ছবি: পিটিআই।
ঘুম থেকে উঠে আজ সকাল ৯টায় টিভির পর্দায় চোখ রেখেছিলেন দেশের মানুষ। এল প্রায় ৯ মিনিটের ভিডিয়ো-বার্তা।
কিন্তু করোনা-পরিস্থিতিতে তাঁর তৃতীয় বক্তৃতায় অর্থনীতি, গরিব মানুষের সুরাহা সম্পর্কে একটি বাক্যও বললেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বরং নির্দেশ দিলেন, আগামী পরশু, রবিবার রাত ৯টায় ৯ মিনিটের জন্য বাড়ির সব আলো নিভিয়ে দিয়ে বারান্দায় বা দরজায় দাঁড়িয়ে প্রদীপ, মোমবাতি, টর্চ বা মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাতে হবে!
প্রধানমন্ত্রীর যুক্তি, করোনা-সঙ্কটে যে আঁধার তৈরি হচ্ছে, তা শেষ করতে আলোর দিকে যেতে হবে, ছড়িয়ে দিতে হবে আলোর তেজ। জনতাই জনার্দন, অর্থাৎ ঈশ্বর। ১৩০ কোটি দেশবাসীর সেই ‘মহাশক্তি’-কে জাগ্রত করতে হবে। এর আগে জনতা-কার্ফুর দিনে বিকেল ৫টায় ডাক্তার-নার্সদের জন্য ৫ মিনিট ধরে তালি-থালি বাজাতে বলেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: নিজামুদ্দিন ফেরতদের নিয়ে সন্ধান হেল্পলাইনে
ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ একে প্রধানমন্ত্রীর ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’ আখ্যা দিলেও এর পিছনে রাজনৈতিক পরিকল্পনা দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। লকডাউনের পরে রুটিরুজি হারানো লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কয়েকশো মাইল হেঁটে গ্রামে ফিরছেন। অর্থনীতির হাল নিয়ে গভীর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিরোধীদের মতে, প্রধানমন্ত্রী মোদী সে কারণে সুকৌশলে নজর ঘোরানোর চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে তাঁর ডাকে দেশের মানুষ এককাট্টা হয়ে তালি দিচ্ছে বা বাতি জ্বালাচ্ছে, তা দেখিয়ে নিজের ভাবমূর্তিকেও অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
প্রদীপের নীচে
খাবারের অপেক্ষায় সরকারি স্কুলে এক খুদে। শুক্রবার নয়াদিল্লিতে। এএফপি
পরিযায়ী শ্রমিক
• দেশে মোট ৪ কোটি
• ৬ লক্ষ ৬৩ হাজার পরিযায়ী শ্রমিক এখন বিভিন্ন ত্রাণ শিবিরে
• গ্রামে ফেরা শ্রমিকদের তিন ভাগের এক ভাগ করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন
ডাক্তার-নার্সদের সুরক্ষার সামগ্রী
• বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ সত্ত্বেও ডাক্তার-নার্সদের সুরক্ষার সামগ্রী মজুত করা হয়নি। বদলে দেওয়া হয়েছে বিদেশে রফতানি করার ছাড়পত্র। প্রতি হাজার জনে ডাক্তার ও হাসপাতালের সংখ্যা কম
হাত ধোয়ার ব্যবস্থা
• দেশে জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষ এখনও পরিস্রুত জল পান না
অর্থনীতি
• লকডাউনের ধাক্কা সামলানোর পরিকল্পনা নেই
• গরিবদের সুরাহায় ত্রাণ প্রকল্প পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ
প্রধানমন্ত্রী আজ বলেছেন, “দেশের কোটি কোটি লোক ঘরে বসে। কারও মনে হতেই পারে একা কী করে লড়ব। কিন্তু প্রত্যেকের সঙ্গে ১৩০ কোটি জনতার ঐক্যবদ্ধ শক্তি রয়েছে। মাঝে মাঝে এই জনতারূপী শক্তির দর্শন জরুরি। তাতে মনোবল বাড়ে।” বাল্মীকির রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যা-কাণ্ডে রামের মনোবল ফেরাতে লক্ষ্মণের উক্তিও তুলে ধরেছেন মোদী। যা শুনে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অপূর্বানন্দের মত, “মুশকিল হল, উনি মোটিভেশনাল গুরু নন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব কিন্তু নীতি তৈরি করা।”
আরও পড়ুন: ভারতের করোনা কি ব্রিটেনের মতো অতটা শক্তিশালী নয়?
হাততালি-থালা বাজানোর দিনে জনতা কার্ফু ভেঙে অনেকেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। তাতে করোনা-সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়েছিল। এ বার প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্মণরেখা ভাঙতে বারণ করেছেন ঠিকই। কিন্তু আমজনতা মোমবাতি-প্রদীপে থেমে না থেকে আতসবাজি জ্বালিয়ে উৎসবে মাতবে কি না, সে আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর বার্তা প্রসঙ্গে এ দিন বলেন, “অন্যের কথায় নাক গলাতে যাব কেন? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। কারও ইচ্ছে হলে তিনি জ্বালবেন। কারও ইচ্ছে হলে তিনি ঘুমোবেন।’’ তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সমালোচনা করব না। ভয় পাচ্ছি, রাত ৯টার সময়ে লোকেরা মোমবাতি নিয়ে ঘুরতে শুরু করলে বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হবে।”
কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির প্রশ্ন, “ব্যালকনিতে মোমবাতি জ্বলবে, কিন্তু যাঁদের ঘরে উনুন জ্বলছে না, তাঁদের কী হবে?” প্রধানমন্ত্রী আজ বলেছিলেন বটে, “করোনা-সঙ্কটে সবথেকে বেশি প্রভাবিত আমাদের গরিব ভাই-বোন।” কিন্তু গরিবদের ‘নিরাশা থেকে আশার দিকে নিয়ে যেতে হবে’ —এটুকু বলেই ক্ষান্ত হন তিনি।
কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুরের ব্যাখ্যা, ‘‘প্রধানমন্ত্রী আসলে ৯ সংখ্যার সঙ্গে জড়িত হিন্দুত্বের বিষয়গুলি জাগ্রত করার চেষ্টা করছেন। তাই রামনবমীর সময়ে সকাল ৯টায় ৯ মিনিটের বক্তৃতা দিয়ে চতুর্থ মাসের পঞ্চম দিনে রাত ৯টায় ৯ মিনিটের জন্য আলো জ্বালাতে বলছেন। সবই তা হলে এখন রাম ভরসা?’’ রামচন্দ্র গুহের যুক্তি, ‘‘সংবিধান মানলে সকলের মৌলিক দায়িত্ব বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি করা। আমরা একবিংশ শতাব্দীতে ট্র্যাজেডির মধ্যেই প্রহসন দেখছি।’’ ইতালির মানুষ ১৬ মার্চ মোমবাতি জ্বেলে প্রার্থনা করেছিলেন। হাততালির মতো এ-ও ইতালির নকল কি না, সে প্রশ্নও উঠছে।
তবে সমালোচকদের জবাবে বিজেপি-র সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বি এল সন্তোষ বলেন, “যাঁরা পরিচারিকার সাহায্য ছাড়া সন্তান বা পোষ্য সামলাতে পারেন না, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করছেন, যাঁকে ১৩০ কোটির দেশ সামলাতে হচ্ছে।”
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy