‘ঘুমোও। শান্তিতে থেকো’। মঙ্গলের বুকে নাসার রেকর্ড গড়া রোভার অপচুনিটি।
এ বার আমরা খুব ‘মিস’ করব ‘মিস অপরচুনিটি’কে! সে আর সাড়া দেবে না আমাদের ডাকে। আর বার্তাও পাঠাবে না আমাদের জন্য। ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গল থেকে।
গত জুন থেকে এ বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১ হাজারটি সিগন্যাল পাঠানো হয়েছে রোভার অপরচুনিটিকে। বলা হয়েছে, ‘'ওপি (অপরচুনিটির ডাক নাম) জেগে ওঠো। হাই, হ্যালো বলো। সাড়া দাও, প্লিজ।’’ জাগিয়ে তোলার জন্য শেষ বারের মতো তাকে বার্তা (সিগন্যাল বা কম্যান্ড) পাঠিয়েছিল নাসা। ‘‘হাই ওপি, হাই... হ্যালো’। কিন্তু না, আর ঘুম থেকে জেগে উঠল না অপরচুনিটি। তার সঙ্গে ‘কথা বলা’র আর সুযোগই দিল না আমাদের।
ফলে, বুধবার রাতে ওয়াশিংটনে সদর দফতরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে নাসা জানিয়ে দিল, অপরচুনিটি আর নেই। প্রায় ১৫ বছর ধরে মঙ্গল আর পৃথিবীর মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম সেতু হিসেবে কাজ করার পর অপরচুনিটি চলে গিয়েছে শেষ ঘুমে।
অপরচুনিটি রোভার: দেখুন নাসার ভিডিয়ো
সর্বনাশা ঝড়ই কাড়ল অপরচুনিটিকে!
গত বছরের জুনের গোড়ার দিকে পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরি (জেপিএল)-র সঙ্গে শেষ বারের মতো বাতচিত হয়েছিল অপরচুনিটির। তার পর সেই ভয়ঙ্কর ঝড় উঠল মঙ্গলের এক প্রান্তে। আর তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল গোটা মঙ্গলে। অপরচুনিটি ছিল তখন মঙ্গলের প্রেজারভেন্স ভ্যালিতে। সেই ‘প্রাণঘাতী’ ঝড় আর তার সঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া ধুলোবালিতেই ‘অন্ধ’ হয়ে যায় রোভার অপরচুনিটির ক্যামেরা, সিগন্যাল রিসিভার ও সেন্ডার যন্ত্রগুলি।
আরও পড়ুন- দেড় দশক ধরে মঙ্গলের মাটিতে থাকা ‘অপরচুনিটি’ এখনও কোমায়!
আরও পড়ুন- গত ২০ বছরে আরও সবুজ হয়েছে বিশ্ব, নেতৃত্বে ভারত-চিন, বলছে নাসা
কত পথ হাঁটাহাঁটি মঙ্গলের বুকে...
২০০৩ সালে ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল এয়ারফোর্স স্টেশন থেকে রওনা হয় অপরচুনিটি। মঙ্গলে পা ছোঁয়াবে বলে। সাত মাস পর ২০০৪-এর ২৪ জানুয়ারি মঙ্গলে নামে অপরচুনিটি। লাল গ্রহের ‘মেরিডিয়ানি প্লেনাম’ এলাকায়। তার ‘যমজ বোন’ রোভার ‘স্পিরিট’ মঙ্গলে পা ছুঁইয়েছিল ঠিক তার ২০ দিন আগে। স্পিরিট অবশ্য নেমেছিল মঙ্গলের আর এক প্রান্তে। ১০৩ মাইল (১৬৬ কিলোমিটার) চওড়া ‘গুসেভ ক্রেটার’ এলাকায়। স্পিরিট অবশ্য খুব বেশি দিন বাঁচেনি। মঙ্গলের বুকে স্পিরিট ঢুঁড়ে বেরিয়েছিল ৫ মাইল (৮ কিলোমিটার) এলাকা। ২০১১-য় শেষ হয়ে যায় স্পিরিটের মিশন।
মঙ্গলের বুকে যে পথ ধরে হেঁটেছে রোভার অপরচুনিটি, গত ১৪ বছরে
নাসার বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, রুখুসুখু লাল গ্রহে বড়জোর ৯০টি দিন (মঙ্গলের দিন) টিঁকতে পারবে অপরচুনিটি। সেই সব হিসেব ওলটপালট করে দিয়ে মঙ্গলে ৫ হাজার দিন (মঙ্গলের দিন) সক্রিয় থেকেছে অপরচুনিটি। এখনও পর্যন্ত মঙ্গলের বুকে আর কোনও রোভারের এত বেশি দিন ধরে সক্রিয় থাকার রেকর্ড নেই। সেই নজির গড়েছে অপরচুনিটি।
পাহাড়চুড়ো থেকে গভীর নদীখাতে
আর শুধুই বেঁচেবর্তে থাকা নয়। কাজও করেছে বিস্তর ৩৮৪ পাউন্ড (১৭৪ কিলোগ্রাম) ওজনের এই রোভার। কখনও অপরচুনিটি এগিয়েছে বিশাল বিশাল পাথর, দৈত্যাকার পাথরের বোল্ডার বা চাঙড়ের উপর দিয়ে, কখনওবা বড় বড় নুড়ি-পাথর বিছোনো ঢালু পথ ধরে পাহাড়ে উঠেছে, নেমেছে। এক পাহাড় থেকে গিয়েছে অন্য পাহাড়ে। চড়েছে অধুনা মৃত বিশাল বিশাল আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে। চড়েছে পর্বতচুড়োয়। আবার তরতরিয়ে নেমে গিয়েছে শুকিয়ে যাওয়া নদীর গভীর খাদে।
ঝুলিতে যে রেকর্ডগুলি রয়েছে অপরচুনিটির
২০০৪-এর জানুয়ারি থেকে ২০১৮-র জুন, এই ১৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে মঙ্গলের বুকে কী কী কাজ করেছে অপরচুনিটি?
১) এক দিনে মঙ্গলের বুকে সবচেয়ে বেশি পথ হেঁটেছিল এই রোভারই। ৭২১ ফুট বা ২২০ মিটার। ২০০৫-এর ২০ মার্চ। এই রেকর্ড নেই আর কোনও রোভারের। না, আর এক রোভার ‘মিস কিউরিওসিটি’রও নেই।
২) মঙ্গলে পথ হেঁটেছে ১ হাজার ১০০ গজ বা ১ হাজার মিটার। যা একটি রেকর্ড।
৩) জেপিএল-এ নাসার গ্রাউন্ড স্টেশনে পাঠিয়েছে ২ লক্ষ ১৭ হাজারেরও বেশি ছবি। এটিও রেকর্ড।
৪) ৫২টি দৈত্যাকার শিলাখণ্ডের হদিশ দিয়েছে। যেগুলি ভরে রয়েছে বিভিন্ন রকমের খনিজ পদার্থে। ব্রাশ দিয়ে আরও ৭২টি শিলাখণ্ডকে ঝেড়ে-পুঁছে পরিষ্কার করেছে। যাতে ওই শিলাখণ্ডগুলিও খনিজ পদার্থ ভরা কি না, তা স্পেকট্রোমিটার ও মাইক্রোস্কোপিক ইমেজার যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা যায়। এটাও রেকর্ড।
৫) মঙ্গলের বুকে যেখানে প্রথম পা ছুঁইয়েছিল অপরচুনিটি, সেখানেই সে প্রথম হদিশ দিয়েছিল খনিজ পদার্থ হেমাটাইটের। জলে যে খনিজের জন্ম হয়। অভূতপূর্ব আবিষ্কার।
৬) ‘এনডেভার ক্রেটার’ এলাকা আবিষ্কার করেছিল অপরচুনিটি রোভার। এমনকী, এমন ইঙ্গিতও দিয়েছে, ওই এলাকায় এখনও কোনও কোনও বিশাল হ্রদে জল রয়েছে তরল অবস্থায়।
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy