Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

পাল্টাচ্ছে জীবনশৈলি, হাড় ভাঙার ঝুঁকি পুরুষেরও

একটা সময় পর্যন্ত বলা হত, ‘এটা মেয়েদের অসুখ’। কিন্তু গোটা বিশ্ব জুড়ে এখন পুরুষদেরও আক্রমণ করছে এই রোগ। হাড়কে ক্রমশ ভঙ্গুর করে দৈনন্দিন হাঁটা-চলা-বসার ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনা এই রোগের নাম অস্টিওপোরোসিস। এই রোগ নিয়ে গবেষণারত চিকিৎসকেরা মানছেন, হার্টের অসুখ বা ক্যানসারের মতো এই রোগের বাড়বাড়ন্তের পিছনেও রয়েছে বদলে যাওয়া জীবনশৈলি বা ‘লাইফস্টাইল’। যা দেহের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। তাই জীবনশৈলিতে রাশ না টানলে হাড় ভাঙার এই যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার আশা কম।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৪৭
Share: Save:

একটা সময় পর্যন্ত বলা হত, ‘এটা মেয়েদের অসুখ’। কিন্তু গোটা বিশ্ব জুড়ে এখন পুরুষদেরও আক্রমণ করছে এই রোগ। হাড়কে ক্রমশ ভঙ্গুর করে দৈনন্দিন হাঁটা-চলা-বসার ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনা এই রোগের নাম অস্টিওপোরোসিস। এই রোগ নিয়ে গবেষণারত চিকিৎসকেরা মানছেন, হার্টের অসুখ বা ক্যানসারের মতো এই রোগের বাড়বাড়ন্তের পিছনেও রয়েছে বদলে যাওয়া জীবনশৈলি বা ‘লাইফস্টাইল’। যা দেহের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। তাই জীবনশৈলিতে রাশ না টানলে হাড় ভাঙার এই যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার আশা কম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র সাম্প্রতিক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, ২০২০ সাল নাগাদ পঞ্চাশোর্ধ্ব ভারতীয় পুরুষদের ৫০ শতাংশই অস্টিওপোরোসিসের শিকার হবেন। এই পরিসংখ্যান চমকে ওঠার মতোই। কারণ মেনোপজ হওয়ার পরে মহিলাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন-প্রোজেস্টেরনের ঘাটতিই হাড় ভঙ্গুর করে তোলে বলে বহু দিন পর্যন্ত মনে করা হত। মেয়েদের খাদ্য তালিকায় ক্যালসিয়ামের অভাব এবং ভিটামিন ডি-র ঘাটতির কথাই সামনে আসত বার বার। কিন্তু হু, এমনকী ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-ও এখন জানাচ্ছে আধুনিক জীবনযাত্রার ছাপ এখন ৩০ পেরনো পুরুষদেরও ‘হাই রিস্ক গ্রুপ’-এ ঠাঁই দিচ্ছে। পেলভিস, হাতের উপরের অংশ এবং পায়ের নীচের অংশের হাড় ভাঙার অন্যতম কারণ এখন এই রোগই। বিশ্বে প্রতি তিন সেকেন্ডে এক জনের অস্টিওপোরোসিস থেকে হাড় ভাঙছে। আরও আশঙ্কার কথা হল, এক বার ভাঙলে বার বার হাড় ভাঙার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।

কলকাতাতেও চিকিৎসকদের কাছে অস্টিওপোরোসিসের রোগীর ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। সেখানে মহিলাদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন পুরুষ রোগীরাও। ডাক্তারদের মতে, শরীরে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি-র ঘাটতির পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, কিডনির অসুখও এ জন্য দায়ী। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে জিনঘটিত কারণও রয়েছে। হু-র বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, পুরুষের টেস্টোস্টেরন হরমোন যখন কমতে থাকে, বহু ক্ষেত্রেই তখন এই সমস্যা মাথাচাড়া দেয়। শুধু যে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই হরমোন কমতে থাকে, তা কিন্তু নয়। মানসিক চাপ, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রাও ক্ষরণ কমার জন্য দায়ী। এ ছাড়াও বিশেষ এক ধরনের স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধও এ জন্য অনেকাংশেই দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। ইদানীং স্টেরয়েড নেওয়ার হারও বেড়েছে। একটানা বহু দিন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খেলে হাড় ভঙ্গুর হয়।

বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা কম বয়সের অস্টিওপোরোসিসের সঙ্গে লড়াই করার উপায় খুঁজছেন নিজেদের মতো করে। নিজেদের মতো করে তাঁরা এই রোগবৃদ্ধির ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন।

যেমন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “যাঁরা ক্যানসারের জন্য কেমোথেরাপি নিচ্ছেন, যাঁদের কিডনি বিকল কিংবা অন্য কোনও কারণে টানা তিন মাসেরও বেশি স্টেরয়েড নিতে হয়েছে, তাঁদের হাড়ের ক্ষয় দ্রুত হতে থাকে। চিকিৎসকদের উচিত স্টেরয়েড শুরু করার আগে হাড়ের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা অর্থাৎ সেই ধরনের ওষুধ চালু করা।”

“আবার যাঁরা নিয়মিত মদ্যপান করেন বা ধূমপান করেন, তাঁদের প্রতি বছর দুই শতাংশ করে হাড়ের ক্ষয় হয়। আর যাঁরা মদ্যপান এবং ধূমপান দুই-ই করেন তাঁদের বছরে আট শতাংশ হাড়ের ক্ষয় হয়,” জানাচ্ছেন চিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটক। তিনি জানান, এই রোগের ক্ষেত্রে সমস্যা হল, এর কোনও প্রাথমিক উপসর্গ থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছোটখাটো চোট লেগে হাড় ভেঙে যায়। অনেকের আবার হাড় হয়তো ভাঙেনি, কিন্তু অসহ্য ব্যথা। কারণটা একই। অস্টিওপোরোসিস।

সামান্য একটা ঘটনা কী ভাবে এই রোগের জানান দেয়, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন অর্থোপেডিকরা। হয়তো বন্ধুরা মিলে গল্পগুজব করছেন। কোনও ভাবে হাতে বা পায়ে সামান্য চোট লাগল। এমন হামেশাই হয়ে থাকে। তাই হয়তো গোড়ায় সেটাকে কেউ গুরুত্বই দিলেন না। কিন্তু কিছু ক্ষণের মধ্যেই যন্ত্রণা এমন অসহ্য মাত্রায় পৌঁছল যে ডাক্তারের কাছে ছুটতে হল। এক্স-রে করে জানা গেল, হাড় ভেঙেছে। অস্টিওপোরোসিস এমনই নিঃশব্দ শত্রু। যখন জানান দেয় তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।

রিউম্যাটোলজিস্ট অলোকেন্দু ঘোষ জানিয়েছেন, এসএসকেএম হাসপাতালে তাঁদের রিউম্যাটোলজি ক্লিনিকে আর্থ্রাইটিস, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের বহু রোগী আসেন, যাঁদের চিকিৎসা করতে গিয়ে ধরা পড়ে তাঁদের অস্টিওপোরোসিসও রয়েছে। বয়সে তরুণ রোগীও এখন মিলছে আকছার। অন্য অনেক কারণের সঙ্গে তাঁর ব্যাখ্যা, “একই জায়গায় বসে কাজের প্রবণতাও বাড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের বহু ছেলেমেয়েকে পাচ্ছি স্রেফ বসে কাজ করে করে যাঁদের শরীরে এই রোগ বাসা বাঁধছে।”

হোমিওপ্যাথিতেও অস্টিওপোরোসিসের চিকিৎসা চলছে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক অমিতাভ মাইতির কথায়, “রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোটা জরুরি। আমরা সেটাই করি। তাতে শুধু অস্টিওপোরোসিস নয়, বিভিন্ন গ্রন্থির ব্যথা, মাইগ্রেন, লো গ্রেড থাইরয়েড, অ্যালোপেশিয়ার মতো সমস্যাও কমানো যায়।”

একটি বিষয়ে চিকিৎসকেরা সকলেই একমত। যত্নটা প্রয়োজন শৈশব থেকেই। কারণ হাড় মজবুত হওয়ার সময় ওটাই। তাই ছোটবেলা থেকেই দুগ্ধজাত খাবার, খেলাধুলো আর দিনে কিছুক্ষণ শরীরে সূর্যের আলো লাগানোর কোনও বিকল্প নেই।

তবে ৩০ পেরিয়ে সতর্ক থাকা সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারে কারও অস্টিওপোরোসিস থাকলে তো কথাই নেই। ডেক্সা স্ক্যান করে হাড়ের ঘনত্ব জানা যায়। তার পরে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবারের পাশাপাশি প্রয়োজনে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট এবং ভিটামিন ডি ট্যাবলেট বা ইঞ্জেকশন নিতে হতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE