Advertisement
E-Paper

‘তব অন্তর্ধানপটে হেরি তব রূপ চিরন্তন’

চন্দ্রর পর্যটনে শুধুই ধ্বংসবার্তা। যত জায়গা পরিভ্রমণ করেছেন, আগেকার সে অবস্থা আজ খুন হয়ে গিয়েছে এক শ্রেণির মানুষের হাতে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের উন্মুক্ত প্রান্তরের বাসনায় পড়েছে কোপ।

অতনু বসু

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২২ ০৯:০৪
বিবর্ণ: হ্যারিংটন আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শিত চিত্রকর্ম।

বিবর্ণ: হ্যারিংটন আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শিত চিত্রকর্ম। নিজস্ব চিত্র।

বোলপুর শান্তিনিকেতনের যে সব ড্রয়িং, পেন্টিং, মাঠঘাট, প্রান্তর, খোয়াই, কোপাই, লালমাটির পথ দিগন্তবিস্তৃত নিসর্গকে আজও মনে পড়ায়, বাস্তবে তার হত্যালীলা ঘটে গিয়েছে। যে বিনোদবিহারী, রামকিঙ্কর, নন্দলাল, সত্যেন্দ্রনাথ বিশীর তুলি-কলমে শান্তিনিকেতনের নিসর্গ ছিল স্বপ্নের মতো, আজ ঘুরে ঘুরে তাকে ক্যামেরাবন্দি করে, বিরাট মাপের কাগজে পেন্টিং করে খুবই হতাশ শিল্পী চন্দ্র ভট্টাচার্য। তাঁর চোখে এখনকার শান্তিনিকেতনের ছন্নছাড়া প্রকৃতির ‘শান্তিনিকেতন’ নামে ২৪টি পেন্টিং হ্যারিংটন আর্ট গ্যালারিতে দেখা গেল। প্রদর্শনীর উপস্থাপনায় প্রশান্ত তুলসীয়ান, কিউরেট করেছেন জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য।

চন্দ্রর পর্যটনে শুধুই ধ্বংসবার্তা। যত জায়গা পরিভ্রমণ করেছেন, আগেকার সে অবস্থা আজ খুন হয়ে গিয়েছে এক শ্রেণির মানুষের হাতে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের উন্মুক্ত প্রান্তরের বাসনায় পড়েছে কোপ। হারিয়ে গিয়েছে ‘গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ’। চন্দ্র ও জ্যোতির্ময়ের উদ্দেশ্য ছিল, এখনকার সময়টিই ছবিতে ধরা।

সামান্য ড্রাই প্যাস্টেল, বেশিটাই চারকোলে করা বড় মাপের কাগজের পেন্টিংগুলি পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই অনুভূত হয় ফাঁকা জমি, মাঠ, প্রান্তর, দূরের কাছের বহু জায়গা যেন কোনও অদৃশ্য দখলদারের হাতে চলে যাচ্ছে। কী আছে চিত্রগুলিতে? আছে আঁধার, আছে অশনি সঙ্কেত, আছে বোল্ডারের মতো পাথর, খুঁটি, কাঁটাতার, বর্ডার, কংক্রিটের পোস্ট, সীমানার চিহ্নিতকরণ, জড়ো করা পাথর, ব্যারিকেড, কেটে ফেলা গাছ, ইট-কাঠ, নিহত বৃক্ষশ্রেণি, যেন রক্ত ঝরছে ওই প্রান্তরের বুক থেকে। নয়নাভিরাম নিসর্গের যে উন্মুক্ততা ছিল চোখের আরাম, চন্দ্রের চিত্রকলা তার হত্যালীলার সাক্ষী। তাঁর চারকোল, প্যাস্টেল রক্তাক্ত শান্তিনিকেতনের ছবি এঁকেছে। শিল্পী এমন ভাবধারাই প্রকাশ করেছেন ছবিতে, তাঁর বক্তব্যেও।

অন্ধকারের ছবি এ শান্তিনিকেতন। তাই বর্ণ প্রায় বর্জিত। সামান্য বাদামি-লালচে পটভূমি কোথাও, অতি হালকা হলদেটে পাঁশুটে বর্ণ, বাকিটা সাদাকালোর মনকেমন করা বিস্তার। আঁধার এখানে আশ্চর্য কাব্যিক হয়েও যন্ত্রণার কথা বলে। বলে এক ধরনের বিষাদের কথাও। হতাশার সুর উড়ে বেড়ায় ওই প্রায়ান্ধকার প্রান্তরের কেটে ফেলা বৃক্ষের আশপাশে। ছবির মধ্যে এই চোরাগোপ্তা হত্যালীলা ও প্রকাশ্যেই অবাধ সীমানার ঘেরাটোপের দখলদারিকে চন্দ্র ভারী চমৎকার জায়গাগুলির মধ্যে চিহ্নিত করেছেন। অদৃশ্য সংস্থার হাত, প্রকৃতি ধ্বংসের পরিকল্পকের অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কোনও বিরোধিতা নেই। সবুজ হারিয়ে যাবে? ময়দানের জমি চলে যাবে অন্যের অধিকারে? এই সমস্ত স্থানই ছিল নির্বাচনের বিষয়। ছবিগুলিতে হুবহু বাস্তব ও শিল্পীমনের ধারণার প্রতিফলনের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে কম্পোজ়িশন। স্পেসের ভূমিকা সেখানে প্রধান। ওই বেরিয়ার, ওইশূন্যতা, পাথরের খুঁটি, কাঁটাতার ঘেরা অঞ্চল গোটা ছবির অ্যারেঞ্জমেন্ট ও ভারসাম্যে এক ধরনের হাহাকার ও যন্ত্রণার অনুভূতি এনেছে।

অবর্ণনীয় শোষণেরই বাস্তবিক রূপবন্ধের অনুষঙ্গ ও ব্যবহৃত দ্রব্যের ছড়ানো-ছিটানো অবস্থানটিকে নিয়ে রক্তস্মৃতির নিসর্গ শান্তিনিকেতনকেই যেন দেখিয়েছেন। ছিন্ন বৃক্ষের পাশে, অন্যান্য উন্মুক্ত স্থানের কম্পোজ়িশনে স্তূপীকৃত বালি, স্টোন চিপস, ইমারতি দ্রব্যের ব্যবহারের মাধ্যমে সুকৌশলে দখল হওয়া জায়গাজমির অবস্থাটিকেই পাখির চোখ করেছেন। সেখানে ওই দ্রব্যের কতটা অংশ বা আকারকে পটের চতুষ্পার্শে কোথায় কী ভাবে অ্যারেঞ্জ করবেন অন্যান্য দ্রব্যের সঙ্গে বা একটু ফারাক রেখে, তার অমন কম্পোজ়িশনের চমৎকারিত্ব ও বর্ণের ঘষামাজা ও ধূসরতাও অনন্য। যখন যেখানে একাকী বা সংগঠিত বৃক্ষের পড়ে থাকা, কেটে ফেলা অবস্থান, সেখানেও শূন্য শুষ্ক শাখাপ্রশাখার সাদাটে রচনা, অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা পল্লবিত, প্রায় ছিন্ন, পতিতপ্রায় শাখার ওই জায়গাটি অনন্যসাধারণ। কাঁটাতারের আড়ালের অন্ধকার ভেদ করা গাছগাছালি, যা এক সময়ে ধ্বংস হবে— তাদের বিপন্ন অস্তিত্বের ধূসর ও প্রায়ান্ধকার সাদাকালোর বর্ণবিন্যাস যেন ওই ছবির কাব্যগাথা। হারিয়ে যাওয়ার এক সুরের অনুরণন ভীষণ ভাবে উপস্থিত। রূপের এই আড়াল ও আলো-আঁধারি ব্যঞ্জনা ও প্রকৃতিকে হত্যাদৃশ্যের প্রতিটি ছবিই যেন তাদের অশ্রুসিক্ত অবস্থাটিকে চন্দ্রর রূপ ও রূপান্তর, স্পেস ও আরও গভীর অভ্যন্তরের স্পেস, বর্ণ ও বর্ণের আপাতসরল ও গভীর রহস্যময়তাকে এক প্রবল অভিঘাতের দিকে নিয়ে গিয়েছে। ছিল কিন্তু নেই, যা আছে তা-ও আর থাকবে না। ড্রাই প্যাস্টেল, চারকোলে কাগজে তাঁর এই সৃষ্টির অন্তরালে হোটেল, দোকানপাট ফেঁদে বসা ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়া মাঠঘাট, প্রান্তর চিরতরে হেরিটেজ নষ্টের প্রয়াসের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ!

Artwork Paintings
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy