Advertisement
০২ মে ২০২৪
republic day

কিছু না করাটাও প্রতিরোধ

গণতান্ত্রিক: ভোটের লাইনে অপেক্ষমাণ নাগরিক

গণতান্ত্রিক: ভোটের লাইনে অপেক্ষমাণ নাগরিক

প্রদীপ বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০৯:৪১
Share: Save:

পর্তুগিজ লেখক হোসে সারামাগো সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৯৮ সালে। তাঁর অনেক বিখ্যাত উপন্যাস আছে কিছুটা রূপকধর্মী শৈলীতে লেখা, যেমন ‘ব্লাইন্ডনেস’, ‘দ্য গসপেল অ্যাকর্ডিং টু জেসাস ক্রাইস্ট’ ইত্যাদি। তাঁর সব উপন্যাসে পরোক্ষ ভাবে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এসে পড়ে, কিন্তুতাঁর সবচেয়ে খোলামেলা রাজনৈতিক উপন্যাস হল, ‘সিইং’, যা পর্তুগিজ ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। আক্ষরিক ভাবে পর্তুগিজ ভাষায় বইটির নাম ছিল ‘অ্যান এসে অন ল্যুসিডিটি’, কিন্তু সারামাগোর অনুবাদক উপন্যাসের নাম বদলে ‘সিইং’ করে দেন।

উপন্যাসটি এক অনামা গণতান্ত্রিক দেশের রাজধানী শহরের অদ্ভুত ঘটনাবলির বিবরণ। নির্বাচনের দিন শহরে ভয়ঙ্কর বৃষ্টি, পোলিং বুথে কারও দেখা নেই। মনে হচ্ছে এটা হবে দেশের প্রথম নির্বাচন, যেখানে একটিও ভোট পড়বে না। ক্রমশ আবহাওয়া পরিষ্কার হয়, মানুষ দল বেঁধে পোলিংবুথে যাত্রা করেন। কিন্তু সরকারের স্থায়িত্ব ক্ষণস্থায়ী হয়। ভোট গোনার পর্বে দেখা যায়, দক্ষিণপন্থী দল পেয়েছে ১৩ শতাংশ ভোট, মধ্যপন্থী দল ৯ শতাংশ, বামপন্থী দলটি ২.৫ শতাংশ। বাকি ৭০ শতাংশ ব্যালট ফাঁকা, সেখানে কাউকেই ভোট দেওয়া হয়নি।

দেশের সংবিধান অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে পুনর্নির্বাচন জরুরি, সরকার সম্মতিও দেয়। কিন্তু পুনর্নির্বাচনে অবস্থা আরও খারাপ হয়। এ বার দেখা যায়, ৮৩ শতাংশ ব্যালট ফাঁকা। কাউকে ভোট দেওয়া হয়নি। মানুষ ভোটদানে অনুপস্থিতও ছিলেন না, এবং তাঁরা ব্যালট পেপার নষ্টও করেননি। তাঁরা শুধু কাউকে ভোট দেননি।

যে বিশেষ গণতন্ত্র তাঁরা পাচ্ছেন তার বিরুদ্ধে তাঁরা গণতান্ত্রিক ভাবে প্রতিবাদ করেছেন। দুটি প্রধান রাজনৈতিক পার্টি, দক্ষিণপন্থী ও মধ্যপন্থীদের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি হয়। অন্য দিকে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টির মতো প্রান্তিক দুর্ভাগা বামপন্থী পার্টি বলতে থাকে, খালি ব্যালটের অর্থ হলতাদের প্রগতিশীল কর্মসূচির প্রতি ভোট।

আরও পড়ুন: তবু আশা না পুরিল

সরকার অবশ্য একে প্রতিবাদ হিসেবে মোটেও দেখে না, এবং সংবাদমাধ্যম সরকারি লাইনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। সম্পাদকীয় লেখা হয় ‘ভোটের অসচ্চরিত্র’ প্রয়োগের উপর। প্রশ্ন ওঠে, এটা কি তা হলে সংগঠিত ষড়যন্ত্র যা শুধু সরকারকে উল্টে দিতে চায় না, বরং সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিকসিস্টেমকে পাল্টে দিতে চায়? যদি এটা সত্যি হয়, তা হলে এর পিছনে কে আছে? আর তারা কী ভাবেই বা হাজার হাজার মানুষকে সংগঠিত করল? আর এটা কারও নজরেই বা এল না কেন? যখন সাধারণ নাগরিকদের জিজ্ঞেস করা হয়, তাঁরা কী ভাবে ভোট দিলেন? উত্তরে তাঁরা বলেন, এটাতাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। উল্টে প্রশ্ন করেন, ব্যালট ফাঁকা রাখা তাঁদের অধিকারের মধ্যে পড়ে কি না। এই ধরনের এক শান্ত প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়া ঠিক কী হবে বা হওয়া উচিত, এ ব্যাপারে অনিশ্চিত সরকার একটি ব্যাপারে নিশ্চিত হয় যে, একটা গণতন্ত্রবিরোধী ষড়যন্ত্র চলছে, তাই সরকারদ্রুত একে ‘বিশুদ্ধ, ভেজালহীন সন্ত্রাসবাদ’ অ্যাখ্যা দেয়, দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে। পাঁচশো নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়, গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য তাঁদের সামাজিক অবস্থানকে লাল কোড দেওয়া হয়।

তাঁদের পরিবারদের বলা হয়, তাঁদের প্রিয়জনদের সম্পর্কে যে কোনও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না তা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, কারণ ‘তাঁদের নীরবতাই তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার গ্যারান্টি’। যখন এ সব পদক্ষেপে কোনও ফলই মেলে না, তখন দক্ষিণপন্থী সরকার দেশে শান্তিভঙ্গ ও বিশৃঙ্খলাসৃষ্টির নানান প্লট উদ্ভাবন করে। শহরের সব পথ বন্ধ করে দেয়। শেষে নিজেদেরই একটি সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ ও রিং লিডার তৈরি করে ফেলে। শহর কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে চলতে থাকে। নাগরিকেরা সরকারের প্রতি ধাক্কা এমন উপায়ে প্রতিহত করতে থাকেন, যা ব্যাখ্যার অতীত।

বের্টোল্ট ব্রেখট ১৯৫৩ সালে এক কবিতায় লিখেছিলেন, জনগণের সরকারের উপর আর আস্থা নেই, সুতরাং জনগণকে ভেঙে দিয়ে এক নতুন জনগণকে নির্বাচন করা, এটা কি সহজ হবে না! সারামাগোর উপন্যাস সেই ঘটনার রূপক, যখন সরকার বা জনগণ কাউকেই ভেঙে দেওয়া যায় না।যে কথা আমাদের বিচলিত করে সেটা জনগণ বা সরকারকে ভেঙে দেওয়ার বিষয় ততটা নয়, অথবা তাদের ভাঙা যায় না, এও নয়, বরং গণতন্ত্রে স্বাধীনতার রিচুয়ালের বাধ্যতামূলক প্রকৃতি। ভোট দেওয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে জনগণ কার্যত সরকারকে ভেঙে দেয়। এই ভেঙে দেওয়াটাশুধুমাত্র সরকার ফেলে দেওয়ার সীমাবদ্ধ অর্থে নয়, আরও র্যাডিকাল অর্থে। ভোটারদের ভোট না দেওয়ায় বা কোনও দল ভোটদানে অনুপস্থিত থাকায় সরকারে এত প্যানিক সৃষ্টি হয় কেন?

সরকার এই সত্যের মুখোমুখি হয় যে তার অস্তিত্ব আছে, তার ক্ষমতার অস্তিত্ব আছে যতক্ষণ তাযেমন সেই ভাবেই সাধারণ্যে স্বীকৃত। এখানে দলটিকে প্রত্যাখ্যান করা বা অনুমোদন না করার মধ্যেও এক ধরনের স্বীকৃতি আছে। এটা খুবই সহজবোধ্য। যে দল হেরে যায়, সে সরকার থেকে সরে যায়। কিন্তু জনগণ যখন ভোটদানে অনুপস্থিত থাকে, তখন তাদের এই পদক্ষেপ আস্থাহীনতারভোটকে অতিক্রম করে যায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল কাঠামোকেই বাতিল করে দেয়।

আরও পড়ুন: ভোটের মুখে প্রণব ভারতরত্ন

এ হল এক র্যা ডিকাল প্রত্যাখ্যান। ফরাসি দার্শনিক অ্যালেন ব্যাদিউ বলেছিলেন, ‘‘রাষ্ট্র যাকে অস্তিত্বশীল হিসেবে স্বীকার করেছে তাকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার চেয়ে, কিছু না করা ভাল।’’ রাষ্ট্রের দ্বারা স্বীকৃত প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক বা নেতিবাচক ভাবে অংশগ্রহণ করার চেয়েকিছু না করা অনেক ভাল, এই ছিল তাঁর মত। বিশেষ বিশেষ কাজে নিযুক্ত থেকে সিস্টেমকে আরও মসৃণ ভাবে চলতে সাহায্য করার চেয়ে কিছু না করা ভাল। আজকের দিনে ভয়ের কারণ নিষ্ক্রিয়তা নয়, বরং মেকি সক্রিয়তা, ‘সক্রিয় হওয়ার’, ‘অংশগ্রহণ করার’ উগ্র বাসনা, যাতে যা চলছেতার শূন্যতা, অসারতাকে ঢাকা যায়। মানুষ সব সময় কিছু না কিছুতে হস্তক্ষেপ করছে, ‘কাজ করছে’, অ্যাকাডেমিকরা অর্থহীন তর্কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করছেন। সত্যিকারের কঠিন কাজ হল পিছিয়ে আসা, নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন তাঁরা অনেক সময়েই নিঃশব্দতারবদলে বিরোধমূলক, ‘ক্রিটিকাল’ অংশগ্রহণ, ডায়ালগ পছন্দ করেন। ক্ষমতা আমাদের ডায়ালগে ব্যস্ত রেখে আমাদের আশঙ্কাজনক নিষ্ক্রিয়তাকে ভেঙে দেয়। ভোটাররা যে কাউকে ভোট দিলেন না, সত্যিকারের এই রাজনৈতিক কাজ আমাদের আধুনিক গণতন্ত্রের শূন্যগর্ভ অবস্থানের সম্মুখীনকরিয়ে দেয়।

উপন্যাসের এই ঘটনা পর্তুগাল বা অন্য গণতান্ত্রিক দেশে এখনও হয়নি। কিন্তু হতে পারে। আমরা ভাবতে পারি, উপন্যাসে সরকারের বিদ্বেষপূর্ণ প্রতিক্রিয়া বস্তুত র্যাডিকাল ডেমোক্র্যাটদের প্রতি সাবধানবাণী। কিন্তু সারামাগো চান, র্যাডিকাল গণতন্ত্রের জন্য যে কত কিছু প্রয়োজন, তানিয়ে আমরা চিন্তা করি। এই উপন্যাসে যে সব মানুষের কথা বলা হয়েছে তাদের নাম নেই, শুধু ভূমিকা আছে: বিচারবিভাগের মন্ত্রী, ডাক্তারের স্ত্রী, পুলিশ, পোলিং স্টেশনের অফিসার ইত্যাদি। চরিত্র ও ডায়ালগকে ক্লাস্টার করা হয়েছে এক সামাজিক ফর্মে, যেন সম্পূর্ণ কালচার কথা বলছে, কাজ করছে তার পরিচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে।

আরও পড়ুন: মোদীকে ট্যাবলো-বার্তা মমতা ও কেজরীবালের

আজকের গণতন্ত্রের জনপ্রিয়তার কোনও ঐতিহাসিক তুলনা মেলা ভার, কিন্তু এই গণতন্ত্র ধারণার দিক থেকে বাধাবন্ধনহীন এবং বাস্তবে শূন্যগর্ভ। গণতন্ত্রের অর্থের ও প্র্যাকটিসের এই উন্মুক্ততা ও শূন্যগর্ভতাই হয়তো এর জনপ্রিয়তার কারণ। গণতন্ত্র হয়ে উঠেছে এক ফাঁকা সিগনিফায়ার বাচিহ্নক, যার সঙ্গে যে-কেউ তার আশা বা স্বপ্ন যুক্ত করতে পারে। অথবা হয়তো পুঁজিবাদ শেষ অবধি গণতন্ত্রকে একটা ‘ব্র্যান্ড’-এ পরিণত করেছে। এ হল শেষ পর্বের আধুনিকতার কমোডিটি ফেটিশিজমের উপর একটি প্যাঁচ, যেখানে একটি পণ্যের বিক্রেয় ইমেজ তার ভিতরের উপাদান থেকেসম্পূর্ণ বিযুক্ত। বা গণতন্ত্র এক নতুন পীঠ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE