সম্প্রতি শান্তিনিকেতনে ও কলকাতায় আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপিত হল। শৈলজারঞ্জনের লেখাতেই আমরা জানতে পারি, ওঁর শান্তিনিকেতনে আসার ব্যাপারে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দান কতখানি। উনি লিখছেন, “জীবনের সব দিকে যে দ্বার খুলে গেল, সেই অনুভূতিটা শান্তিনিকেতনে না গেলে পেতাম না। সাধারণ গৃহস্থ জীবনেই জড়িয়ে থাকতাম।” দিনেন্দ্রনাথ চলে যাওয়ার পর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সব গান শিখিয়ে দিতেন। ডাকতেন ‘গীতাম্বুধি’ (গানের সাগর) বলে। বলতেন— ‘তুমি বলবে, কেমিক্যাল মিউজ়িক বা মিউজ়িক্যাল কেমিস্ট্রি পড়াও’। এর থেকে তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালবাসা ও ভরসার দিকটা নজরে আসে। প্রবাদপ্রতিম এই শিক্ষককে স্মরণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর বহু ছাত্রছাত্রী, বিশ্বভারতী সঙ্গীত ভবন ও সুরঙ্গমার শিল্পীরা।
জন্মবার্ষিকীতে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ‘অগ্নিরক্ষার ঋত্বিক শৈলজারঞ্জন সঙ্গীত সায়হ্নিকা’ নামে পরিবেশিত হয়। শ্রীলেখা চট্টোপাধ্যায় ও পার্থ চক্রবর্তী অনুষ্ঠান সম্পর্কে শ্রোতাদের অবহিত করলেন প্রথমে। সঙ্গীত ভবনের অধ্যাপিকা অর্পিতা দত্ত ও মালিনী মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুরান্তর পরিবেশন করলেন। দু’জনেই অত্যন্ত শিক্ষিত শিল্পী, তাই ছোট ছোট সুরান্তর অনায়াসে বোঝালেন নিজেদের উপস্থাপনায়। এই সূক্ষ্ম সুরান্ত শৈলজারঞ্জন কণ্ঠে ও এস্রাজে ছাত্রছাত্রীদের শেখাতেন। ইতিহাস তার সাক্ষী। বেশ ক’টি গান সেগুলির নেপথ্য কাহিনিসহ পরিবেশিত হয় এ দিনের অনুষ্ঠানে। পাঠে নন্দিতা সর্বাধিকারী ও পার্থ চক্রবর্তী তাঁদের চমৎকার উচ্চারণে বিষয়টি শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরলেন। একক গানে প্রকৃতি মুখোপাধ্যায়, পলাশী ঘোষ ও উত্তম বিশ্বাস অসাধারণ। নৃত্যে বিশেষ করে নিবেদিতা সেনগুপ্ত ও পল্লবী রুজ প্রশংসনীয়। ‘সমুখে শান্তিপারাবার’ গানটি নতুন করে ধরা দিল। গানের লয় গানটিকে দুঃখ ছাপিয়ে শান্তিপারাবার— মুক্তিদাতা ও বিরাট বিশ্বের দ্বার খুলে দিল।
শুভায়ু সেন মজুমদার নিজেই যেন এস্রাজের এক প্রতিষ্ঠান। পারিবারিক ঐতিহ্য বহন করছে তাঁর এস্রাজ। তাঁর নিবেদন বহু দিন শ্রোতাদের স্মরণে থাকবে। পরিবারের সদস্যরা স্মৃতিচারণ করে প্রণতি জানালেন। উঠে এল শৈলজারঞ্জনের শিক্ষা, স্নেহ, বাৎসল্য ও শাসন। এ দিনের শেষ অনুষ্ঠান ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের অংশবিশেষ। প্রাক্তনী দিয়ালী লাহিড়ী চেয়েছিলেন ১৯৫০-’৬০ দশকের শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারা অনুসরণ করে আজকের নৃত্যনাট্য শেখাতে। তাই অক্লান্ত পরিশ্রম করে ‘শ্যামা’ পরিচালনা করলেন। শ্যামার চরিত্রে নৃত্যে নম্রতা লাহিড়ী এবং গানে প্রকৃতি মুখোপাধ্যায় ও শরণ্যা সেনগুপ্ত মন ভরিয়ে দেয়। প্রহরীর গানে উৎস বিশ্বাস ও নাচে রজত দাস বিশেষ ভাবে প্রশংসনীয়। এই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের মধ্যে কেবল একটি গানের স্বরলিপি শৈলজারঞ্জনের করা। সেটি হল ‘হে বিরহী হায়’। এই গানটি শান্তিনিকেতনে সচরাচর হয় না। এ বার সেটি মঞ্চে উপস্থাপন করা হল।
এস্রাজে অনিমেষচন্দ্র চন্দ্র ও সৌগত দাস, তালবাদ্যে শক্তিপ্রসাদ চক্রবর্তী ও দিলীপ বীরবংশী এবং বাঁশিতে দীপক চক্রবর্তী নৃত্যনাট্যকে সম্পূর্ণ করেন। এ দিনের অনুষ্ঠানে আবারও প্রমাণিত হল, শুধু এস্রাজ ও তালবাদ্য সহযোগেও গান বিশেষ মাত্রায় পৌঁছতে পারে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)