শিল্পরূপ: প্রগতি আয়োজিত প্রদর্শনী ‘পারস্পেক্টিভ’। —নিজস্ব চিত্র।
কলকাতার শৈল্পিক সংগঠন প্রগতি দীর্ঘ বাইশ বছর ধরে শিল্পের প্রচার ও প্রসারের কাজ করে চলেছে। সারা বছর ধরেই কলকাতা ও দেশের বিভিন্ন রাজ্যে চিত্রকলা এবং ভাস্কর্যের প্রদর্শনী, আলোচনাসভা ইত্যাদির আয়োজন করে থাকে তারা। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে এই সংগঠনের উদ্যোগে সম্প্রতি আরও একটি প্রদর্শনী উপস্থাপিত হল। নাম, ‘পারস্পেক্টিভ’।
শৌভিক বিশ্বাস ইন্ডিয়ান কলেজ অব আর্টস এবং ড্রাফ্টসম্যানশিপ থেকে চিত্রকলায় স্নাতক। তিনি প্রকৃতি, পশুপাখি আর আমাদের চারপাশের জীবন নিয়েই ছবি আঁকেন প্রধানত। প্রদর্শনীতে তাঁর ছোট ছোট বেশ কয়েকটি কাজ দেখা গেল। শিল্পী এই ছবিগুলির নাম রেখেছেন ‘ফেডেড’। প্রথম ছবিতে চারকোল, গ্রাফাইট এবং অ্যাক্রিলিক রং দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে কিছু আলোকিত জোনাকি দেখিয়েছেন। দ্বিতীয় ছবিতে অন্ধকার পটভূমিতে হালকা চাঁদের আলো এবং আরও দূরে ছোট ছোট তারা। কিন্তু কাছের জোনাকির আলো যেন তার চেয়েও বেশি উজ্জ্বল। শৌভিক বর্তমান সময়ের জীবনযাত্রার অন্ধকারের মধ্যে আলো খুঁজছেন। তৃতীয় ছবিটিতে অন্ধকারেই একটু আলো ফুটতে দেখা যাচ্ছে এবং পুরো জমিতে শুকনো ঘাস। এর পরেই নতুন কচি ঘাসের জন্ম হবে। অর্থাৎ, আশার আলো দেখছেন শিল্পী।
বর্ণ মাইতি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। রূপকথার গল্প, উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের প্রতি ভালবাসা থেকেই তাঁর ছবি জন্ম নেয়। প্রদর্শনীতে তাঁর একটি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য উল্লেখযোগ্য কাজ। এটির নাম ‘নক্টার্ন’। নিশাচর বলে একটি প্যাঁচা তৈরি করেছেন শিল্পী। ডোকরার ‘লস্ট ওয়াক্স’ টেকনিকে করা। এ কোনও সাধারণ প্যাঁচা নয়। মানুষের চরিত্রগত কিছু গুণ যেন এর মধ্যে আছে। এটি যেন এক রূপকথার চরিত্র। তার সমস্ত শরীরে আঁকিবুকি করা। এই জীবটি খুব শান্ত। গাঢ়, অন্ধকার রাত্রিকেও মোটে ভয় পায় না। রূপকথার রাজপুত্রকে পথ দেখিয়ে সে নিয়ে যায়, উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য। ভারী জীবন্ত এবং আকর্ষক প্যাঁচার আকৃতিটি। বর্ণ মাইতির আরও কিছু ভাস্কর্য দেখা গেল।
আর এক শিল্পীর নাম প্রদীপ গোস্বামী। ছোটবেলা থেকেই তাঁর ছবি আঁকা শুরু। বিবিধ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বহু পুরস্কার প্রাপ্তি। পরবর্তী কালে ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে শিক্ষালাভ। আর্ট কলেজের এই প্রাক্তনী আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন তাঁর কাজের জন্য। প্রদীপের যে ছবিটি প্রদর্শনীতে রাখা ছিল, সেটি ক্যানভাসের উপরে অ্যাক্রিলিকে করা। খুবই ঝকঝকে, রঙিন একটি কাজ। রঙের ব্যবহারে শিল্পীর দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। কাজটির নাম, ‘উয়ো ম্যানিফেস্টো’। সারা দেশে ঘটে চলা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার হাতিয়ার হিসেবে শিল্পীর ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে এই কাজে।
বিদ্যুৎ বসাক ভাস্কর এবং চিত্রশিল্পী। সরকারি আর্ট কলেজ থেকেই সম্পূর্ণ শিক্ষাপ্রাপ্ত। ২০০২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সাতটি পুরস্কার পেয়েছেন এবং ২০০৫-এ রাজ্যপালের পুরস্কারও পেয়েছেন। প্রদর্শনীতে রাখা বিদ্যুতের ভাস্কর্যটির নাম ‘দ্য ভিক্টোরিয়াস উইংস’। কাঠের বেশ ভাল, পরিচ্ছন্ন কাজ। একটি কালো ঈগল তার সোনালি ডানা দু’টি মুড়ে বসে আছে। ডানা দু’টিকে সোনালি করেছেন কেন প্রশ্ন করায় বিদ্যুৎ জানালেন যে, আকাশ তাঁর কাছে চিরকালই উন্নতি, স্বপ্ন এবং সাফল্যের প্রতীক। পাখির উড়ান মানুষের কাছে ইচ্ছে পূরণের প্রচেষ্টা। সোনালি দু’টি ডানা তাই বৃহত্তর সাফল্যের নিশানা হিসেবে বিজয়ের বার্তা বয়ে আনে। আর মুক্ত বিহঙ্গ সেই জয়ের ঘোষণা করে সদর্প।
ঐন্দ্রিলা দত্ত একটি বাড়ির ছাদের ছবি এঁকেছেন। নাম, ‘রুফটপ’। কাগজের উপর স্বচ্ছ জলরঙে করা ছবি। বাস্তবধর্মী কাজ। এই ছবিটি উনি এঁকেছেন আফগানিস্তানের বাল্খ প্রদেশের এক গ্রামের বাড়ি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। ওখানকার বাড়িগুলি মূলত মাটি দিয়ে তৈরি এবং দ্বিতল। পরিবারকে নিয়ে সেখানকার মানুষরা ছাদে রোদ পোহান, এই ব্যাপারটা দেখে শিল্পীর বেশ মনে ধরেছিল। স্বচ্ছ জলরঙের ব্যবহারে তেমন একটা নতুনত্ব না থাকলেও হালকা, নরম টোনের রং ব্যবহার করে আফগান প্রদেশের কড়া রোদ-ছায়ার ব্যাপারটি ভাল ফুটিয়ে তুলেছেন।
পৌলমী সরকারের ছবিটির নাম ‘স্মাগ’। কাগজের উপরে অ্যাক্রিলিকে করা কাজ, সঙ্গমোত্তর একটি মেয়ের ছবি। বেশ আকর্ষক কাজ। ‘স্মাগ’ শব্দের অর্থ আত্মতৃপ্ত। কিন্তু মেয়েটির মানসরূপে একটু লজ্জার ভাব-ই ব্যক্ত হচ্ছে। নামকরণের তাৎপর্য তাই ঠিক ধরা গেল না।
এ শহরেরই শিল্পী সঞ্জয় বৈষ্ণব ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকায় উৎসাহী। জলরঙের সঙ্গে বিশেষ আত্মিক যোগ অনুভব করেন তিনি। এখন তিনি দুর্গাপ্রতিমার সামনে সিঁদুরখেলা, প্রতিমাবরণ ইত্যাদি নিয়েই ছবি আঁকছেন। বড় কাগজে স্বচ্ছ জলরঙে আঁকা তাঁর ছবি
রয়েছে প্রদর্শনীতে। জলরঙের উপরে শিল্পীর দখল লক্ষণীয়। তবে ছবিতে আলোকচিত্রের গুণমানের প্রভাব শিল্পীকে কাটিয়ে উঠতে হবে। নিজস্ব একটা ভাষা সৃষ্টি করতে হবে।
বহু শিল্পীকে একত্রিত করে প্রদর্শনী করার যে প্রয়াস করেছে প্রগতি, সেই প্রচেষ্টা অভিনন্দন জানানোর মতোই। ভবিষ্যতে দর্শক তাদের উদ্যোগে আরও ভাল কাজ দেখতে পাবেন, আশা করা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy