Advertisement
E-Paper

ভাল নাম হিমালয় ডাক নাম হিমু

হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র। পরিচয় দিচ্ছেন অমিতাভ মিত্র‘‘আমি ঘরে ঢুকতেই স্যার বললেন, গত রাতে অকল্পনীয় এক ঝামেলা হয়ে গেছে। কী হয়েছে মন দিয়ে শোনো। ঘুমুতে গেছি রাত দশটা একুশ মিনিটে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলাম আমি ইলেকট্রন হয়ে গেছি। কী হয়ে গেছেন? ইলেকট্রন। ইলেকট্রন চেনো না? চিনি। ইলেকট্রন হয়ে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছি।’’

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৪

‘‘আমি ঘরে ঢুকতেই স্যার বললেন, গত রাতে অকল্পনীয় এক ঝামেলা হয়ে গেছে। কী হয়েছে মন দিয়ে শোনো। ঘুমুতে গেছি রাত দশটা একুশ মিনিটে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলাম আমি ইলেকট্রন হয়ে গেছি।

কী হয়ে গেছেন?

ইলেকট্রন। ইলেকট্রন চেনো না?

চিনি।

ইলেকট্রন হয়ে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছি।

আমি বললাম, আপনার তো তা হলে ভয়ঙ্কর অবস্থা।

বল্টুভাই বললেন, ভয়ঙ্কর অবস্থা তো বটেই। তবে আমি কণা হিসেবে ছিলাম না। তরঙ্গ হিসেবে ছিলাম।

ইলেকট্রন হওয়ার পর আপনার ঘুম ভাঙল?

না, আমি সারা রাত ইলেকট্রন হিসেবেই ছিলাম। এখানে ওখানে ছোটাছুটি করেছি। বর্ণনা করার বাইরের অবস্থা। কখনও যে বিছানায় শুয়ে ছিলাম তার খাটে ঢুকে যাচ্ছি। একবার আয়নায় ঢুকে নিজের মিরর ইমেজ দেখলাম।

বলেন কী? অদ্ভুত তো।

আমি নতুন নতুন জায়গায় যাচ্ছি, আর মুখে বলছি অনিকেত।

অনিকেত আবার কী?

বাংলা শব্দ। ডিকশনারি ছিঁড়ে ফেলেছি বলে মানে জানতে পারছি না।

আমি আনন্দিত ভঙ্গিতে বললাম, ইলেকট্রন বাংলা ভাষায় কথা বলে জেনে ভালো লাগছে। যাই হোক, স্যার কি সকালের নাশতা খেয়েছেন?’’

‘‘হিমু এবং হার্ভার্ড PhD বল্টু ভাই’’

বলে দিতে হবে না, এই ‘আমি’টি হচ্ছে হিমু। বিশ্বের এক নম্বর ফাজিল ছেলে!

থানায় বসে যে ওসি সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘‘দিনে ক’প্যাকেট বেনসন অ্যান্ড হেজেস খান?’’

বান্ধবী রূপার বাড়ি রাতদুপুরে ফোন করে জানতে চায়, ‘‘আচ্ছা, এটা কি রেলওয়ে বুকিং?’’ যাতে বান্ধবীর হাইপারটেনসিভ বাবা উত্তেজিত হয়ে চেঁচামেচি জুড়ে দেন আর বান্ধবীটি বুঝে যায় কার ফোন এসেছে।

এই ফাজিল ছেলেই আবার মনে করিয়ে দেবে, আরবি ভাষায় ফাজিল শব্দের অর্থ জ্ঞানী!

প্রায় একুশটির মতো উপন্যাস এই একটি চরিত্রকে ঘিরে, এখনও এই এ পার বাংলাতেও হইহই করে বিক্রি হচ্ছে, তা কি কেবল হাস্যরসের জোরে? হুমায়ূন নিজেও বলেছিলেন, ‘‘মনমেজাজ খারাপ থাকলেই হিমু লিখতে বসি। মন ঠিক হয়ে যায়।’’

লেখক ও পাঠক হিমুর উপন্যাসগুলো দু’জনেরই মন ভাল করে দেয়, এক ধরনের সিরিওকমিক এন্টারটেনমন্ট, যা পাতায় পাতায় আপনাকে হাসাবে, তবু হিমুর কাহিনিগুলো নিছক বিনোদনের জন্য নয়। ফাজলামির ফেনা সরালে নজরে পড়বে এক গাঢ় রসের পাক, তাতে এক দিকে নাগরিক সভ্যতার ভণ্ডামি নিয়ে চোরাবিদ্রুপ, আবার অন্তর্লীন বিষাদ, মায়াবাঁধনের তার কেটে বেরিয়ে আসার করুণ প্রয়াস, মায়াবী কল্পকাহিনি।

হিমু আসলে কে? তার নিজের ভাষায় ঢাকা শহরে সে একজন হণ্টক। চাকরি দিলেও সে করবে না, কারণ সে বেকার নয়, হাঁটা তার কাজ। মাসোহারা জুটে যায় এই শর্তে— সে তার ফুফার ছেলেকে বা ভালমানুষ বড়লোক বন্ধুকে নিজের জীবনদর্শনে প্রভাবিত করবে না। কথা বলে লোককে বিভ্রান্ত করতে সে ওস্তাদ।

অথচ প্রতিটি কাহিনিতেই দেখা যাবে, শেষ পর্যন্ত হিমু সাধারণ মানুষের ভালই করছে। এবং সে নিঃস্বার্থ। নিরুদ্বেগ, কিছুটা নিস্পৃহ, কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাসক্ত নয়। ভালমন্দ খাবার ইচ্ছে হলে অবলীলাক্রমে কোনও বিয়েবাড়িতে ঢুকে যেতে পারে। বড়লোকের সুদর্শনা কন্যারা তার আকর্ষণে পড়ে যায়, হিমুর টেলিফোন-ব্যাধি জেগে ওঠে, সে এক প্লেটোনিক সম্পর্ক গড়ে তোলে, অথচ উদাসীন পুরুষ, কথা দিয়ে কথা রাখে না।

কারণ সে এক প্রেরিত পুরুষ! তার সাইকোপ্যাথ বাবা হিমুকে মহাপুরুষ বানানোর গবেষণায় কী না করেছেন। পোষা টিয়াকেই শুধু নয়, তার মাকেও হত্যা করেছেন যাতে আসক্তি না জন্মায়। পিশাচ প্রকৃতির মামাদের কাছে বড় হয়েছে হিমু, ক্রুঢ়তা যেখানে স্বাভাবিক।

তবু সে হল এক নিস্পৃহ যুবক। মহাপুরুষ হবার অনুশাসন তাকে পুরোপুরি বাঁধতে পারল না, সংসারের মায়াকেও সে সম্পূর্ণ স্বীকার করল না। অথচ পরিব্রাজক হিমু হয়ে গেল নাগরিক সন্তের মতো, আনন্দময়, বিষাদাচ্ছন্ন।

এখানেই প্রশ্ন ওঠে, হিমু কি নীলু?

না, হিমু নীলু নয়। তবু দু’পার বাংলার দুই জনপ্রিয়তম লেখকের অতি জনপ্রিয় দু’টো চরিত্র— হুমায়ূন আহমেদের হিমু আর নীললোহিতের নীলু— তুলনা আসাটাই স্বাভাবিক।

দু’জনেই চালচুলোহীন রোম্যান্টিক যুবক, ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে, আত্মীয়পরিজনের আদর-অনাদরের মাঝে যেন ভেসে বেড়ায়, তবু উদ্বাস্তু নয়।

নীলুর আছে দিকশূন্যপুর। আর হিমুর আছে এক কল্প নদী ময়ূরাক্ষী। ইচ্ছে হলেই সে নদীটাকে বের করতে পারে, এমনকী পছন্দের মানুষজনকে সে নদী তীরে নিমন্ত্রণও করে। স্বচ্ছ নদীর জলে নীল আকাশের ছায়া পড়ে, দু’পারে সবুজ দূর্বাঘাস, গাছের ডালে বিষণ্ণ ঘুঘুর ডাক, আর জল ছিটোতে ছিটোতে চলে যাচ্ছে যে তরুণীটি— সে তার মা!

দিকশূন্যপুর আর ময়ূরাক্ষী— দুটোই বাস্তব থেকে হারিয়ে যাবার ঠিকানা। তবু, নীলুর রোম্যান্টিকতা যেমন বায়বীয় কিশোরকল্পনা, হিমুর চরিত্রে নাগরিক বিষণ্ণতা অনেক প্রবল, সামাজিক প্রেক্ষাপট অনেক প্রকট এবং বিদ্রুপবিদ্ধ। নীলু কখনও মহাপুরুষ হতে চায়নি, হিমু মহাপুরুষ হওয়ার দ্বন্দ্বে দীর্ণ।

আর হিমুর আছে এক প্রফেটিক পাওয়ার। সে যা বলে তা অনেক সময়ই ফলে যায়। ফলত সে কিছুটা সমীহ আদায় করে নেয়। বিজ্ঞানের অধ্যাপক হুমায়ূন সম্ভবত সচেতনভাবেই এই ফ্যান্টাসিটা রচনা করেছেন, যাতে বাস্তব আর পরাবাস্তবের মধ্যে যাতায়াত করতে পারে কাহিনিটি। রিয়্যালিটিকে একটু কাত করে দেখলে যে দর্শন পাওয়া যায় তার আনন্দে।

‘‘কী নাম বললেন আপনার, হিমু?’

জি, হিমু।

হিম থেকে হিমু?

জি-না, হিমালয় থেকে হিমু। আমার ভাল নাম হিমালয়।

ঠাট্টা করছেন?

না, ঠাট্টা করছি না।

আমি পাঞ্জাবির পকেট থেকে ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট বের করে এগিয়ে দিলাম। হাসিমুখে বললাম, সার্টিফিকেটে লেখা আছে। দেখুন।

‘‘হিমু’’

আটপৌরে হিমু নামের আড়ালে এই হিমালয় শব্দটি আছে। আকাশ নয়, হিমালয়। যাকে ছোঁয়া কঠিন হলেও, অসম্ভব নয়।

humayun ahmed amitabh mitra patrika anandabazar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy