Advertisement
E-Paper

‘নিয়ম’ বলে চিকিৎসা নেই কুড়োনো শিশুর

জীবন দিয়ে এ বার রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কিছু ফাঁকফোকরের দিকে আঙুল তুলে দিয়ে গেল আড়াই মাসের অজ্ঞাতপরিচয় এক শিশু। কেন মা বা মাতৃস্থানীয়া কেউ না থাকলে কোনও শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা যায় না, কেন শুধুমাত্র অভিভাবক না থাকার কারণে কোনও অজ্ঞাতকুলশীলের ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচার করতে পিছিয়ে আসে হাসপাতাল, কেন একটি হাসপাতালে বিশেষ এক পরিকাঠামো না থাকলে তার গা ঘেঁষে অন্য হাসপাতালে সেই পরিকাঠামো মজুত থাকা সত্ত্বেও ‘নিয়ম’ না থাকার অজুহাতে তার সুবিধা নেওয়া যায় না, কেন সরকারি হাসপাতালে দুধের শিশুর জন্য এক গ্লাস গরম জলের প্রয়োজন হলেও সে জন্য টাকা খরচ করতে হয়, সেই প্রশ্নগুলি তুলে দিয়ে গিয়েছে আড়াই মাসের মেয়ে।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:০৮
হাসপাতালের সেই শিশু।  —নিজস্ব চিত্র

হাসপাতালের সেই শিশু। —নিজস্ব চিত্র

জীবন দিয়ে এ বার রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কিছু ফাঁকফোকরের দিকে আঙুল তুলে দিয়ে গেল আড়াই মাসের অজ্ঞাতপরিচয় এক শিশু।

কেন মা বা মাতৃস্থানীয়া কেউ না থাকলে কোনও শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা যায় না, কেন শুধুমাত্র অভিভাবক না থাকার কারণে কোনও অজ্ঞাতকুলশীলের ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচার করতে পিছিয়ে আসে হাসপাতাল, কেন একটি হাসপাতালে বিশেষ এক পরিকাঠামো না থাকলে তার গা ঘেঁষে অন্য হাসপাতালে সেই পরিকাঠামো মজুত থাকা সত্ত্বেও ‘নিয়ম’ না থাকার অজুহাতে তার সুবিধা নেওয়া যায় না, কেন সরকারি হাসপাতালে দুধের শিশুর জন্য এক গ্লাস গরম জলের প্রয়োজন হলেও সে জন্য টাকা খরচ করতে হয়, সেই প্রশ্নগুলি তুলে দিয়ে গিয়েছে আড়াই মাসের মেয়ে।

বহরমপুরের রাস্তা থেকে ওই রুগ্ণ শিশুটিকে উদ্ধার করেছিল ‘চাইল্ড লাইন’। প্রথমে বহরমপুরের হাসপাতাল, তার পরে কলকাতার এম আর বাঙুরে ভর্তি করা হয় তাকে। মস্তিষ্কে বড়সড় টিউমার ছিল। ছিল মেরুদণ্ডেও। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে বোঝেন, অবিলম্বে অস্ত্রোপচার না হলে পরবর্তী জীবনে স্বাভাবিক নড়াচড়াটুকুও করতে পারবে না শিশুটি। বাঙুরে ওই পরিকাঠামো নেই, তাই কর্তৃপক্ষই চেষ্টাচরিত্র করে তাকে ভর্তির ব্যবস্থা করেন বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি-তে। কিন্তু শিশুটির সঙ্গে থাকবে কে? তার তো কেউ নেই। মা না থাকলে হাসপাতাল ভর্তি নেবে না। বাঙুর কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের সামনের এক চায়ের দোকানের কর্মী বিন্দিয়াকে দৈনিক টাকার ভিত্তিতে শিশুটির মা হতে রাজি করান। এখানেই শেষ নয়। প্রয়োজন বাবারও। ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচারের আগে বন্ডে সই করতে হবে যে! হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই হাসপাতালের সাফাইকর্মী বাপি দাসকে বাবা হিসেবে সই করতে রাজি করান। সেই পরিচয়েই খাতায়-কলমে বর্ষা দাস হয়ে বিআইএন-এ ভর্তি হয় একরত্তি মেয়েটি।

কিন্তু শুধু হাসপাতালে ভর্তি হলেই তো হবে না। চিকিৎসার আনুষঙ্গিক খরচ আসবে কোত্থেকে? মা সাজার পারিশ্রমিকই বা কোন খাত থেকে খরচ করবেন বাঙুর কর্তৃপক্ষ? রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বিষয়টিকে ‘স্পেশ্যাল কেস’ বলে উল্লেখ করে সমিতি থেকেই টাকা মঞ্জুর করেন। দেওয়া হয় ওষুধপত্রের খরচও। বিন্দিয়ার অভিযোগ, বিআইএন-এ বাচ্চার দুধ গোলার জন্য গরম জল নিতে গেলেও চার টাকা খরচ করতে হত। রোগী কল্যাণ সমিতি ও জননী সুরক্ষা যোজনার বরাদ্দ থেকে সারা দিনের এমন নানা খুঁটিনাটি খরচই জুগিয়েছেন বাঙুর কর্তৃপক্ষ।

দিন কয়েক অপেক্ষার পরে অস্ত্রোপচারের ডেট পাওয়া যায়। মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের পরে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিকু) বর্ষাকে রাখা প্রয়োজন ছিল। বিআইএন-এ পিকু নেই। কিন্তু তার পাশের বাড়ি এসএসকেএমেই রয়েছে। কিন্তু সেখানে পাঠানোর ‘নিয়ম নেই’ জানিয়ে অস্ত্রোপচারের পর সাধারণ ওয়ার্ডেই রাখা হয় বর্ষাকে। সেখানেই সেপ্টিসেমিয়ায় মারা যায় আড়াই মাসের শিশুটি। বাঙুরের এক চিকিৎসকের কথায়, “একটা বাচ্চার প্রাণের চেয়েও নিয়মটা বড়! চিকিৎসক হিসেবে এটাই সবচেয়ে হতাশার।”

এসএসকেএমের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র জানিয়েছেন, বিআইএন-এ কোনও শিশুর জটিল অস্ত্রোপচার হলে আগে থেকে এসএসকেএমের পিকু বুক করে রাখাটাই শ্রেয়। তা হলে অস্ত্রোপচার পরবর্তী ঝুঁকি অনেক কম থাকে। এ ক্ষেত্রে কেন তা হয়নি, তার কোনও ব্যাখ্যা বিআইএন কর্তৃপক্ষ দিতে পারেননি।

তবে গল্পের শেষ এখানে নয়। বর্ষার মৃত্যুর পরে তার ‘সাজানো বাবা’ বাপি দাসের হাতেই মৃতদেহ তুলে দেন বিআইএন কর্তৃপক্ষ। সে দিন বাপির ডিউটি ছিল। বাঙুরের মর্গে মৃতদেহটি রেখে ডিউটি সারেন তিনি। পরদিন তপসিয়ার গোরস্থানে শিশুটিকে কবর দিতে গেলে সেখানে প্রশ্ন ওঠে। কেন দেড় দিন পরে কবর দেওয়া হচ্ছে, যেহেতু কন্যাসন্তান, তাই এর পিছনে অন্য কোনও গল্প লুকিয়ে নেই তো? কবরস্থানের কর্মীরা এমন নানা প্রশ্ন তুললে বাপি কোনওমতে দেহটি নিয়ে ফিরে আসেন। সেখান থেকে কর্তৃপক্ষ হিন্দু সৎকার সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করে বর্ষার অন্ত্যেষ্টির ব্যবস্থা করেন। শেষ হয় একটা অধ্যায়।

বাঙুরের সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, এত চেষ্টাতেও শিশুটিকে বাঁচানো গেল না। সহকারী সুপার সেবন্তী মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, “চায়ের দোকানের ওই মহিলা, এক সাফাইকর্মী, বাঙুর হাসপাতালের বহু ডাক্তার-নার্স ওই অনাত্মীয় শিশুটির জন্য অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন। এটাও কম ইতিবাচক দিক নয়।” কিন্তু স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর আরও যে সব জটের দিকে আঙুল তুলে গেল ওই শিশু? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “বহু অপ্রয়োজনীয় নিয়ম রয়েছে সে কথা ঠিক। একইসঙ্গে এটাও ঠিক যে দায়িত্ব এড়ানোর জন্য অনেকেই নিয়মের মিথ্যা দোহাই দেন।”

child soma mukhopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy