Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Custodial Death

রোম উপড়ে, মাংস খুবলে অত্যাচার থানায়, মৃত্যু বাবা-ছেলের

এই ঘটনার প্রতিবাদে কার্যত আগুন জ্বলছে তামিলনাড়ু জুড়ে। পুলিশি নৃশংসতার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছেন সাধারণ মানুষ।

জয়রাজ এবং বেনিকস। ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত।

জয়রাজ এবং বেনিকস। ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত।

সংবাদ সংস্থা
চেন্নাই শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২০ ১৭:১৯
Share: Save:

লকডাউনের মধ্যে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দোকান খুলে রেখেছিলেন। সেই ‘অপরাধ’-এ এক প্রৌঢ় এবং তাঁর ছেলেকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ উঠল তামিলনাড়ু পুলিশের বিরুদ্ধে। মৃতেরা হলেন পি জয়রাজ (৫৮) এবং ইম্যানুয়েল বেনিকস (৩১)। হেফাজতে থাকাকালীন নৃশংস শারীরিক অত্যাচার চালানোর পাশাপাশি তাঁদের উপর যৌন নির্যাতন চালানো হয় বলেও অভিযোগ উঠছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে কার্যত আগুন জ্বলছে গোটা রাজ্যে। পুলিশি নৃশংসতার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছেন সাধারণ মানুষ। পুলিশের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করতে হবে বলে দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, পি জয়রাজ পেশায় কাঠের ব্যবসায়ী। তাঁর ছেলে ইম্যানুয়েল একটি মোবাইলের দোকান চালাতেন তুতিকোরিনে। ঘটনার সূত্রপাত গত ১৯ জুন। ওই দিন সন্ধ্যায় বাবা-ছেলে ওই দোকানে ছিলেন। রাত সওয়া ৮টা নাগাদ দোকানের শাটার নামাতে যান জয়রাজ। নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট পর কেন দোকান বন্ধ করা হচ্ছে, তা নিয়ে এলাকায় টহল দেওয়া পুলিশকর্মীদের সঙ্গে তাঁর বচসা বাধে। ছেলে ইম্যানুয়েলও সেই বচসায় জড়িয়ে যান। কিছু ক্ষণ পর বিষয়টি মিটে যায়। দু’জনে বাড়ি ফিরে যান।

পরের দিন ফের দোকান খোলেন ইম্যানুয়েল। স্থানীয়দের অভিযোগ, সে দিন রাত পৌনে ৮টা নাগাদ একদল পুলিশকর্মীকে নিয়ে দোকানে হাজির হন স্থানীয় সাথানকুলাম থানার সাব ইনস্পেকটর বালকৃষ্ণণ। সেই সময় দোকানে জয়রাজও উপস্থিত চিলেন। আগের দিনের ঘটনা নিয়ে নতুন করে তর্ক শুরু হয়। এর পরেই জয়রাজকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেয় পুলিশ। এক বন্ধুর সঙ্গে দোকানের ভিতর দিকে ছিলেন ইম্যানুয়েল। বাবাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি আটকাতে যান। কিন্তু তাঁকে থানায় আসতে বলে জয়রাজকে নিয়ে চলে যায় পুলিশের গাড়ি।

আরও পড়ুন: করোনার সামনে আত্মসমর্পণ মোদীর, অভিযোগ রাহুলের​

এর পর পাঁচ বন্ধুর সঙ্গে আইনজীবী নিয়ে থানায় পৌঁছন ইম্যানুয়েল। কী অপরাধে তাঁর বাবাকে থানায় আনা হয়েছে, তা পুলিশের কাছে জানতে চান তিনি। সদুত্তর না পেয়ে পুলিশের সঙ্গে ফের বচসা শুরু হয়। তার জেরে তাঁকেও হাজতে পোরার নির্দেশ দেয় পুলিশ। ইম্যানুয়েলের এক বন্ধু রাজেশ সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করেন, তাঁদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে কয়েক জন পুলিশকর্মী মিলে হাজতের মধ্যে ইম্যানুয়েল ও তাঁর বাবাকে বেধড়ক মারধর করেন। মাঝ রাত পর্যন্ত লাঠি দিয়ে তাঁদের পেটাতে থাকে পুলিশ— এমনটাই অবিযোগ রাজেশের। ভোররাতের দিকে আইনজীবী ও ইম্যানুয়েলের বন্ধুদের পুলিশ থানা থেকে চলে যেতে বলে।

ইম্যানুয়েলের বন্ধুদের দাবি, তার পর দিন অর্থাৎ ২১ জুন সকাল ৭টা নাগাদ ফের আইনজীবী নিয়ে থানায় হাজির হন তাঁরা। তখন তাঁরা জানতে পারেন, জয়রাজ এবং ইম্যানুয়েলের বিরুদ্ধে ১৮৮ (সরকারি নির্দেশ অমান্য), ৩৫৩ (সরকারি কর্মীকে কাজে বাধা দেওয়া), ২৬৯ (দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে জীবননাশক সংক্রমণ ছড়ানো) এবং ৫০৬ (২) (অপরাধমূলক হুমকি) ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে। রক্তাক্ত অবস্থায় জয়রাজ এবং ইম্যানুয়েলকে তাঁরা দেখতে পান তাঁরা তানায়। ইম্যানুয়েলের আইনজীবী এস মণিমারন জানিয়েছেন, হাজতের যেখানে জয়রাজ এবং ইম্যানুয়েলকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, সেই জায়গাটা রক্তে ভেজা ছিল।

মণিমারন আরও জানান, জয়রাজ এবং ইম্যানুয়েলের জন্য তাঁরা পরিষ্কার জামাকাপড় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটা পরিয়ে তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। হাসপাতালে যাওয়ার পথে গাড়িতে তাঁদের বসার আসনের উপর কম্বল পাতা হয়েছিল। কিন্তু বাবা-ছেলের শরীর থেকে এত রক্ত বেরোচ্ছিল যে, সেই কম্বলটাও ভিজে যায় বলে অভিযোগ মণিমারনের। তিনি জানান, তাঁর মক্কেলরা জানিয়েছেন, হাজতের ভেতর মারধরের পাশাপাশি তাঁদের মলদ্বারে লাঠি ঢুকিয়ে অত্যাচার চালায় পুলিশ। ছেলের পিঠ থেকে খুবলে মাংস তুলে নেওয়া হয়। দু’জনের বুকে রোম ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। ইম্যানুয়েলের শরীরের একাধিক জায়গা থেকে চামড়া তুলে নেওয়া হয় বলেও মণিমারনের অভিযোগ।

আরও পড়ুন: লাদাখের পি পি ১৪-র কাছে ফের ভারতীয় এলাকা দখল করল চিন

জয়রাজ ও তাঁর ছেলেকে ওই অবস্থায় দেখেও হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাঁদের দু’জনকেই ‘ফিট সার্টিফিকেট’ লিখে দেন। শুধু তাই নয়, হাসপাতালে থাকাকালীন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বাবা-ছেলেকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার আর্জি জানায় পুলিশ। দু’জনকে না দেখেই তাতে অনুমতি দেন ম্যাজিস্ট্রেট। এমনটাই অভিযোগ মণিনারনের।

ওই আইনজীবীর দাবি, হাসপাতাল থেকে কোভিলপট্টি উপ সংশোধনাগারে নিয়ে যাওয়া হয় জয়রাজ ও তাঁর ছেলেকে। সেখানে তাঁদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে সন্ধ্যায় কোভিলপট্টি হাসপাতালে পাঠানো হয় দু’জনকে। সোমবার সন্ধ্যায় বুকে ব্যথা শুরু হয় ছেলে ইম্যানুয়েলের। রাতে ওই হাসপাতালেই মৃত্যু হয় তাঁর। মঙ্গলবার সকালে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দেওয়ার পর মারা যান তাঁর বাবা জয়রাজও।

হাসপাতাল থেকে বাবা-ছেলের দেহ নিতে অস্বীকার করেন তাঁদের পরিবারের লোকজন। যত ক্ষণ না পুলিশের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের হচ্ছে, তত ক্ষণ দেহ সৎকার করবেন না বলে জানিয়ে দেন তাঁরা। মাদ্রাজ হাইকোর্টের তরফে বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস মেলার পর দেহ সৎকার করেন তাঁরা। জয়রাজের মেয়ে পার্সিস সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘‘জামিন হয়ে যেত বাবা-দাদার। সব বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছিল। বুধবারই দু’জনের বাড়ি ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে ওদের চিরতরে ছিনিয়ে নেওয়া হল। নৃশংস অত্যাচার চালানো হয় ওদের উপর। আমি মেয়ে হয়ে, বোন হয়ে কী ভাবে আঘাতগুলো বর্ণনা করব! মাকে পর্যন্ত বলতে পারিনি।’’

এই ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসতেই পথে নেমে পড়ে জনতা। মঙ্গলবার সাথানকুলাম থানার সামনে ধর্নায় বসেন কয়েকশো মানুষ। বুধবার তুতিনকোরিনের সমস্ত দোকান বন্ধ রেখেছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই ঘটনার প্রতিবাদে গলা চড়িয়েছেন বহু মানুষ। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে প্রাণ হারানো জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার সঙ্গে এই ঘটনার তুলনা করছেন অনেকে। যদিও রাজ্য সরকার বা রাজ্য পুলিশের তরফে এখনও পর্যন্ত কোনও সরকারি বিবৃতি দেওয়া হয়নি। হাইকোর্ট ওই দু’জনের ময়নাতদন্তের ভিডিয়ো রেকর্ডিং চেয়ে পাঠিয়েছে। একই সঙ্গে কোভিলপট্টই হাসাপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজও চেয়ে পাঠিয়েছে আদালত।

পুলিশের এই আচরণের জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে এআইএডিএমকে সরকারও। রাজ্য সরকারকেই এর দায় নিতে হবে বলে জানিয়েছেন ডিএমকে নেতা এমকে স্ট্যালিন। দলের সাংসদ কানিমোঝি দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের আর্জি জানিয়েছেন। সিবিআইকে গোটা ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হোক বলে দাবি তুলেছে কংগ্রেস। পুলিশের ভূমিকায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গাঁধী। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশি নৃশংসতা এক ভয়ঙ্কর অপরাধ। দুঃখের বিষয়, যে পুলিশ আমাদের রক্ষাকর্তা, এখানে তাঁরাই উৎপীড়নকারী। রাজ্য সরকারের কাছে সঠিক নিরপেক্ষ তদন্তের আর্জি জানাই।’’

জিগনেশ মেবানির টুইট।

তুতিকোরিনের এই ঘটনার বিরুদ্ধে গোটা দেশের গর্জে ওঠা উচিত বলে মত গুজরাতের বদগাম কেন্দ্রের বিধায়ক জিগনেশ মেবানির। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে বিনোদন জগতের যে সমস্ত তারকারা ভারতে বসে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তাঁরা তুতিকোরিনের ঘটনায় চুপ কেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। টুইটারে জিগনেশ লেখেন, ‘‘বলিউডের তারকাদের বলছি, আপনারা কি তামিলনাড়ুর ঘটনাটা শুনেছেন? নাকি শুধুমাত্র অন্য দেশের জন্যই ইনস্টাগ্রামের কার্যকলাপ সীমিত? ভারতে জর্জ ফ্লয়েডের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। এই ধরনের পুলিশি নৃশংসতা এবং যৌন নির্যাতন অত্যন্ত বেদনাদায়ক।’’

প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার টুইট।

তামিলনাড়ুর ঘটনায় ইতিমধ্যেই টুইটারে সরব হয়েছেন প্রিয়ঙ্কা চোপড়া। তিনি লিখেছেন, ‘‘যা শুনলাম, তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। গোটা ঘটনায় আমি বাকরুদ্ধ। খুব রাগ হচ্ছে। অপরাধ যত গুরুতরই হোক না কেন, এই নৃশংসতা কারও প্রাপ্য নয়। সাজা না দিয়ে অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সত্যটা জানা দরকার। ওই পরিবারটি কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তা কল্পনাও করতে পারছি না। ওঁদের জন্য প্রার্থনা করছি। একজোটে এর বিরুদ্ধে সরব হওয়া উচিত আমাদের। জয়রাজ এবং বেনিকসের জন্য সুবিচার চাই।’’

শিখর ধওয়নের টুইট।

ক্রিকেটার শিখর ধওয়ন টুইটারে লেখেন, ‘‘তামিলনাড়ুতে জয়রাজ এবং বেনিকসের উপর যে নৃশংস অত্যাচার চালানো হয়েছে, তাতে স্তম্ভিত আমি। ওই পরিবার যাতে সুবিচার পায়, তার জন্য একজোটে সরব হওয়া উচিত আমাদের।’’

জয়রাম রবির টুইট।

তামিল অভিনেতা জয়রাম রবি বলেন, ‘‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এই অমানবিক ঘটনায় সুবিচার চাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE