Advertisement
E-Paper

মার্গ সংগীতের আসরে সুরনির্ঝর

চার দিন ব্যাপী ডোভার লেন সংগীত সম্মেলনে শ্রোতারা আমোদিত হলেন সুরের নেশায়। লিখছেন চিত্রিতা চক্রবর্তী চার দিন ব্যাপী ডোভার লেন সংগীত সম্মেলনে শ্রোতারা আমোদিত হলেন সুরের নেশায়। লিখছেন চিত্রিতা চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
রাশিদ খান

রাশিদ খান

সম্প্রতি নজরুল মঞ্চে চাররাত্রিব্যাপী ছেষট্টিতম ডোভার লেন সংগীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চাকে দীর্ঘ দিন ধরে মান্যতা দিয়ে এসেছে এই মঞ্চ। এ বারও নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের উপস্থিতিতে ঝলমলে হয়ে উঠেছিল মার্গ সংগীতের আসর। অগণিত শ্রোতা চার রাত্রি ধরে আমোদিত হলেন সুরের নেশায়। ডোভার লেন এ বার তাদের অনুষ্ঠান সাজিয়েছিল একটু অন্য ভাবে। চার দিনের অনুষ্ঠানে প্রয়াত গিরিজা দেবী, সুব্রত রায়চৌধুরী, কিশোরী আমোনকরের মতো স্বনামধন্য শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হল।

ওজস্বী কণ্ঠে মধ্যরাতের আসর জমিয়ে দিলেন পরভীন সুলতানা। শোনালেন রাগ যোগ। বিলম্বিত বিস্তারে তাঁর কণ্ঠের ব্যাপ্তি ধরা দিল। বিলম্বিত একতালে নিবদ্ধ বন্দিশকে স্বকীয় গায়কির স্পর্শে করে তুললেন ব্যতিক্রমী। দুই গান্ধারের যথাযথ প্রয়োগ এই রাগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শিল্পী সযত্নে সেই বিশিষ্টতাকে প্রতিস্থাপন করেছেন। তিন সপ্তক জুড়েই এই রাগের চলাচল, যদিও তিনি তার সপ্তকে খানিক বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। বক্রতান সহযোগে বিস্তার বেশ ভাল লেগেছে। শিল্পীর পরবর্তী নিবেদন ছিল বসন্ত। তিনতালে সৃজিত একটি দ্রুত বন্দিশ শোনালেন তিনি। পূর্বী ঠাটাশ্রিত এই রাগটির বিস্তারে কড়ি মধ্যম এবং ষড়জের সুচারু ব্যবহার উপস্থাপনাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। বসন্তের পরেই শিল্পী বেছে নিলেন অপেক্ষাকৃত চঞ্চল রাগ হংসধ্বনি। শোনালেন তিনতালের একটি তারানা। তবলার সঙ্গে দ্রুতগতির তালমেল ভাল লেগেছে। শ্রোতাদের অনুরোধে শিল্পীর শেষতম নিবেদন ছিল ‘মাতা ভবানী দয়ানী’। বহুশ্রুত গানটিকেও শিল্পী স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করেছেন।

অনুপমা ভাগবত

আগ্রা ঘরানার শিল্পী ওয়াসিম আহমেদ খানও কণ্ঠসংগীতে শ্রোতাদের স্তব্ধ করে দিয়েছেন। জয়জয়ন্তী রাগে বিলম্বিত আর দ্রুত বন্দিশ শোনালেন তিনি। রাগালাপে ফুটে উঠল আগ্রা ঘরানার স্বকীয় শৈলী। ঘরানার ঐতিহ্যবাহী ‘নোমতোম’ আলাপে জয়জয়ন্তীকে পূর্ণতা দিলেন। তানবিস্তারে গমকের প্রয়োগও ছিল চমৎকার। তাঁর দ্বিতীয় পরিবেশনা ছিল সোহিনী। ওয়াসিম আহমেদ খানের গায়নশৈলী এবং পরিমিতিবোধ প্রশংসনীয়। পরিমিত সময়ে রাগের চলনকে যথাযথ বিন্যস্ত করতে তিনি সফল হয়েছেন।

অন্য দিকে এই পরিমিতিবোধের অভাব দেখা গিয়েছে রঘুনন্দন পানশিকরের গায়নে। বলিষ্ঠ কণ্ঠের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও, তাঁর প্রলম্বিত রাগবিন্যাস খানিক একঘেয়েমির উদ্রেক করেছে। সম্পূর্ণ মালকোশে বিলম্বিত তিনতালে বন্দিশ পরিবেশন করলেন তিনি। বিলম্বিত বন্দিশের বাঁধন ছিল চমৎকার। কিন্তু মুশকিল হল, অতি দীর্ঘ বিস্তার করার সময় একই সুরবিন্যাস বারবার ঘুরেফিরে আসায় রাগটি আবেদন হারিয়েছে। সম্পূর্ণ মালকোশ একটু কম দীর্ঘ হলে ভাল হত।

এ বছর সংগীত সম্মান অর্পণ করা হল ছন্নুলাল মিশ্রকে। বর্ষীয়ান এই শিল্পীর উপস্থাপনায় বৈচিত্রের অভাব ছিল না। বিলম্বিত বন্দিশ, ভজন, ঠুমরি, কাজরি, চৈতি, দাদরা— সবই ছিল তাঁর পরিবেশনায়। তবে অভিজ্ঞতার ধারে তিনি যতটা অগ্রগণ্য, সংগীত পরিবেশনায় তাঁর সেই অগ্রগামিতার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বয়স। বয়সের ভারে তাঁর কণ্ঠ মাঝেমাঝেই বিচলিত হয়েছে। অল্পশ্রুত হেমখেম রাগে সৃজিত বিলম্বিত পরিবেশনায় প্রথম দিকে খানিক জড়তা থাকলেও, পরবর্তী সময়ে তা ক্রমশ সাবলীল হয়েছে।

আর এক বর্ষীয়ান শিল্পী পণ্ডিত যশরাজ শোনালেন ললিত। ঝাঁপতাল আর তিনতালে নিবদ্ধ বন্দিশ দু’টি শুনতে ভাল লেগেছে। তবে এ ক্ষেত্রেও বয়সের ভার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিদ খানের গায়ন নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তাঁর অভিজ্ঞ কণ্ঠের কারুকাজে বরাবর মুগ্ধ হয়েছেন শ্রোতারা। এ বারও সেই মুগ্ধতার আবেশ ছিল। গোরখ কল্যাণের বিলম্বিত বন্দিশটি ভাল গেয়েছেন শিল্পী। রাগবিস্তারে তাঁর সুপরিচিত মেজাজ ধরা দিল। মুরাদ আলির সারেঙ্গি তাতে অতিরিক্ত আবেদন জুড়ে দিয়েছিল। এ বারও রাশিদ শ্রোতাদের পছন্দের গান ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ শোনাতে ভোলেননি। তবে শিল্পীর কাছে একটাই অনুযোগ, রাগ নির্বাচনে তিনি আর একটু ব্যতিক্রমী হলে ভাল হত।

শুভদা পরাদকর শোনালেন বাগেশ্রী অঙ্গের জয়জয়ন্তী। তিলওয়ারা তালে নিবদ্ধ বিলম্বিত বন্দিশ আলাপে, বিস্তারে, তানের কারুকার্যে চলমানতা পেয়েছে। শিল্পীর গায়কিতে পাওয়া গেল বলিষ্ঠ এক প্রকাশভঙ্গির পরিচয়। তাঁর সুরবিস্তারের ধরন খানিক আক্রমণাত্মক, পেলবতার ভাগ একটু কম। এই শৈলী তাঁকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে ঠিকই, তবে মাঝে মাঝে গানকেও ছাপিয়ে যাচ্ছিল গায়নশৈলী।

ললিত গেয়ে শোনালেন শিল্পী মঞ্জুষা পাটিল। তিলওয়ারা তালে সৃজিত বিলম্বিতটি বেশ ভাল গেয়েছেন। তাঁর কণ্ঠের বুনোট চমৎকার। ব্যাপ্তিও প্রশংসনীয়। দৃপ্ত ভঙ্গির আলাপ, লয়কারি এক মুহূর্তের জন্যও অসচেতন হতে দেয়নি। এর পর শোনালেন জনপ্রিয় দু’টি ভজন। তবে ললিত যতটা ভাল গেয়েছেন, ভজন দু’টি তেমন দাগ কাটেনি মনে। সুরবৈচিত্র আনতে গিয়ে মাঝেমাঝে সুর থেকে বিচ্যুত হয়েছেন শিল্পী।

শিল্পী গৌরী পাথারে নন্দ রাগে বিলম্বিত আর দ্রুত শোনালেন। তাঁর কণ্ঠে দৃঢ়তার পাশাপাশি মিষ্টত্বও রয়েছে। তবে রাগের চলনে মন্দ্র এবং তার সপ্তককে একটু এড়িয়ে চলেছেন শিল্পী। পরবর্তী রাগ বসন্তেও একইভাবে তার সপ্তককে এড়িয়ে গেলেন, যেখানে তার সপ্তকেই সেই রাগের পরিপূর্ণতা। ‘রঙ্গি সারি গুলাবি চুনরিয়া’ আর ‘রং ডারুঙ্গি নন্দ কে লালন পে’ গান দু’টি তেমন ভাল লাগেনি।

যন্ত্রসংগীতে এ বার দেখা গেল পিতা-পুত্রের জুটি। শাহিদ পারভেজ খান-শাকির খান, বিশ্বমোহন ভাট-সলিল ভাট, এল সুব্রহ্মণ্যম-অম্বি সুব্রহ্মণ্যম— এই তিন জুটিকে দেখা গেল ডোভার লেনের মঞ্চে।

শাকির খানের সেতারবাদনে চমৎকার রূপ নিল চারুকেশী। রূপক তালে নিবদ্ধ গৎ বাজালেন তিনি। আলাপে তাঁর বাজনের বলিষ্ঠতা ধরা দিল। সেতারবাদনে তিনি পিতার অনুসারী। মীড়ের ব্যবহারে পিতার শিক্ষণের ছাপ স্পষ্ট। দ্রুত গতিতেও তিনি সুর থেকে বিচ্যুত হননি।

পুত্রের পরে মঞ্চে এলেন পিতা শাহিদ পারভেজ খান। ভোররাতের আসরকে বাঁধলেন টোড়ি রাগে। আলাপ-জোড়-ঝালায় অনবদ্য তাঁর বাদন। বিলম্বিত গতেও তিনি স্বমহিমায় ধরা দিলেন। সুর থেকে সুরান্তরে যাওয়ার পথে মীড়ের প্রয়োগ, যাকে সাংগীতিক পরিভাষায় ‘ঘষিট’ও বলা হয়ে থাকে, তার ব্যবহার এ বারও শ্রোতাদের মুগ্ধ করল।

বিশ্বমোহন ভাট-সলিল ভাট বাজালেন নটভৈরব। নটভৈরবের গাম্ভীর্য ফুটে উঠল আলাপে। দ্রুতগতির সঞ্চারে পিতা-পুত্রের যুগলবন্দি মন্দ লাগেনি।

সেই তুলনায় খানিক হতাশ করেছেন অম্বি সুব্রহ্মণ্যম। তিনি শোনালেন দক্ষিণী রাগ সম্মুখপ্রিয়া। তাঁর বেহালাবাদনে স্বচ্ছতার অভাব ছিল। তবলা এবং মৃদঙ্গের আওয়াজে বেহালাবাদন চাপা পড়ে গিয়েছে। অন্য দিকে এল সুব্রহ্মণ্যমের বেহালায় অভিজ্ঞ হাতের স্পর্শ পাওয়া গেল। আদি তালে নিবদ্ধ রাগ কাম্বোজি আর খণ্ডচাপু তালে চন্দ্রপ্রিয়া রাগ শোনালেন শিল্পী। তবে দ্রুতগতি সঞ্চারের সময় তবলা, মৃদঙ্গ বা বেহালা কোনওটার চলনই তেমন স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায়নি। উদ্বোধনী মঞ্চে রাজেন্দ্র প্রসন্নের সানাই বেশ হতাশ করেছে। ইমনে বিলম্বিতের পর পরিচিত একটি কম্পোজিশন বাজিয়ে শোনালেন। বেশ কয়েক বার সুর থেকে বিচ্যুত হয়েছেন শিল্পী। ইমনের চলনে তেমন বৈচিত্রও ধরা পড়েনি। এ ছাড়াও তিনি বেনারস ঘরানার নিজস্ব কিছু কম্পোজিশন বাজিয়ে শোনালেন।

ডোভার লেন বরাবরই নতুনদের সুযোগ করে দিয়েছে। এ বারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তরুণ সরোদিয়া দেবাঞ্জন ভট্টাচার্য শোনালেন বাগেশ্রী কানাড়া। আলাপ-জোড়-ঝালার পর তিনতালে একটি গৎ বাজালেন শিল্পী। মোটের উপর তাঁর সরোদবাদন খারাপ লাগেনি।

এ বারও অনুপমা ভাগবত জিতে নিলেন শ্রোতাদের হৃদয়। কৌশীকানাড়া বাজিয়ে শোনালেন তিনি। নিবিষ্ট চিত্তে সুরসঞ্চালনায় মন দিলেন। ক্রমশই তিনি রাগের গভীরে প্রবেশ করলেন। ধীর লয় হোক কিংবা দ্রুত লয়— অনুপমা সবক্ষেত্রেই সাবলীল। অনুষ্ঠান শেষ করলেন মিশ্র কাফিতে হোরি বাজিয়ে।

তিন তরুণের জুটি— ইন্দ্রজিৎ রায়চৌধুরী, মাটিয়াস ভোল্টার এবং জোনাথন মায়ার, যাঁরা অধিক পরিচিত ‘সুব্রত ট্রিনিটি’ নামে, তাঁদের সেতারবাদনও মন্দ লাগেনি। বেহাগে আলাপ-জোড়-ঝালার পর বিলম্বিত গৎ এবং তাকে অনুসরণ করেই মধ্যলয় এবং দ্রুতলয়ে দু’টি গৎ বাজালেন। প্রতিটি কম্পোজিশনই ত্রিতালে নিবদ্ধ। বেহাগের রূপবৈচিত্র যত্ন নিয়ে ফুটিয়ে তুললেন।

শাহিদ পারভেজ

রনু মজুমদার এবং কাদরি গোপালনাথের যৌথ পরিবেশনা চলনসই। বাঁশি এবং স্যাক্সোফোনের এই জোটবন্ধন মন্দ নয়। তাঁরা বাজালেন নটভৈরব।

তরুণ ভট্টাচার্য এবং মাইসোর এম মঞ্জুনাথের সন্তুর ও দক্ষিণী ভায়োলিনের জুটিও উপভোগ্য ছিল। তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন কিরওয়ানি। আলাপ বেশ ভাল লেগেছে। তবে তবলা-মৃদঙ্গের সঙ্গে কসরত দেখাতে গিয়ে বেশ কয়েক বার তাল থেকে নড়েছেন তাঁরা।

সরোদে বসন্ত কাবরা শোনালেন কৌশীকানাড়া। আলাপ-জোড়-ঝালায় তিনি মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তবে সে দিন তাঁর সরোদবাদনে মীড়ের প্রয়োগ বেশ দুর্বল লেগেছে। মাঝখামাজে কম্পোজিশনগুলি অপেক্ষাকৃত ভাল বাজিয়েছেন শিল্পী। রুদ্রবীণা বাজিয়ে শোনালেন জ্যোতি হেগড়ে। চন্দ্রকোষ রাগে ধ্রুপদ বন্দিশ বাজালেন তিনি। চৌতালে নিবদ্ধ বন্দিশটি ভাল বাজিয়েছেন। পরবর্তী রাগ দরবারি কানাড়ায় আলাপ ভাল লেগেছে। যদিও আগাগোড়া একটু বেসুর বেজেছে তাঁর রুদ্রবীণায়।

এ বারও হৃদয় কেড়ে নিলেন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। যোগকোশ বাজিয়ে শোনালেন বর্ষীয়ান এই শিল্পী। যোগকোশের পর একে একে বাজালেন দুর্গা, পাহাড়ি। প্রতিটিই ছিল শ্রুতিমধুর। তিনি যে বাংলার সঙ্গে নিবিড় মমতায় আবদ্ধ, তা বোঝা গেল বাঁশিতে বেজে ওঠা কীর্তনের ধুনে। অনুষ্ঠান শেষ করলেন জনপ্রিয় ভজন ‘বৈষ্ণবজন তো’ বাজিয়ে।

চারদিনব্যাপী এই সংগীত সম্মেলনে যাঁরা শিল্পীদের সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের মধ্যে তবলায় শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, রামকুমার মিশ্র, সাবির খান, তন্ময় বসু, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, হারমোনিয়ামে জ্যোতি গোহো, রূপশ্রী ভট্টাচার্য, মুকুন্দ পেটকর, গৌরব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের কথা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

Music Dover Lane Music Conference Rashid Khan Shahid Parvez Anupama Bhagwat Musicians অনুপমা ভাগবত শাহিদ পারভেজ রাশিদ খান
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy