শৈল্পিক: পার্থ সাউয়ের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। ফাইল ছবি।
সদ্য স্থানান্তরিত ‘দেবভাষা’ প্রদর্শশালায় শিল্পী পার্থ সাউয়ের একক প্রদর্শনী সম্পন্ন হল। দীর্ঘ কয়েক বছর ব্যবধানের পর পার্থর এই প্রদর্শনী তাঁর নতুন এক শৈল্পিক অধ্যায়ের সঙ্গে দর্শকের পরিচয় ঘটাল। প্রায় তিরিশটিরও বেশি, সমমাপের বিমূর্ত ছবির দ্বারা আয়োজিত পরিপাটি এই প্রদর্শনী, বিমূর্ত চিত্রণ ও তার ইতিহাস বিষয়ে কিছু আলোচনার সুযোগ তৈরি করে।
ইউরোপে প্রথম বিমূর্ত চিত্রের প্রকাশ ঘটে বিংশ শতকের গোড়ায়। গল্প ও বর্ণনামূলক চিত্রণের বিরুদ্ধে গিয়ে, শুধুমাত্র রং ও আকারের যথাযথ বিন্যাস বা ডিজ়াইন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, পাশ্চাত্যের শিল্পীরা তখন নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয় আধুনিক সব শিল্পভাবনা, যার মধ্যে কিউবিজ়ম, ফ্যভিজ়ম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সে যুগের শিল্পীরা তখন চূড়ান্ত অ্যাকাডেমিক বা রিয়্যালিজ়মের বাঁধন থেকে নিজেদের মুক্ত করতে প্রয়াসী হয়ে ওঠেন। এই নব অধ্যায়ের পুরোধা হিসেবে বিশ্ববরেণ্য শিল্পী ওয়ালিসলি কান্দিনস্কিকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। তিনিই নাকি প্রথম কোনও আনুষ্ঠানিক ও নির্দিষ্ট কম্পোজ়িশন থেকে সরে এসে, শুধুমাত্র রং ও রেখার স্বাধীন বিন্যাসে প্রকাশ করেন নিজের ভাবনা। রূপের পূর্ণতা খোঁজার এই প্রয়াসে, রঙের নিজস্বতা ও তার অস্তিত্বের যে আবেদন মানবমনকে নাড়া দেয়, তাই দিয়ে জন্ম নিল অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজ়ম। পরবর্তী সময়ে তা বহু শাখাপ্রশাখায় বিস্তারিত হয়ে মেলভিক, মঁদ্রিয়ানের মতো শিল্পীদের কাজের মধ্য দিয়ে প্রসারিত হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে গণেশ হালুই, প্রভাকর কোলটের মতো বিশিষ্ট শিল্পীরা এই আঙ্গিকের অন্তর্ভুক্ত।
এই প্রদর্শনীতে শিল্পী পার্থ সাউয়ের ছবিতে রং ও রূপের সেই সাঙ্কেতিক বিমূর্ত উপস্থাপনার অফুরন্ত নিদর্শন পাই। নিসর্গের জ্যামিতিক বিভাজন তাঁর ছবির বৈশিষ্ট্য। কোথাও বা সমুদ্রতট, কোথাও অস্তমিত সূর্য, কোথাও সোনালি বালুচর, কোথাও বা নগরায়ণ কিংবা বসতির রৈখিক কাঠামো, কোথাও নীলাকাশের উন্মুক্ত হাতছানি— শিল্পী সব ক’টি বিষয়কেই স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে, সুষম ও বিমূর্ত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে নীল রঙের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রায় প্রতিটি ছবির ক্ষেত্রেই প্রাধান্য পেয়েছে। নীল এমনই একটি রং, যা নাকি এক দিকে গভীরতা ও অন্য দিকে বিস্তারের আভাস ফুটিয়ে তোলে। পাশাপাশি বহু কল্পনার চাবিকাঠিও উন্মুক্ত করতে সাহায্য করে। তবে কয়েকটি ছবির ক্ষেত্রে অবশ্য নীল ব্যতিরেকে সোনালি, হলুদ ও সাঙ্কেতিক লালের ব্যবহার লক্ষণীয়। রূপের আপাত অলঙ্করণকে বাদ রেখে, তার শুধুমাত্র গাঠনিক সংজ্ঞাকে সাজিয়ে নিয়ে, বিমূর্ত এই ছবিগুলি দর্শককে তাঁর নিজের মতো করে ভাবার বহু সুযোগ এনে দেয়। অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে মোটা ফ্ল্যাট ব্রাশ, স্প্যাচুলা বা রোলার ব্যবহারের সাহায্যে পার্থ তাঁর চিত্রপটগুলির মধ্য দিয়ে এক পরিপক্ব ও বলিষ্ঠ শিল্পীর পরিচয় রেখেছেন। রূপের সঙ্কোচনের মধ্য দিয়ে এক বিস্তারের আবেশ তৈরি করেছেন। নীল রঙের বহুবিধ বিন্যাসে এক কাব্যময়তার সৃষ্টি করেছেন, যা নাকি রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায়, “...নীল দিগন্তে মোর বেদনখানি লাগল, অনেক কালের মনের কথা জাগল।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy