Advertisement
০৬ মে ২০২৪

সিকিমের কোলে সুন্দরী জোংরি

জঙ্গলের কোলে জোংরি পাহাড়। আঁকেবাঁকে রহস্য। তুষারশৃঙ্গের মাঝে সূর্যোদয়ের দৃশ্য পিছনে ফেলে দিতে পারে যাবতীয় কল্পনা। লিখছেন তিয়াষ মুখোপাধ্যায়।একটি বড় ডর্মিটরি ঘরের ব্যবস্থা করে, গুপ্তাজির হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে, সে রাতের মতো কম্বলের আরামে সেঁধানো গেল ক্লান্ত শরীরগুলোকে। গভীর ঘুমের টুকরো-স্বপ্নে বারবার ভেসে এল পাহাড়ি পথে হাঁটতে-হাঁটতে আচমকা কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখোমুখি হওয়ার স্বপ্ন।

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

যাদের পায়ের তলায় গামবুট, যাদের পিঠে বাঁধা রুকস্যাক, যাদের চোখের তারায় পাহাড়... তাদেরই কয়েক জন মিলে, কোনও এক পুজোর ছুটিতে বেরিয়ে পড়া গেল ট্রেকিংয়ে। গন্তব্য, পশ্চিম সিকিমের পাহাড়, জোংরি। চিরাচরিত ঘোরা নয়, পায়ে হাঁটা ট্রেকিং পথে, বাঁকে বাঁকে পাহাড়ের রহস্য ভেদ করে চুড়ো ছোঁওয়ার আনন্দ আস্বাদন করতে চললাম আট তরুণ-তরুণী।

শিয়ালদহ থেকে পদাতিক এক্সপ্রেসে সারা রাতের যাত্রার পর এনজেপি স্টেশনে পৌঁছতেই, সাদা মেঘ-ভাসা ঝকঝকে নীল আকাশ স্বাগত জানাল শহরের আট মূর্তিকে। সেখান থেকেই ঠিক করা হল বড় গাড়ি। গন্তব্য, ইয়াকসাম। পশ্চিম সিকিমের এই ছোট্ট জনপদ থেকেই শুরু হয় জোংরির উদ্দেশে ট্রেকিং। ট্রেকিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, জ্বালানি, সব মিলবে ইয়াকসামেই।

প্রায় দু’শো কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা উজিয়ে, আট ঘণ্টার যাত্রায় পৌঁছনো গেল ইয়াকসাম। পথে জোরথাংয়ে সেরে নেওয়া হল দ্বিপ্রাহরিক আহার। যখন ইয়াকসাম পৌঁছলাম, বিকেল তখন ফুরিয়ে আসার মুখে। ধূসর আকাশ থেকে হু হু করে নেমে আসছে ঠান্ডা। এক দিনের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭৮০ মিটার অর্থাৎ প্রায় ছ’হাজার ফুট উপরে উঠে যাওয়ার ধাক্কা দিব্যি টের পাওয়া যায়।

একটি বড় ডর্মিটরি ঘরের ব্যবস্থা করে, গুপ্তাজির হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে, সে রাতের মতো কম্বলের আরামে সেঁধানো গেল ক্লান্ত শরীরগুলোকে। গভীর ঘুমের টুকরো-স্বপ্নে বারবার ভেসে এল পাহাড়ি পথে হাঁটতে-হাঁটতে আচমকা কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখোমুখি হওয়ার স্বপ্ন।

পরের দিন, মিঠে রোদে সকালটা সুন্দর হয়ে গেল, যখন ঝকঝকে নীল আকাশে উঁকি মারল তুষারশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। ট্রেকিংয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খাবারদাবার, সব কেনাকাটা সারতে সারতেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন শিরিং, তাশি, লাকপা। আমাদের আগামী ট্রেকিংয়ের দিনগুলোর সঙ্গী, আমাদের গাই়ড, মালবাহক, রাঁধুনি। বেলা দশটা নাগাদ শুরু হল ট্রেকিং। প্রথম দিনের গন্তব্য বাখিম। উচ্চতা ৩০০০ মিটার। দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার।

কাঞ্চনজঙ্ঘা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়্যারির মধ্য দিয়ে শুরু হল হাঁটা। হাসি-মজা করতে করতে হাঁটা শুরু হলেও, কিছু পরেই টের পাওয়া গেল চলার কষ্ট। ইয়াকসাম থেকে বাখিম পর্যন্ত চারটে ঝুলন্ত ব্রিজ আছে। সেই ব্রিজগুলো পার হওয়ার জন্য হুড়মুড়িয়ে নেমে যেতে হয় অনেকটা পাহাড়ি পথ। নামতে কষ্ট হয় না, কিন্তু নেমে ব্রিজটা পার হওয়ার পরই ফের উঠতে হয় চড়াই। যতটা নামা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি। বারবার, চার বার এ রকম ভাবে ব্রিজ পেরোনো সহজ নয়! মাঝে মাঝেই বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছিলাম আমরা।

গোটা রাস্তা জুড়ে ওক, স্প্রুস, ম্যাগনোলিয়া, রডোডেনড্রন গাছের ঘন জঙ্গল। নীচ দিয়ে বয়ে যায় নদী। পথের শেষের দিকে পায়ের কাছে চলে আসে প্রেক চু (স্থানীয় ভাষায় ‘চু’ শব্দের অর্থ নদী)। বাখিমের ট্রেকার্স হাটে যখন ঢুকলাম, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পথে। চটজলদি নুডলস চাপানো হল স্টোভে। ঠান্ডা বাড়ছে। অন্ধকার নামার তোড়জোড় করছে। গরম গরম নুডলসের স্যুপে শরীর গরম করে, বিছিয়ে ফেলা হল ম্যাট্রেস, স্লিপিং ব্যাগ। কাঠের ঘরের মেঝেতে এ ভাবেই কাটল রাত।

পরের দিনের গন্তব্য জোংরি। ১২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছনো যাবে ৪০৩০ মিটার উচ্চতার জোংরিতে। সকাল ন’টার মধ্যে শুরু করা গেল যাত্রা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরবর্তী জনপদ, সোখা। এ পর্যন্ত রাস্তা, পাহাড়ি মাটির উপর কাঠের গুঁড়ি ফেলে ফেলে বানানো। সোখার পর থেকেই শুরু ঘন জঙ্গল। পাইন, স্প্রুস, রডোডেনড্রনের ঘন ছায়ার ফাঁক দিয়ে সূর্যালোক প্রবেশ করাই দায়। পায়ের নীচে পিষে যায় ভেজা মাটিতে গজিয়ে ওঠা মস, ফার্নের দল। কখনও চোখে পড়ে, একঝাঁক উজ্জ্বল অর্কিড চেয়ে আছে আমারই দিকে। যেন বলছে, এই আনন্দটুকুর জন্যই তো এত কষ্ট করে হাঁটা!

জোংরি পৌঁছনোর কিছু আগেই পেরোতে হল খাড়াই ছোট পাহাড়, দেওরালি টপ। হাঁসফাঁস করতে করতে কোনও রকমে চড়ার অপেক্ষা। তার পরই চোখের সামনে খুলে যায় অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ! এতক্ষণ ধরে বদ্ধ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে আসা চোখ যেন লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে, বাহ! জোংরি পৌঁছনোর পর তাঁবু ফেললাম আমরা। সঙ্গে আছে স্লিপিং ব্যাগ। সন্ধের মধ্যে খিচুড়ি খেয়ে যখন তাঁবুবন্দি হওয়া গেল, ঠান্ডায় কেঁপে যাচ্ছে হাড় পর্যন্ত। পরের দিন ভোরে উঠে জোংরি টপে সূর্যোদয় দেখতে যাওয়ার সংকল্প করে নিদ্রাদেবীর আরাধনা শুরু।

পরের দিন ভোরে, বিস্তর ঠেলাঠেলি ও চেষ্টার পর জ্যাকেট-জুতো চড়িয়ে, হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে বেরোনো গেল তাঁবু থেকে। কিছুটা হেঁটে, আড়াইশো মিটার মতো চড়াই ভেঙে জোংরি টপে উঠতেই জন্নত! চোখের সামনে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক ছ’হাজারি তুষারশৃঙ্গ। কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাবরু, রাতোং, পাণ্ডিম, কোকতাংয়ের কোলে প্রথম সূর্যরশ্মির স্পর্শ এসে পড়ল। লাল-গোলাপি-কমলার অপূর্ব হোলিখেলার মধ্য দিয়ে জেগে উঠলেন সূর্যদেব।

ফেরার পথে ক্লান্তির চেয়েও বেশি ছেয়ে থাকে মনখারাপ। পাহাড় ছেড়ে, সমতলের যান্ত্রিক জীবনে ফিরে যাওয়ার মনখারাপ।

ট্রেকিং পথের কিছু মুহূর্ত ফ্রেমবন্দি করেছেন তন্ময় বিশ্বাস

কীভাবে যাবেন

কখন যাবেন

সেরা সময় মার্চ, এপ্রিল এবং অক্টোবর, নভেম্বর। বাকি সময়ে বৃষ্টি ও তুষারপাতে পণ্ড হতে পারে ট্রেক।

কী ভাবে যাবেন

শিয়ালদহ থেকে উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনে এনজেপি। সেখান থেকে গাড়িতে ইয়াকসাম। তার পর ট্রেকিং শুরু।

কোথায় থাকবেন

ইয়াকসাম, বাখিম, জোংরি, সব জায়গাতেই সিকিম ট্যুরিজমের ট্রেকার্স হাট পাবেন। তবে ট্রেকিংয়ের পুরো মজা উপভোগ করতে গেলে সঙ্গে তাঁবু নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

সাবধানতা

গোটা রাস্তায় উৎপাত করতে পারে জোঁক। তাই ট্রেকিংয়ের পথে নুন সঙ্গে রাখা জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE