Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ত্রি.শঙ্কু

ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু, তিনি কি প্রদোষ মিত্তিরের ছায়া? সিধুজ্যাঠার প্রতিচ্ছায়া? অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রাখলেন বিশ্বজিৎ রায়কোথায় যাননি তিনি? মহাকাশে, নিভৃত নির্জন দ্বীপে, গভীর অরণ্যে, মরুভূমিতে, জলের তলায়। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে ভিনগ্রহীদের। সেই ভিনগ্রহীরা দিয়ে গিয়েছিল ‘একটি দেদীপ্যমান প্রস্তরখণ্ড’। মটরদানার অর্ধেক মাপের আশ্চর্য পাথরটির মধ্যে নাকি ধরা আছে ‘মানবজাতির চারটি প্রধান সংকটের সমাধান’।

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

কোথায় যাননি তিনি? মহাকাশে, নিভৃত নির্জন দ্বীপে, গভীর অরণ্যে, মরুভূমিতে, জলের তলায়।
তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে ভিনগ্রহীদের। সেই ভিনগ্রহীরা দিয়ে গিয়েছিল ‘একটি দেদীপ্যমান প্রস্তরখণ্ড’।
মটরদানার অর্ধেক মাপের আশ্চর্য পাথরটির মধ্যে নাকি ধরা আছে ‘মানবজাতির চারটি প্রধান সংকটের সমাধান’। রাতের অন্ধকারে, বিছানায় শুয়ে সেই আলোকিত রত্নখণ্ডের দিকে চেয়ে থাকেন তিনি।
মানুষের মনের অন্ধকার দূর করার প্রেরণা জোগায় সেই আলো। এটাই তো তাঁর কাজ— সত্যজিতের ফেলুদা, সিধু জ্যাঠা, শঙ্কু এঁরা সবাই তো মানুষের মনের অন্ধকার দূর করতেই চেয়েছিলেন। যাঁরা অপরের মগজ ধোলাই করে নিজেদের কাজে লাগাতে চান তাঁদের বিরুদ্ধেই তো সারা জীবন সত্যজিতের লড়াই। এ লড়াই তাঁর, প্রোফেসর শঙ্কুরও ।
গিরিডিনিবাসী ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। সত্যজিতের প্রিয় চরিত্রগুলোর মধ্যে প্রবীণতম। ‘স্বর্ণপর্ণী’ গল্পে শঙ্কুর যে আত্মজীবনকথা আছে, সেই অনুসারে হিসেবনিকেশ করলে দেখা যাবে তিনি ১৯১১-১২ সাল নাগাদ জন্মেছিলেন ।
১৯১২-তেই প্রকাশিত হয়েছিল আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ । হারানো আদিম পৃথিবী দেখে এসেছিলেন কোনান ডয়েলের প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। সে এক আশ্চর্য রোমহর্ষক আখ্যান।

ছাত্রজীবনে গোগ্রাসে এ সব পড়তেন সত্যজিৎ। তাঁর বাংলা গল্পের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকায় লিখেছিলেন শঙ্কু ‘mild-mannered version of Professor Challenger’। সে ১৯৮৭ সালের কথা। কোনান ডয়েলের চ্যালেঞ্জার ভীষণ রাগী, মারমুখী। সাংবাদিকরা তাঁকে সমঝে চলেন, ভয় পান।

সন্দেশ পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত শঙ্কুর প্রথম গল্প ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’-তে শঙ্কু বেশ মারমুখোই। সাতাশ বছর ধরে তাঁর কাছে কাজ করছে যে প্রহ্লাদ, সেই প্রহ্লাদের ছোট একটা ভুলে শঙ্কু রেগে টং। স্নাফ-গান বা নস্যাস্ত্র প্রহ্লাদের গোঁফের কাছে প্রয়োগ করেছিলেন শঙ্কু।

বেচারা প্রহ্লাদ তার পর প্রায় চল্লিশ ঘন্টা হেঁচেছিল। খেয়ালি বাদশাহরা যেমন লোকের দাড়িতে দাড়িতে বেঁধে দিয়ে আমোদ পেতেন এ’ও যেন তেমনই। খেয়ালি বিজ্ঞানী নস্যাস্ত্র মেরে রাগ মেটালেন। তবে সন্দেশে প্রকাশিত ষাটের দশকের এই প্রথম গল্পে শঙ্কু যা ছিলেন আর পরে যা হলেন তা মোটেই এক নয়। এই অন্য শঙ্কুর কথায় ভরা ‘স্বর্ণপর্ণী’। সে কাহিনি লিখলেন সত্যজিৎ তাঁর জীবনের প্রান্তপর্বে ।

শঙ্কু বারো বছরে ম্যাট্রিক, চোদ্দোয় আইএসসি আর ষোলো বছরে ফিজিক্স কেমিস্ট্রিতে অনার্সে ভাল নম্বর নিয়ে বিএসসি করল। শঙ্কুর বাবা অবশ্য কচি বয়সে ছেলেকে চাকরি করতে নিষেধই করেছিলেন, ভালোই করেছিলেন। উপনিবেশী প্রভুর তাঁবে চাকরি করার আগে বছর চারেক শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করে শঙ্কুর মেজাজ-মর্জি গেল বদলে ।

শঙ্কুর বিজ্ঞানবুদ্ধির সঙ্গে মানবিকবিদ্যার মিশেল হল । প্রযুক্তিবিদ নন, শঙ্কু হয়ে উঠলেন স্রষ্টা ও দ্রষ্টা— প্রকৃতিকে দেখেন, মানুষকেও, আর বানিয়ে ফেলেন নানাবিধ যন্ত্র। সেই সব যন্ত্রপাতি মানুষ ও সভ্যতার ভাল চায় – শঙ্কুর ভাবনার মধ্যে গভীর এক নীতিবোধ কাজ করে যায়।

‘স্বর্ণপর্ণী’ যখন লিখছেন সত্যজিৎ, তখন তাঁর সিনেমা ‘শাখাপ্রশাখা’ ‘আগন্তুক’ তৈরি হয়ে গেছে। এই দুই ছবিতেই সত্যজিৎ উচ্চকণ্ঠ— আধুনিক সভ্যতা ও প্রযুক্তির অমানবিক ক্ষমতার বিরোধী তিনি। তাই শঙ্কুর প্রাথমিক কল্পনায় প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের ছায়া হয়তো ছিল কিন্তু সেই ছায়াকে ফেলেই দিয়েছিলেন তিনি। যাঁর কাজের টেবিলে সকালবেলার আলো এসে পড়ত তিনি কি প্রকৃতির উদারতা আর মানবতাকে ভুলতে পারেন? জাপানের ওসাকায় বসে শঙ্কু তাঁর ডায়রিতে লিখেছিলেন, ‘‘জটিল যন্ত্র তৈরির ব্যাপারে এখনও প্রকৃতির ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি মানুষ।’’

তবু মানুষের লোভের সীমা নেই । লোভীরা ‘অপর’ মানুষকে, প্রকৃতিকে দখল করতে চায়। দুষ্টু বিজ্ঞানী ম্যাসিংহ্যাম। কঙ্গোর জঙ্গলের গভীরে ম্যাসিংহ্যামের মগজ নিয়ন্ত্রণের কারখানা।

ম্যাসিংহ্যাম ইস্পাতজাতীয় কোনও ধাতুর থেকে বানিয়েছিল বাটির মতো টুপি। সেই টুপি যার মাথায় সে ম্যাসিংহ্যামের দাস— যন্ত্রচালিত, থমকানো, মুহ্যমান। কন্ট্রোলরুম থেকে বোতাম টিপে তাকে যেমন খুশি চালানো যাবে। শঙ্কু ম্যাসিংহ্যামের টুপির পাল্লায় পড়েছিল। তাকে বাঁচিয়েছিল সে বার প্রতিবেশী অবিনাশবাবু।

সত্যজিতের ‘হীরক রাজার দেশ’য়ের যন্তর মন্তর ঘরে মগজ ধোলাই হত । গান গেয়ে কৌশল করে সাধারণ মানুষকে মগজ ধোলাইয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল গুপী-বাঘা । দুষ্টু রাজা আর তার সহকারী মন্ত্রীদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ক্ষমতাতন্ত্র ভাঙার মন্তর। হীরকরাজ্যে শান্তি ফিরেছিল। ম্যাসিংহ্যামের মগজধোলাইকর টুপির হাত থেকে শঙ্কুকে বাঁচালেন অবিনাশবাবু।

‘শঙ্কু ও ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ গল্পে অবশ্য শঙ্কু নিজেই নব্য নাৎসিদলের নেতা রেডেলের মগজ বদলে দিয়েছিলেন জার্মানির ইনগোলস্টাট। রেডেল আর তার দলবল হিটলারের চিন্তাধারা আবার জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করতে নেমে পড়েছে। ইহুদি বিদ্বেষের বীজ বপন করছে তারা। অস্ত্র দেখিয়ে তাদের পার্টির জন্য টাকা আদায় করছে। এই রেডেলের দল খুন করল বোরিস অ্যারনসনকে।

অ্যারনসন ছিলেন দর্শনের অধ্যাপক, অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। দুষ্টু রেডেলের মাথায় কায়দা করে মৃত অ্যারনসনের মগজ ঢুকিয়ে দিলেন শঙ্কু। ব্যাস কেল্লা ফতে। মৃত রেডেল অন্য রেডেল হয়ে বেঁচে উঠল। পুনর্জীবনপ্রাপ্ত রেডেল তার অনুচরদের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠল, ‘দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে। তোমরা সব শয়তানের দল। তোমাদের জন্যই জার্মানি আবার জাহান্নমে যেতে চলেছে।’ এর পর রেডেলের দল ভেঙে গেল। এও আর এক হীরক রাজ্য উদ্ধার।

মগজাস্ত্র আসলে নানা রকম। বিপ্লব ও প্রতিরোধের পদ্ধতিও এক রকম নয় । বুদ্ধি খাটিয়ে কৌশল ঠিক করা চাই। তবে মূল কতগুলি নীতি মেনে চলতে হবে— অন্তত শঙ্কু মেনে চলতেন ।

তাঁর ডায়রিতে কথাগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, কিন্তু গল্পের টানে সেই নীতিবাক্যগুলি আলাদা করে চোখে পড়ে না, ঠিক কানে লেগে যায়। ‘মানুষের সব জেনে ফেলার লোভের একটা সীমা থাকা উচিত’— লিখেছিলেন ত্রিলোকেশ্বর।

‘জানার লোভ’ এই উচ্চারণের সামনে একটু থমকে যেতে হয়। এই সত্যজিৎ-ই তো ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে ছড়া বানিয়েছিলেন, ‘‘যত বেশি জানে / তত কম মানে।’’ জানাটাই তো জরুরি। জানার যুক্তিতেই তো অন্যের জুলুম খণ্ডন করা যায়। তাহলে !

আসলে জানার অহমিকা ভাল নয় । তা খুবই ক্ষতিকর। নিজের পক্ষেও, অপরের পক্ষেও। বিজ্ঞানী ডিমেট্রিয়াস। একটা ওষুধ আবিষ্কার করলেন তিনি। সে ওষুধ খেলে যে-কোনও প্রাণীর আয়তন বহুগুণ বেড়ে যায়। ডিমিট্রিয়াসের বেড়াল অতিকায় চেহারা নিচ্ছিল, বেগতিক দেখে ডিমিট্রিয়াস তাকে গুলি করে মারেন। তবে কৌতূহল যায়নি। ‘‘সে খাঁটি বৈজ্ঞানিকের মতোই জানতে চেয়েছিল, তার ওষুধের দৌড় কত দূর।’’

শঙ্কু লিখেছেন, সে জানা তার পক্ষে বড় মর্মান্তিক। তার বন্ধুদের পক্ষেও। কায়রো। সামনে মরুভূমি। প্রলয়ংকর ভূমিকম্প। বৃষ্টিবাণে বিদ্ধ হচ্ছেন শঙ্কু। উট ও উটওয়ালারা কোথায় কে জানে? বন্ধু সামারভিল! কোথায় সে! বেঁচে আছে তো!

ক্রমে দুর্যোগ থামল। চোখ দেখতে পেল। চাঁদ উঠল। শঙ্কু দেখলেন সামনে সামারভিল। আর সামারভিলের সামনে ওটা কী? ছোটবেলায় পড়া গালিভারের গল্পের ছবি যেন খানিকটা ভেসে ওঠে পাঠকদের সামনে। তবে এ ছবির মেজাজ আলাদা। লিলিপুটেরা গালিভারের সামনে দাঁড়িয়ে, এ তা নয় ।

দুই খ্যাতিমান পূর্ণবয়স্ক বিজ্ঞানী দাঁড়িয়ে আছেন এক বিশালকায় মানবমূর্তির সামনে। সেই মূর্তির পুরোটা দৃষ্টিগোচর হয় না। শুধু বালির ওপরে জেগে আছে ডিমিট্রিয়াসের মুখ। কারখানায় যাওয়ার সুড়ঙ্গ বলে মনে হয়েছিল যা, তা আসলে নাকের ফুটো। পাহাড়টা একটা শুয়ে থাকা মানুষের নাক। এই যে অতিকায় হওয়ার বাসনা তা কোথায় নিয়ে গেল ডিমিট্রিয়াসকে? নিয়ে গেল মৃত্যুর কাছে।

মৃত ডিমিট্রিয়াসের এই অতিকায় দেহের আস্বাদ পাওয়ার জন্য পঙ্গপালের মতো আকাশ ছেয়ে ফেলল হাজার হাজার শকুনি। ‘‘দেখে মনে হয় পৃথিবীতে যত শকুনি আছে সব একজোট হয়ে ছ’হাজার ফুট লম্বা মানব-দানবের শবদেহ ভক্ষণ করতে আসছে।’’ যে জানার বাসনা মানুষকে এমন দানব করে তোলে, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে যে জ্ঞান, সেই জ্ঞানের লোভ আর অহমিকা থেকে দূরে থাকা চাই।

এই জানার অহমিকা আরও একটা কাণ্ড করে। মনে করে সভ্যতার ইতিহাস বুঝি খালি এগিয়ে যাওয়ারই ইতিহাস। এই ভাবনারও বিরোধিতা করেন শঙ্কু – তাঁর কাজে-কম্মে। শঙ্কুর অ্যাডভেঞ্চারে মাঝে মাঝেই অতীত হানা দিয়ে যায়। অতীত সভ্যতার নানা আবিষ্কার আর উপাদানের মুখোমুখি তিনি। সেই অতীত শুধু পাশ্চাত্যের অতীত নয় —প্রাচ্যের অতীতও।

জার্মানিতে ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের গবেষণাগারে দেড়শো বছরের পুরনো যন্ত্রপাতির চমৎকারিত্ব টের পেয়েছিলেন শঙ্কু। আর বাগদাদে? শঙ্কু তার ডায়রিতে লিখলেন, ‘‘ধন্য হারুণ-অল্‌-রশিদের বাগদাদ্‌! ধন্য সুমেরীয় সভ্যতা! ধন্য বিজ্ঞানের মহিমা! ধন্য গেমাল নিশাহির অল্‌ হারারিৎ! আমার এ উল্লাসের কারণ আর কিছুই না – আজ একটি এমন বৈজ্ঞানিক প্রতিভার পরিচয় পেয়েছি যার কাছে আমাদের কৃতিত্ব একেবারে ম্লান হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।’’

বিজ্ঞান আর সভ্যতা যেন বিশাল সমুদ্র। সেখানে উচ্চতার ঢেউ ওঠে আবার ভেঙে যায়। আমরা আধুনিকরা আগের সভ্যতার থেকে এগিয়ে আছি এমন না ভেবে শঙ্কু ভাবেন সভ্যতা ওঠে ও পড়ে। সেই নিশানগুলি খুঁজে বের করা চাই।

আধুনিক মানুষ তাঁর উচ্চতর পূর্বজের হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার সামনে যেন নত হতে শেখেন। ‘আগন্তুক’ ছবিতে উৎপল দত্তকে দিয়ে এ কথাটাই আরেক ভাবে বলিয়েছিলেন সত্যজিৎ। গুহাবাসী মানুষকে আমরা যেন আদিম অসভ্য বলে না ভাবি। কোচাবাম্বার গুহায় সেই প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরই একজনকে দেখেছিলেন শঙ্কু — সেই মানুষ আশ্চর্য অফুরন্ত আয়ুর অধিকারী, ‘হাজার হাজার বছর ধরে জ্ঞান সঞ্চয় করে চলেছে’ সে ।

পুরনো জ্ঞানের কাছে নত হতে হয়, পুরনো জ্ঞান আর নমুনাকে কুক্ষিগত করতে চাইলে কিন্তু সে হারিয়ে যায়। মার্কোভিচের তো সে দশাই হয়েছিল। ডুংলুং-ডো এক আশ্চর্য দেশ । সেখানে রয়েছে ইউনিকর্ন— মহেঞ্জেদাড়োর সিলে খোদাই করা ইউনিকর্ন। মার্কোভিচ ইউনিকর্ন কোলে করে পাঁচিল ঘেরা সে রাজ্যের বাইরে যেতে চাইলেন।— ‘‘লাফটা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার কোল থেকে ইউনিকর্নের বাচ্চাটা উধাও হয়ে গেল, আর পরমুহূর্তেই মার্কোভিচের নিম্নগামী দেহ প্রাচীরের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।’’

গত শতকের ষাটের দশক থেকে শঙ্কুর যাত্রা শুরু। স্বাধীন ভারতকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে তখন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে রাষ্ট্র। নদীর ওপর বাঁধ, মহাকাশে গতায়াত, উচ্চফলনশীল চাষ, বৃহৎশিল্পের উত্থান— এ সব তখন রাষ্ট্রের তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গে কুসংস্কার দূরীকরণের কাজে হাত লাগাচ্ছে বিজ্ঞান মঞ্চ।

এই সময় শঙ্কু, সত্যজিতের শঙ্কু বিজ্ঞানের এই প্রায়োগিক দিকের বাইরে আরেক রকম করে বিজ্ঞানের কথা ভাবছেন। তার বিচিত্র আবিষ্কারগুলি কারখানায় উৎপাদন করা যায় না, ব্যক্তিগত গবেষণাগারই ভরসা। কম পয়সায় আশ্চর্য সব জিনিস বানিয়ে ফেলেন তিনি। তাঁর হাসি-খুশি কাজের রোবুর নির্মাণ কার্যে আর ক’টাকাই বা খরচ। যে বিজ্ঞান আর যে পেটেন্ট টাকার রাজ্যে বিজ্ঞানীর জন্য ঘর-দুয়ার অবাধ করে দেয়, সেই বিজ্ঞান শঙ্কুর নয়। যে সিনেমা প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ সেই সিনেমাও সত্যজিতের নয়। গুপী গাইন বাঘা বাইনের রূপকথা বানাতে খুব বেশি খরচ করেননি সত্যজিৎ— সিনেমায় প্রযুক্তির ম্যাজিক দেখাতে তিনি নারাজ।

শঙ্কুর কাছেও বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি আলাদা। এই সহজ কথাগুলো শঙ্কুর গল্প পড়তে পড়তে কখন যে মাথায় ঢুকে যায়। আর একটা কথা, শঙ্কুর গল্প কিন্তু যুক্তিবাদী বিজ্ঞানের পরিধিকে মাত্র ছুঁয়ে নেই।

বিজ্ঞানের অন্য ঘরানাতেও তাঁর অবাধ যাতায়াত। পরলোকচর্চা করার জন্য শঙ্কু বানিয়ে ফেলেন ‘কম্পিউডিয়াম’। শঙ্কুর এই বিশ্বাস ও কাণ্ডের সঙ্গে ইহবাদী ও প্রত্যক্ষ যুক্তিবাদীদের বিরোধ অনিবার্য। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, সত্যজিৎ তো ‘সোনার কেল্লার’ লেখক। মুকুলের গতজন্মে বিশ্বাসী। নিরেট যুক্তিবাদে যে সবার বিশ্বাস থাকবে এমন নয় । ‘‘ভূতপ্রেত প্ল্যানচেট টেলিপ্যাথি ক্লেয়ারভয়েন্স— এ সবই যে একদিন বিজ্ঞানের আওতায় এসে পড়বে এ বিশ্বাস আমার অনেক দিন থেকেই আছে।’’— শঙ্কুর এই স্বীকারোক্তি এক দিক থেকে অনেকের পক্ষেই অস্বস্তিদায়ক।

ভূত নামানো, প্ল্যানচেট করা এ সবের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে ফেলুদা সরব। তা হলে শঙ্কুর কেন এই পিছুটান? আসলে জোচ্চোরদের জগৎ আলাদা, তার বাইরে আছে বিস্ময়ের জগৎ, অবাক হওয়ার জগৎ়। এই অবাক করা জগৎকে নানা দিক দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন শঙ্কু। বিস্ময়ের ম্যাজিকেই তো বিজ্ঞানের এগিয়ে যাওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE