তাঁরা গ্যালারির বৃহৎ পরিসরকে প্রত্যক্ষ করেছেন অনেক আগেই। সেই অনুপাতে চিত্রকলা, ভাস্কর্য, ইনস্টলেশনের অবস্থান ও তার চরিত্র অনুযায়ী শিল্পকর্মের গুণাগুণ সম্পর্কেও তাঁরা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। প্রত্যেকে তাঁদের দক্ষতাকে যেন চূড়ান্ত পর্বে নিয়ে গিয়েই কাজ করেছেন। পাঁচ তরুণ শিল্পীর ১৬টি শিল্পকর্ম নিয়ে ইমামি আর্টের এই ‘ফ্লুয়িড বাউন্ডারিজ়’ একটি অসাধারণ প্রয়াস। ইমামি আর্টের টিমওয়ার্কের পদ্ধতি ও সপ্রতিভ কর্ম-সম্পাদন প্রদর্শনীর ভাবনা, শিল্পী নির্বাচন ও ডিসপ্লে সম্পর্কে বরাবর এক সাক্ষ্য বহন করে। প্রদর্শনীটি সম্প্রতি শেষ হল। একটি বড় মাপের প্রদর্শনীকে কী ভাবে উপস্থাপন করলে দর্শকের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে, এ বিষয়টি তাঁরা প্রথম থেকেই গভীর সচেতনতার সঙ্গে পালন করে আসছেন।
এক-একটি শিল্পকর্ম তাদের নিজস্ব অবস্থানের প্রেক্ষিতে লাইট, স্পেস, ডিসট্যান্সকে যথাযথ ভাবে উপলব্ধি করায়। আপাত-বৃহৎ ভাস্কর্য বা দ্বিমাত্রিক দীর্ঘ চিত্রকলার ক্ষেত্রে উপরোক্ত ধারণাগুলি স্পষ্ট হয় ডিসপ্লের জন্যও। অবস্থানগত ভাবে শিল্পবস্তুটির আকার, ওজন, দৈর্ঘ্য, উচ্চতা সবই নির্ভর করে কী ভাবে রাখলে নয়নসুখকর হবে, তার উপরে। এ সব ক্ষেত্রে শিল্পী-ভাস্করের ভূমিকা ও ভাবনাই প্রধান। ‘ফ্লুয়িড বাউন্ডারিজ়’-এর শিল্পকর্মগুলি প্রত্যক্ষ করে বেশ বোঝা যায় যে, প্রতিটি কাজের নির্দিষ্টতা যেন শিল্পী-ভাস্করদের স্বাধীন চিন্তা-ভাবনাকে ভীষণ ভাবে উন্মুক্ত করেছে। এই উদ্দামতা ও প্রয়োজনীয় সংযম যেন সেই কাজটিকে আরও প্রাঞ্জল করেছে। শিল্পের নিজস্ব একটি ভাষা যেন আলাদা ভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কাজগুলির সামনে দাঁড়িয়ে এই বোধ জাগ্রত
হতে বাধ্য।
সুদূরপ্রসারী ভাবনা, বিবিধ সংকট, সমাজ, দলবদ্ধতা, একক অবস্থানের প্রেক্ষিত, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতা, কীটপতঙ্গ, জন্তু-জানোয়ারের জীবন, মুক্তির সন্ধান, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, স্মৃতি, জমি-মাটি-ভূখণ্ডের শ্বাসপ্রশ্বাস, তার শব্দ-নৈঃশব্দ্য, জীবনের সীমাবদ্ধতা ও সীমাহীনতা, স্থাপত্য, আকাশ, মেঘ, জল-স্থল, ঘাট, অজস্র মানুষের মিলনস্থল, ক্ষমতায়ন, শাসক, নতুনত্বের প্রতিষ্ঠা, উত্থান-পতন— এমন বহু ভাবনার সমন্বয় এই ষোলোটি কাজে চরম স্বাধীনতায় শিল্পীরা প্রকাশ করেছেন। বাউন্ডারি বলে কিছু নেই, বাউন্ডারির বাইরের জগৎটা আরও উন্মুক্ত। শিল্পীর এই স্বাধীনতা, মুক্তিতেই শিল্পের অগ্রগমন। মধ্যবর্তী বলে কিছু নেই। লড়াই আছে, জীবন আছে, সংগ্রাম, ভাল লাগা, যন্ত্রণা, কষ্ট, জয়, আনন্দ... সব কিছুকে নিয়েই জীবন।
তাপস বিশ্বাসের ভাস্কর্যগুলির নিজস্বতার আড়ালে এক-একটি বাস্তবতার প্রেক্ষাপটকে চেনা যায়। কিছুটা চ্যাপ্টা তিনটি ভাগে, বিরাট আকারের ব্রোঞ্জের ‘বারাণসী’। কীটপতঙ্গের ক্ষুদ্রতম নির্মিত বাসার অনুকরণে ‘অ্যাবানডানড’ আয়রন ওয়্যারের যত্নে নিপুণ ভাবে তৈরি অমন বৃহৎ বাসার সন্নিবেশিত অবস্থান। আধ ইঞ্চিরও ছোট পাইন কাঠের অগুনতি টুকরোর সমন্বয়ে পিতলের কাঠামোয় তৈরি ছন্দোময় পাপড়ি-সদৃশ বিরাট ‘প্রেজ়েন্ট ইনভাইট ফিউচার’ অনবদ্য কাজ। যেমন তাঁর ‘ফ্লাওয়ার বিকাম ফসিলাইজ়ড’। এটিও তারের প্যাঁচানো ডিজ়াইনের ওই পতঙ্গ-বাসার ফর্মেশন ধরে তামার তারে গড়েছেন। চমৎকার এর বিশালত্ব ও বর্ণ। স্থাপত্য ও বিবিধ রেখা যেন তাঁর কাজে আশ্চর্য ভাবে উপলব্ধি করা যায়। একটা টেকনিক্যাল জায়গা থেকে আর্কিটেকচারাল জায়গায় চলে যাওয়া যেন।
দু’টি ইনস্টলেশনের ভাষা দু’রকম। নানা মাধ্যম ব্যবহারে এক দিকে শাসন-ক্ষমতা, চেয়ার, শূন্য চেয়ার, লাল মসনদ, চেনপুলি, পাওয়ার, মুভমেন্ট, স্টেপ, পুনর্বিন্যাস, সংসদের একটা চেহারাকে ব্যঙ্গ করেছেন দেবাশিস বারুই নিজস্ব দক্ষতায়। এ-ও এক সত্য— যেমন চায়না ক্লে, ল্যাটেক্স, মেকানিক্যাল গ্যাজেটসে প্রাণবন্ত জমি তৈরি করেছেন, তার হার্টবিট শোনা যাচ্ছে, প্রত্যক্ষ করাও যাচ্ছে। ওই মাটিই শক্তি, একই সঙ্গে হার্ট।
স্নেহাশিস মাইতির ক্যানভাসের চারটি তেলরঙের কাজ প্রশ্নাতীত দক্ষতায় সম্পন্ন। চমৎকার রিয়্যালিজ়ম। সূক্ষ্মতা ও পরিসরের নাটকীয় মুহূর্ত অনন্য। ব্রাশিং ও ট্রিটমেন্ট ক্ষমতাসম্পন্ন। গল্প আছে। স্ট্রাকচারাল ব্যাপারগুলো, গ্রিন ল্যান্ডের ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া, কনস্ট্রাকশন, স্থাপত্য— সবই তাঁকে ভাবায়। নিরাপত্তাহীনতার ভাবনাও আসে তাঁর কাজে। আশ্চর্য এক সুররিয়্যালিজ়মও আছে। ডি চিরিকো-র কথা মনে হয়। যথেষ্ট অর্থবহ কাজ। ভোলানাথ রুদ্র, সুমন দে-ও যথাযথ। তাঁদের যৌথ অনলাইন প্রদর্শনীর মতোই।