পরিত্রাণের পথ খুঁজে পাচ্ছে না কলকাতার দুই সরকারি হাসপাতাল। স্রোতের মতো আগুনে ঝলসানো রোগীরা ভর্তি হতে আসছেন। বার্ন ওয়ার্ড ছাপিয়ে যাওয়ায় তাঁদের রাখতে হচ্ছে সাধারণ সার্জারি ওয়ার্ডে, অন্য রোগীদের সঙ্গে। এমনকী, ৯০ বা ১০০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া রোগীরও জায়গা হচ্ছে বারান্দার ট্রলিতে। সেখানে ওই রোগীদের ‘ক্রস ইনফেকশন’ বা সংক্রমণের আশঙ্কা থাকছে পুরোদমে। আবার ভিড়ে ঠাসা ওয়ার্ডে পোড়া রোগীদের আব্রু রক্ষাও সব সময়ে সম্ভব হচ্ছে না।
হাসপাতাল-কর্তারা স্বাস্থ্য ভবনে আর্জি জানিয়েও সুরাহা করতে পারছেন না। কারণ, গোটা রাজ্যে সরকারি ক্ষেত্রে মূলত কলকাতার এই দুই হাসপাতালেই আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা হয়। ফলে যথাযথ চিকিৎসা পাবেন না জেনেও এখানেই রোগীকে মরিয়া হয়ে ভর্তি করতে হয়।
এসএসকেএম এবং এম আর বাঙুর এই দুই হাসপাতালের কর্তৃপক্ষই জানিয়েছেন, নভেম্বরের শেষ থেকে আচমকা আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। বছরের কোনও-কোনও সময়ে এ রকম হয়। এসএসকেএমে বার্ন ওয়ার্ডের ৩০টি শয্যাই ভর্তি। বাধ্য হয়ে সাধারণ শয্যায় আরও ২০ জন ঝলসানো রোগীকে ভর্তি নিতে হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এর বেশি রোগী এলে এক শয্যায় দু’জনকে বা মাটিতে রাখতে হবে পোড়া রোগীদের, যা এই রোগীদের চিকিৎসায় পুরোপুরি নিষিদ্ধ ও অমানবিক। ফলে তাঁরা রোগীদের রেফার করছেন বাঙুরে। বাঙুরের বার্ন ইউনিট এসএসকেএমের সহযোগী কেন্দ্র। ফলে রেফারে আপত্তির কারণ নেই। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। রেফারের চোটে দিশেহারা বাঙুরও।
বাঙুরের বার্ন ইউনিটে শয্যা ৩৯টি। তাতে কুলোচ্ছে না দেখে ঠেসাঠেসি করে রাখা হয়েছিল আরও ৬টি শয্যা। তাতেও প্রয়োজন মেটেনি। উপায় না দেখে অগ্নিদগ্ধ আরও ১৫ জন মহিলা ও চার জন পুরুষ রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে সাধারণ সার্জারি বিভাগে। তার পরেও এসেছেন আরও রোগী। গত ৪ ডিসেম্বর এসএসকেএমের সুপার দীপাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে বাঙুরের সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায় অনুরোধ করেন ‘দয়া করে আমাদের হাসপাতালে কিছু দিন আর কোনও অগ্নিদগ্ধ রোগী রেফার করবেন না। আমরা পরিষেবা দিতে পারছি না।’ কিন্তু এসএসকেএমের বার্ন ইউনিটের প্রধান বিজয় মজুমদার বলেন, “আমরাও অসহায়। আর পোড়া রোগী ভর্তি নেওয়া সম্ভব নয়।”
এসএসকেএমের খুব কাছে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ছয় শয্যার ছোট বার্ন ইউনিটটিও ভর্তি। সেখানকার কর্তৃপক্ষ জানান, সাধারণ শয্যায় কোনও আগুনে পোড়া রোগী ভর্তি করবেন না এবং কারও প্লাস্টিক সার্জারি প্রয়োজন হলে পত্রপাঠ এসএসকেএমে পাঠিয়ে দেবেন। কলকাতার আর কোনও মেডিক্যাল কলেজে বার্ন ইউনিট নেই। এমনকী, বেসরকারি হাসপাতালও পুড়ে যাওয়া রোগীর চিকিৎসা করতে চায় না। প্রশ্ন উঠছে, তা হলে রোগীরা কোথায় যাবেন? পুরো চাপ কি মাত্র এই দুই হাসপাতাল বইবে? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “এটা মারাত্মক সমস্যা। ভিড়ের চাপে পুড়ে যাওয়া রোগীদের বিশেষ পরিচর্যা করা যাচ্ছে না। দরকার আরও বার্ন ওয়ার্ড। কিন্তু একটি ওয়ার্ড খুলতেই কত সমস্যা তা আর জি করে বার্ন ইউনিট খুলতে গিয়ে টের পাচ্ছি। চিকিৎসক জোগাড় করাই কঠিন।”
কী অবস্থায় রয়েছেন আগুনে পোড়া রোগীরা?
বাঙুরে দোতলায় ফিমেল সার্জারি বিভাগে গিয়ে দেখা গেল, সদ্য অস্ত্রোপচার হয়েছে বা অস্ত্রোপচার হবে এমন রোগীদের মাঝেই রাখা হয়েছে ৭০-১০০ শতাংশ অগ্নিদগ্ধ রোগীদের। ওয়ার্ডে অনবরত অসংখ্য লোক আসা-যাওয়া করছেন। অগ্নিদগ্ধদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রায় শূন্য হয়ে যায়, ভিড়ে তাঁদের সংক্রমণের মারাত্মক আশঙ্কা থাকছে। আলাদা ভাবে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা হয় বার্ন ওয়ার্ডে। সংক্রমণ আটকাতে বিশেষ ব্যবস্থা, বায়ু চলাচল ব্যবস্থা, পোড়া রোগীর বিশেষ হাইড্রোথেরাপির ব্যবস্থা থাকে, যা সাধারণ সার্জারি ওয়ার্ডে নেই। রোগীদের পোড়া শরীরে কাপড় রাখা যায় না। উলঙ্গ দেহে শুধু পাতলা চাদর জড়ানো থাকে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে গিয়ে সেই চাদরও বার বার সরে যাচ্ছে। ফলে সাধারণ ওয়ার্ডে পুড়ে যাওয়া মহিলা রোগীদের ক্ষেত্রে আব্রু রক্ষা করা যাচ্ছে না।
বাঙুরের সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায় জানালেন, শুধু এটাই নয়, অগ্নিদগ্ধ রোগীদের আলাদা শয্যা দিতে গিয়ে সদ্য অস্ত্রোপচার হওয়া সার্জারির রোগীদের শয্যা ভাগ করে থাকতে হচ্ছে। একই শয্যায় অস্ত্রোপচার হওয়া দু’জন রোগী থাকায় তাঁদেরও ক্রস ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy