Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনের সুইসাইড নোট

গুরুমশাই শিব্রাম চক্রবর্তীকে কেবলই অবজ্ঞা করে চলেছে বাঙালি। তাই এ প্রাণ রেখে লাভ কী! ওঁদের মনের কথা জেনে ফেললেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়নৌকা ছাড়ল। দড়ির বাঁধন আলগা করল মাঝি। সাধারণত ছেলেমেয়েদের বিকেলের দুষ্টু সফরটাই মাঝির চেনা। কিন্তু আজ হঠাৎ ভোর ভোর দুই জীর্ণ, ক্লান্ত বয়স্ক সেকেলে মানুষকে গঙ্গা ভ্রমণে দেখে সে বেশ অবাক। তবু লক্ষ্মী সে ভোরেও লক্ষ্মী, রাতেও লক্ষ্মী! নৌকা চলল। এরা শিব্রামের দুই প্রিয় পাত্র বা মুখপাত্র হর্ষবর্ধনবাবু ও গোবরধনবাবু। বাবুটা বয়স মাথায় রেখে বলা হলেও একদমই নামের সঙ্গে ম্যাচ করছে না। তাই হর্ষ ও গোবর বলা হবে।

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

দৃশ্য: ১

প্রিন্সেপ ঘাট/গঙ্গাতীর/ভোর/দিন

নৌকা ছাড়ল। দড়ির বাঁধন আলগা করল মাঝি। সাধারণত ছেলেমেয়েদের বিকেলের দুষ্টু সফরটাই মাঝির চেনা। কিন্তু আজ হঠাৎ ভোর ভোর দুই জীর্ণ, ক্লান্ত বয়স্ক সেকেলে মানুষকে গঙ্গা ভ্রমণে দেখে সে বেশ অবাক। তবু লক্ষ্মী সে ভোরেও লক্ষ্মী, রাতেও লক্ষ্মী!

নৌকা চলল। এরা শিব্রামের দুই প্রিয় পাত্র বা মুখপাত্র হর্ষবর্ধনবাবু ও গোবরধনবাবু। বাবুটা বয়স মাথায় রেখে বলা হলেও একদমই নামের সঙ্গে ম্যাচ করছে না। তাই হর্ষ ও গোবর বলা হবে।

হর্ষ: এমনিই আমাদের ভুলে মেরেছে মানুষ!!! মিস্টার নিওটিয়ার নাম ছাড়া কলকাতা বা বঙ্গদেশে আর আমার নামের কোনও অস্তিত্বই নেই!

গোবর: আগে তাও গোবর ফোবর দেখলে লোকের মনে পড়ত আমার নাম; এখন তো খাটাল সরিয়ে দেওয়ার পর সেটাও নেই। গরুই বেপাত্তা, গোবর থাকবে কী করে!

হর্ষ: তাই বলছি, এই ডিশিসনটা ফালতু হঠকারিতা হয়ে যাচ্ছে না তো?

গোবর: মানে?

হর্ষ: ঠিকই বলতেন স্যার, তোর মাথাতেও তোর নাম ভরা আছে। একবারে ধরতে পারিস না।

গোবর: মানে?

হর্ষ: কারও মনেই যখন আর আমরা নেই, তখন গঙ্গাবক্ষে আত্মহত্যার প্ল্যানটা কি নিতান্তই স্টুপিডিটি হচ্ছে না? মরেও যাব, অথচ কোনও লোকে জানতেও পারল না!

গোবর: টিভিতে দেখলে তো জানবেই।

হর্ষ: ভুলে যাওয়া মানুষদের নিয়ে ব্রেকিং নিউজ হয় নাকি! ... সুইসাইড নোটটাও গণ্ডগোল হয়ে গেল।

গোবর: কেন? সব লেখোনি?

হর্ষ: বাঃ! বাঃ!

গোবর: কী হল? কিছুই তো বলিনি! বাঃ বাঃ করছ কেন?

হর্ষ: কী বললি? আবার বল কথাটা!

গোবর: বললাম, ‘কেন? সব লেখোনি?’

হর্ষ: এই তো! স্যার বেঁচে থাকলে এক্ষুনি কথাটা লুফে নিতেন। বলতেন ‘সুইসাইড নোট’-এর বাংলা হল ‘শব লেখনী’! বাঃ বাঃ!

মাঝি এ সব কিছুই বুঝতে পারছিল না, অথচ সম্মোহিত হয়ে শুনতে থাকল।

গোবর: সুইসাইড নোটের গণ্ডগোলটা তো বললেই না!

হর্ষ: ঘরে রেখে আসা উচিত ছিল।

গোবর: তার পর কেউ খুঁজেই পেত না, জানতেও পারত না, আমাদের কী কারণ এ’রম ভাবে চলে যাওয়ার, মানে ঝাঁপ দেওয়ার!

হর্ষ: জলে ঝাঁপ দিলে তো এমনিই সব বক্তব্য ধুয়ে যাবে জলে।

পকেট থেকে সুইসাইড নোট বের করে। গোবর কাগজগুলো নেয়।

গোবর: সুইসাইড নোট এটা! এত বড় নোট!!

হর্ষ: নোট ক্রমশ বড় হচ্ছে গোবরা! আগে ১০০ টাকা ছিল সবচেয়ে বড় নোট, এখন ৫০০, ১০০০ হয়ে গেছে নোট! শুনছি ৫ হাজার ১০ হাজারও আছে!!! সুইসাইড নোটও বাড়ছে। জীবন বাড়ছে, সমস্যা বাড়ছে, মৃত্যুর কারণ বাড়ছে, নোটও বাড়ছে!

গোবর: ১টাকা ২টাকা ৫ টাকা তো আর নেই!

হর্ষ: সহজ সরল অল্প দামের সব আনন্দই আজ অচল গোবরা! তাই আজ শিব্রাম চক্রবর্তীর কথার, মজার আর কদর করছে না মানুষ। কথার খেলা, কথার জট, ছোট ছোট হাস্যরসের দশা ওই ১টাকা ২টাকার নোটের মতো!

গোবর: তুমি আমায় যতই হেয় করো এখুনি একটা দুরন্ত আইডিয়া দেব...!

হর্ষ: দে।

গোবর: তোমার ওই সুইসাইড নোটবইটা তুমি মাঝিকে রাখতে দাও।

... তার পর আমরা জলে ডুবে গেলাম লাফ দিয়ে; আমাদের কথাগুলো লেখা রইল ওই সুইসাইড নোটবুকে!

হর্ষ: শাবাস গোবরা!

গোবর: গোবর অত হেয় করার জিনিস নয়, উঠোন ল্যাপা, ঘুঁটের কথাটা ভুলো না।

হর্ষ: মাঝিভাই, এই কাগজগুলো তোমার কাছে রাখো তো! পরে ফেরত নেব, কেমন?

মাঝি: দ্যান।

মাঝি কাগজের গোছটা নিয়ে নেয়। নেড়ে, উল্টে দেখে।

গোবর: ধরো মাঝি, এখন ঝড় উঠল, নৌকা গেল উল্টে!

মাঝি: এ আবার সকাল-সকাল কী অলক্ষুনে কথা!

গোবর: বললাম তো ‘ধরো’। ধরো আমরা দু’জন সাঁতার জানি না। ডুবে গেলুম। পুলিশ কাকে ধরবে?

মাঝি: আমায়!

হর্ষ: তখন তুমি এই কাগজের গোছ দিয়ে বলবে, ‘‘আমার নৌকাতে দুটো স্কাউ বয়েট উঠেছিল, তারা দুটোই মরেছে। ইচ্ছে করে! এই নিন ওদের শব লেখনী!’’

মাঝি একটু আধটু লেখাপড়া তো জানতই— এ সব কথা শুনে সে কাগজগুলো পড়তে শুরু করল— তাতে লেখাটা এরম—

‘‘আমরা দুই ভাই হর্ষবর্ধন ও গোবরধন সজ্ঞানে মনস্থির করেছি যে অবহেলার এই জীবন অহেতুক ধরে রাখার কোনও তাৎপর্য নাই। তাই পবিত্র গঙ্গাবক্ষে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে আপনাদের আধুনিক রসের দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেব। আমাদের সৃষ্টিকর্তা মাননীয় শ্রী শিব্রাম মহাশয়ও আজ দু-একটি প্রজন্মের মানুষের মনে ও হাল্কা আড্ডার আসরে ক্ষীণ ভাবে বেঁচে আছেন। গুরুগম্ভীর শিক্ষিত বঙ্গসমাজে তিনি উপবীত ছাড়া এক ব্রাহ্মণের মতো অনাদরে রইলেন। এ বড় দুঃখের।

রবিবাবুর কাজ, কথা, গানকে বঙ্গসমাজ যে পূজার আসন দিয়েছেন তার সিকিভাগও চক্রবর্তীবাবুর জুটল না। অনাড়ম্বর মেসবাড়ির মতো ছোট ছোট মজার তোড়া হয়েই রইলেন তিনি! বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম ওঁর বই বুকর‌্যাকে দেখেই অভ্যস্থ; যারা একটু মনোযোগী তারা মুখের আঁচিলগুলো কেবল মনে রেখেছেন! নইলে সত্তর শতাংশের একই প্রশ্ন, ‘‘হু ইজ হি?!?’’ আমরা এই অপরিচিতের জীবন চাই না!

গন্ডায় গন্ডায় টিভি সিরিয়াল হয়। চোখের বালি বারবার সিনেমা হয়েও আবার টিভিতে লোক দেখছে। শরৎবাবুর তো হিন্দি ছবির বাজারটাও বেশ জমজমাট। কী ভাবে যে উনি বম্বে ফিলিম দুনিয়াটার সঙ্গে একটা টাচ্ রেখে গেছেন! শরদিন্দুবাবুকে তো বঙ্গদেশ মরণোত্তর যে সম্মান দিল তা অকল্পনীয়!

বিশেষ করে ব্যোমকশবাবুকে নিয়ে কলকাতা ও বোম্বাইতে যা একটা টানাপোড়েন চলছে! যে কোনও দর্শন ও যে কোনও বয়সের মানুষ ব্যোমকেশ হয়ে অভিনয় করলেই দেখছি ছবি হিট! এমনকী সিরিয়ালেও ব্যোমকেশ ও অজিত সাহেবের খুব দর! হাঁদা ভোঁদা হল, টেনিদা হল, আরো কত ‘দা’ হল অথচ শিব্রাম স্যারের কথা ভেবে আজ কেউ ... ওনার কথা না ভাবলে হর্ষবর্ধন গোবরধনের কথা কেই’বা ভাববে! আর ভাবনাতেই যদি না বাঁচে মানুষ তাহলে কেবল দেহটা বয়ে বেড়িয়ে কী লাভ?

সত্যজিৎবাবুর মধ্যে মাঝে মাঝে স্যারের ঝলক দেখতাম, গর্ব হত! আমরা বসে বসে ভাবতাম কী এমন হল আজ যে, গালিগালাজ আর আমিষ মজা ছাড়া বাঙালি মোটেই হাসছে না! মাঝে সময় কাটাতে দু একটি মজার বাংলা ছবিও দেখেছি। কেবল সময় কাটানোটা মিছে কথা, বলতে পারেন রগড়ের জল মাপতে গিয়েছিলাম! সে তো লোকে হেসেই খুন! অট্টহাস্য যাকে বলে! সব বয়সের মানুষ গায়ে গায়ে ধাক্কা মেরে হাততালি দিয়ে হাসছে! অথচ পর্দায় যা দেখছি তা বাপ জ্যাঠাদের সামনে দেখা তো দূরের কথা, উচ্চারণও করতে পারব না! হিন্দিতেও দেখেছি মজার বিষয় কিছুতেই আর কোমর পেরিয়ে উপরে উঠছে না!

ওদিকে শিব্রাম স্যারের লেখা কিছুতেই মগজ পেরিয়ে বড়জোর হৃদপিণ্ড অবধি নামে। কোমর তো বহু দূর! চলবে কেন বলুন?

তাই অমন মগজওয়ালার মুণ্ডচ্ছেদ সংস্কৃতি জীবন থেকে। আর সেই শোকের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভাগ তো আমাদেরই জোটা উচিত। তাই ‘ঝপাং’ ছাড়া আর কোনও পথ নেই। আগে গোবরধন লাফ দেবে, তলিয়ে যাবে; পরে আমি। নীচে গোবরধন, মাঝে গঙ্গা, উপরে আমি হর্ষবর্ধন। ওয়ান বাই ওয়ান কাটাকুটি হয়ে চিরকালের জন্য ‘ডিলিট’ হয়ে এক হয়ে যাব।

কিন্তু যাওয়ার বেলায় একটাই চিন্তা নিয়ে গেলাম— বাঙালির হল কী? ‘শুভ নববর্ষ’ বলে জড়িয়ে ধরে, মিষ্টি খায়, বিয়ার-মাংস খায় অথচ কোন বাংলা সাল তা জানে না! এমনকী বাংলা নববর্ষেও ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে, আর উত্তরে আসে ‘সেম টু ইউ’! জটিল জীবনযাত্রার চাপ কি তবে আনন্দের জিভটা বিগড়ে দিল আমাদের? রোজকার এত অ্যাডজাস্টমেন্ট কি শেষকালে ভুলিয়েই দিল সহজ আনন্দের মোরামের পথটা! হাস্যরস কি সব অ্যাসফল্টের নির্মম শহুরেপনায় চাপা পড়ে ফুটপাত বন্দী হয়ে গেল? আগের মতো কৌতুকের পথ চেহারাহীন ভাবে আলগা হয়ে কখন যেন ঘাসজমিতে মিশে যেত! আর হবে না কোনও দিন?

ঠিক যেমন গোবরাকে মিত্তিরবাড়ির ছেলে ভেবে কেউ টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে যাওয়ার নেই, যেমন ইংরেজি দোকানে বানান নিয়ে তরজার সময় নেই; তেমনি! তেমনি স্যারের লেখার সহজানন্দের বৈরাগ্য মুছে যেতে বসেছে বাংলা থেকে। চটুল রসিকতা আর যৌন মস্করায় দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছে গঙ্গার দুই পারের বাসিন্দাদের! তাই এই আত্মহত্যা আরেক ভাষায় প্রতিবাদ আমাদের। যেন দু’পারের আজকের নবরসবোধে আক্রান্ত জীবনযাত্রাকে অস্বীকার করে, ‘ঝপাং’! তলিয়ে যাব আমরা। এমন অন্য হাসির জগতে নাই বা রইল বর্ধন বংশের এই দুজন। তাই ঝপাং!!!...’’

মাঝি আর পড়তে পারল না; চোখ তুলে তাকাল! দেখে হর্ষ আর গোবর ঠায় ওর দিকেই চেয়ে!

গোবর: পুরোটা পড়েছ?

মাঝি: যা বুঝছি আধা পড়লেও সেই ‘ঝপাং’; পুরো পড়লেও সেই ‘ঝপাং’!

হর্ষ: কী আর করব ভাই! এখন টিআরপি-ময় জীবন। ভাল কাজ না পারো খারাপ কাজ করো, বিতর্কিত কাজ করো দেখবে টিআরপি হুস হুস করে বাড়ছে!

মাঝি: টিআরপি আবার কী বাবু?

হর্ষ: আমিই বুঝিনি তো তোমায় আর বোঝাবো কী করে! শুধু এটুকু বুঝেছি ইলেকট্রিকের মতো টিআরপিরও একটা মিটার আছে! যত আলো জ্বলবে তত মিটার বাড়বে! যত মিটার বাড়বে তোমার দরও বাড়বে।

গোবর: আমাদের বাড়েনি তাই মাঝ গঙ্গায়...

মাঝি: ঝপাং?

হর্ষ: ইয়েস!... এই কাগজগুলো হারিয়ো না ভাই। যদি তদন্তে চায় দিয়ো। আর যাকে দেবে তাদের বোলো সব কথা এতে লেখা যায়নি সময়ের অভাবে। তারা যদি একটু কষ্ট করে শিব্রাম রচনা সমগ্রটা পড়ে নেন; ওখানে আমাদের জন্মবৃত্তান্ত ইত্যাদি প্রভৃতি সব লেখা আছে।

গোবর: তোমার চোখের সামনে আত্মহত্যা দেখলে ভাল লাগবে না। যখন মাঝগঙ্গায় আসবে, বোলো। তখন তুমি নৌকোয় বসে চোখ বুজো; আমরা দুজন জলের তলায় গিয়ে চোখ বুজব। কেমন?

মাঝির মুখে কথা সরল না। সে কেবল মাথা কাৎ করল। কলকাতার দিক থেকে সবে সূর্যের আলো হাওড়া ব্রিজের মাথাটায় কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো সোনালি রং ধরিয়েছে। এই ব্রিজটা শিব্রামকে বিলক্ষণ চেনে! অথচ যে লাখ লাখ মানুষ রোজ এপার ওপার করছে তারা চিনল কি তাকে? ঠিক করে চিনল? যদি চিনতই তবে একটা সভ্যতার রসবোধে অমন জং ধরালে কী ভাবে? কী ভাবে মিষ্টি কৌতুকরস, সূক্ষ্ম কথার খেলা, পানিং, মজার চরিত্রগুলো হারিয়ে গেল এমন ভাবে? কী ভাবে মুখে আঁচিলওয়ালা একজন মজাদার লেখকের রচনা সমগ্র হয়ে রইল কিংবদন্তি শিব্রাম চক্রবর্তী? নৌকা মাঝ নদীতে তখন।

মাঝি: বাবু মাঝগঙ্গা এখন?

হর্ষ: চোখ বোজো তবে একটু!

এমন অভিজ্ঞতা মাঝির জন্মেও হয়নি! সে একবারটি দেখে নিল ওই দুই প্রবীণ জুটিকে!

গোবর: তা মাঝিভাই, তোমার নামটাই তো জানা হল না!

মাঝি: আমার নাম বাবু শিব্রাম। শিব্রাম নস্কর! নিবাস সজনেখালি।

শেষের কথাগুলো আর হর্ষবর্ধন গোবরধনের কানে ঢুকল না! শুধু নিজেরা নিজেদের একবার দেখে নিল মাঝির নামটা শুনে। মাঝি চেনে না তাদের স্যারকে, কিন্তু চলে যাওয়ার আগে স্রষ্টা যেন ওদের কথাগুলো নিজের হাতে ধরে ভেসে রইলেন গঙ্গা বক্ষে।

গোবর: চোখ বোজো ভাই। জাস্ট এক মিনিট!

চোখ বুজল মাঝি! মাথার উপর হাওড়া ব্রিজের গাড়ি চলাচলের একটা ভোঁ লাগা শব্দ! জলের শব্দ মাঝগঙ্গায় একদম নেই। একটাই শব্দ প্রথম কানে এল চোখবন্ধ মাঝির, ‘ঝপাং’! সে শব্দ মেলাতে না মেলাতে আবার— ‘ঝপাং’।

আবার প্রিন্সেপ ঘাটে ফিরতে হবে মাঝিকে। টাকা নিতেও ভুলে গেছে সে! হাতের কাগজগুলোর দাম যা বুঝছে তেমন কিছুই বোধহয় নয়! অদ্ভূত অলৌকিক এক অভিজ্ঞতা ছাড়া বউনিটা আজ বেকার গেল!!

হর্ষবর্ধন ও গোবরধন-এর সুইসাইড নোট কোমরে গুঁজে বৈঠা বাইতে বাইতে ঘাটের পথে ফিরে গেল শিব্রাম মাঝি।

(গোবরধন বানানটি ইচ্ছাকৃত ভাবে ব্যবহৃত)

কণিকামাত্র

হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধনের নানা কীর্তির কয়েক ঝলক

সোজাসাপ্টা

সরল কথা সোজাসাপ্টা ধরে নিতে গোবর্ধনের জুড়ি নেই। অমন কাণ্ডের নমুনা তার ভুরি ভুরি। এক বারের কথা যেমন। খাটে শুয়ে শুয়ে হর্ষ বলে, ‘‘ভাই গোবর্ধন, দরজাটা একটু খুলে দিবি?’’ সাততাড়াতাড়ি স্ক্রু-ড্রাইভার নিয়ে হাজির গোবর্ধন। দরজা খুলতে হবে যে! সে বার তাকে নিরস্ত করে হর্ষবর্ধন। দু-হাট করে দরজা খোলা হল। খানিক বাদে দরজা বন্ধ করতে চায় হর্ষ। বলে, ‘‘ভাই গোবর্ধন, দরজাটা ভিজিয়ে দে।’’ এ বার বালতি করে জল নিয়ে চলে এল গোবর্ধন! দাদার আদেশ। দরজা ভেজাতে হবে না!

অতিথি নারায়ণ

চোর পড়েছে হর্ষবর্ধনের বাড়িতে। সব লুঠ করে নিয়ে যেতে চায়। কাকুতিমিনতি করেও রেহাই নেই। শেষে হর্ষবর্ধন চোরকে বলে, ‘‘আপনি অতিথি। অতিথি তো নারায়ণ। সব নিয়ে যাবার আগে এক বার অন্তত সেবা করার সুযোগটা দিন।’’ কী সেবা? চোরকে পুজো করতে চায় সে। অবাক হলেও মত দিল চোর। একটা থামের গায়ে তাকে দাঁড় করিয়ে সামনে পুজোর উপাচার সাজানো হল। মন্ত্রপাঠ শুরু হল। শেষে প্রদক্ষিণ। অনেক পৈতে একসঙ্গে জুড়ে জুড়ে বড় দড়ি বানালো হর্ষ। তার পর থামের গায়ে তার এক প্রান্ত বেঁধে ঘুরতে লাগল মন্ত্র পড়তে পড়তে। ধীরে ধীরে পৈতের প্যাঁচে বাঁধা পড়ে গেল চোর।

খরিদ্দার লক্ষ্মী

এক মিষ্টির দোকানের মালিক দেশে যাবে দিন দুয়েকের জন্য। ওই দু’দিন হর্ষবর্ধনের ওপর দোকান চালানোর অনুরোধ করল সে। রাজি হল হর্ষবর্ধন। দোকান খুলতেই একটি ছেলে এল এক সের পান্তুয়া নিতে। ‘‘কত দাম?’’ ‘‘পাঁচ টাকা।’’ ছেলেটির হাতে পান্তুয়া তুলে দিল হর্ষবর্ধন। ছেলেটি দেখে পান্তুয়া কেমন যেন খোবলানো খোবলানো। কারণ জিজ্ঞেস করতে গোবর্ধন বলল, ‘‘মোশায় খেয়েছে।’’ ছেলেটি তখন বলল, ‘‘তা হলে পান্তুয়ার বদলে এক সের রসগোল্লা দিন।’’ তার পরেই আবার বলে, ‘‘কিন্তু রসগোল্লায় মাছি পড়েনি তো?’’ এ বারও গোবর্ধন জানায়, ‘‘তা পড়েছে।’’ ‘‘তা হলে রসগোল্লার বদলে পাঁচ টাকার সন্দেশ দিন।’’ চুবড়ি ভরা সন্দেশ এগিয়ে দিতেই ছেলেটি হাঁটা দিল। হর্ষ চিৎকার করে বলে, ‘‘আরে, সন্দেশের দাম?’’ ছেলেটি বলে, ‘‘সন্দেশ তো রসগোল্লার বদলে নিয়েছি।’’ হর্ষ বলে, ‘‘তা হলে রসগোল্লার দাম?’’ উত্তর পায়, ‘‘সে তো পান্তুয়ার বদলে।’’ তা হলে পান্তুয়ার দাম? ছেলেটি উত্তর করে, ‘‘পান্তুয়া তো আমি খাইনি।’’

ঋণং কৃত্বা

এক লেখকের বাড়িভাড়ার পাঁচশো টাকা বাকি পড়েছে। বাড়িওয়ালার তাগাদায় তিনি হর্ষবর্ধনের কাছ থেকে টাকাটা ধার করলেন। সে ছিল এক বুধবার। লেখক হর্ষবর্ধনকে কথা দিলেন শনিবারই তিনি টাকা ফেরত দেবেন। শনিবার এলে লেখক, ভাই গোবর্ধনের কাছ থেকে পাঁচশো টাকা ধার নিয়ে ওই টাকা হর্ষবর্ধনকে দিয়ে ধার শোধ করলেন। এ ভাবেই চলতে লাগল। দিনের পর দিন। শনিবার আসতে লেখক ভাই গোবর্ধনের কাছ থেকে পাঁচশো টাকা নিয়ে হর্ষবর্ধনের ধার শোধ করেন। আবার বুধবার এলে হর্ষবর্ধনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গোবর্ধনের ধার মেটান। এক দিন হঠাৎ পথে দুই ভাইকে একসঙ্গে পেয়ে গেলেন সেই লেখক ভদ্রলোক। এ বার তিনি তাঁদের বললেন, ‘‘শুনুন মশাই, আমি আর এখন থেকে আপনাদের মধ্যে থাকতে চাই না।’’ তার পর থেকে ঠিক হল, প্রত্যেক শনিবার গোবর্ধন, হর্ষবর্ধনকে পাঁচশো টাকা দেবে। আর প্রত্যেক বুধবার হর্ষবর্ধন, ভাই গোবর্ধনকে পাঁচশো টাকা দেবে।

সংকলন ও সংযোজন: সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায়

অলংকরণ: সুব্রত চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE