকিৎসকের অভাব সারা দেশেই। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ একেবারে প্রথমের সারিতে। সেখানে এক বা একাধিক মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র ভর্তি রাতারাতি বন্ধ করে দিলে সেটা রাজ্যের বাসিন্দাদের পক্ষেই ক্ষতিকর হবে। দেশের কোনও সরকারি মেডিক্যাল কলেজের এ ভাবে ঝাঁপ বন্ধ করার নজিরও নেই। সেই জন্যই আমরা অতি সাবধানি হয়ে পড়ছি।” তবে যে-সব মেডিক্যাল কলেজে আসন কমানো হয়েছে, সেখানে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হবে কি না, তা এখনও ঠিক হয়নি।

আর স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, এমসিআইয়ের এই ‘অতি সাবধানি’ মনোভাবেরই সুযোগ নেওয়া হচ্ছে এ রাজ্যে। সেটা কেমন? স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, “১১০০ থেকে রাতারাতি মেডিক্যালের আসন ২২০০ করা হল। অথচ নিছক সংখ্যার দৌড়ে এগিয়ে থাকার জন্য পরিকাঠামো ছাড়াই এ ভাবে কলেজ চালু করার কোনওই যুক্তি নেই। রাজ্যে ডাক্তারের ঘাটতি আছে ঠিকই। কিন্তু ডাক্তারের নাম করে কিছু হাতুড়ে তৈরি করা হলে তার পরিণতিও মারাত্মক হতে পারে।”

এই মত সমর্থন করেন না রাজ্যের স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। এমসিআইয়েরই সুর তাঁর গলায়। তিনি বলেন, “দেশ জুড়ে ডাক্তারের ঘাটতি রয়েছে। এই অবস্থায় নতুন মেডিক্যাল কলেজ না-খুলে মোটেই হাত গুটিয়ে বসে থাকা যেত না। রাজ্যের মানুষের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এটা করতে হয়েছে।”

ডাক্তার-ঘাটতির ছবিটা কেমন?

স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, এ রাজ্যে ২৬০০ জনসংখ্যা-পিছু এক জন করে চিকিৎসক আছেন। গোটা দেশে এই অনুপাত ১৭০০ জন-পিছু এক জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র সুপারিশ অনুযায়ী, এটা এক হাজার জন-পিছু এক জন হওয়া উচিত। সে-দিক থেকে রাজ্য অনেকটাই পিছিয়ে। তার উপরে একাধিক মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র ভর্তি বন্ধ হলে নতুন ডাক্তার তৈরির প্রক্রিয়া অনেকটাই ধাক্কা খাবে। আসন বাতিলের ব্যাপারে এমসিআইয়ের সুপারিশ কার্যকর হলে রাজ্যে মেডিক্যালে আসন-সংখ্যা ২২০০ থেকে এক ধাক্কায় কমে হবে ১৪৫০।

এর মধ্যেই গত ২৯ এপ্রিল এমসিআইয়ের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কমিটির বৈঠকে রাজ্যের সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরেট স্তরে মোট ৪০টি আসন বৃদ্ধির আবেদন খারিজ করে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সেই তালিকায় আছে এসএসকেএম, আর জি কর, কলকাতা, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ, বি সি রায় শিশু হাসপাতাল ও কেপিসি মেডিক্যাল কলেজ। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর ওই সুপারিশ পুনর্বিবেচনা করার আবেদন জানাচ্ছে এমসিআইয়ের কাছে। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, এর আগেও এমসিআই এই ধরনের সুপারিশ করেছিল। রাজ্য আবেদন করায় সেই সুপারিশ কার্যকর হয়নি।

ঘাটতির পাঁচকাহন

• ডাক্তার, চিকিৎসাকর্মীর অভাব

• অপারেশন থিয়েটার কম

• বাড়িঘরের অভাব

• অত্যাবশ্যক বিভাগেও ত্রুটি

• নথি সংরক্ষণে শৈথিল্য

তিনটি মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে আপত্তি ঠিক কোথায়?

এমসিআই সূত্রের খবর, সাগর দত্তের পরিকাঠামো নিয়ে ২৪টি বিষয়ে তাদের আপত্তি রয়েছে। মালদহের ক্ষেত্রে ১০টি এবং মুর্শিদাবাদের ক্ষেত্রে আটটি বিষয়ে এমসিআইয়ের আপত্তি আছে। তাদের মূল আপত্তির মধ্যে রয়েছে: প্রয়োজনীয় চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মীর অভাব, চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি যথাযথ ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না-করা, অপারেশন থিয়েটারের সংখ্যা কম, অত্যাবশ্যক বিভাগগুলি যথাযথ নিয়ম মেনে তৈরি না-হওয়া, বাড়ি তৈরি না-হওয়া ইত্যাদি। এর আগে পরপর দু’বার এই একই ধরনের ঘাটতির কথা বলে ছাত্র ভর্তি বন্ধের সুপারিশ করেছিল এমসিআই। পরিস্থিতি শুধরে নেওয়া হবে বলে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে দু’বারই এমসিআইয়ের কাছ থেকে ছাড়পত্র আদায় করেন স্বাস্থ্যকর্তারা। কিন্তু কোনও বারেই তাঁরা কথা রাখতে পারেননি। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, তৃতীয় বারেও যে একই অবস্থা হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

রাজ্যে স্নাতকোত্তরে আসন না-বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কারণ অনেকটা একই। এসএসকেএমে স্নাতকোত্তর সার্জিক্যাল গ্যাসট্রোএন্ট্রোলজি (এমসিএইচ)-তে পঠনপাঠন শুরু করতে রাজ্য চারটি আসন চেয়েছিল। বিভাগীয় এক চিকিৎসকের ডিগ্রিতে গরমিল, সিনিয়র রেসিড্যান্টের অনুপস্থিতি এবং গ্রন্থাগারে বইয়ের অভাব আছে বলে জানায় এমসিআই। আর জি করে চারটি আসন নিয়ে ডিএম কোর্স (গ্যাসট্রোএন্ট্রোলজি) চালু করার বাধা প্রফেসরের অনুপস্থিতি, ওপিডি-তে জায়গার অভাব। বি সি রায় শিশু হাসপাতাল স্নাতকোত্তরে পেডিয়াট্রিক্সে চারটি আসন ছিল। তারা আরও ১০টি আসন বাড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু শিক্ষক-চিকিৎসকের অভাবের জন্য সেই প্রস্তাব বাতিল হয়েছে।

রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের অনুযোগ, হাসপাতালে মাটিতে রোগী শুচ্ছে কেন, কেন এক শয্যায় দু’জন রোগী রাখতে হচ্ছে, লেকচার থিয়েটার কেন ছোট, ইমার্জেন্সিতে অন্তত কিছু শয্যা গুরুতর পরিস্থিতির জন্য খালি রাখা হচ্ছে না কেন এই সব প্রশ্ন তুলে অনুমোদন বাতিল করছে এমসিআই। কিন্তু রোগীর চাপ সামলে এই সব প্রশ্ন না-ওঠার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা কার্যত অসম্ভব।

কিন্তু রাজ্য সরকার কি এক বার ওই পরিকাঠামো উন্নয়নের ব্যাপারটি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে পারে না? এমনটাই প্রশ্ন রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত একাধিক চিকিৎসকের। রাজ্যের স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তার জবাব, “রাতারাতি সব কিছু তৈরি করে ফেলা যায় না। এটা তো ম্যাজিক নয়। ধাপে ধাপে সব হচ্ছে। আশা রাখি, আরও একটু সময় পেলে আমরা পরিকাঠামোর ঘাটতি অনেকটাই মিটিয়ে ফেলতে পারব।”

medical hospitals admission parijat soma
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy