E-Paper

বন্ধুত্বের আস্থায় মর্যাদা পায় বিরল সংগ্রহ

এমনকি কোনও আকারগত বা পরিমাপগত দিক থেকেও যে কোনও ছবি বিবেচ্য নয়, এই ধারণাকে আঘাত করে দেবভাষা আর্ট গ্যালারি যামিনী রায়ের ৮১টি অপ্রদর্শিত ছবির প্রদর্শনী করল সম্প্রতি।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:২৬
কালি-কলম: যামিনী রায়ের ছবি নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

কালি-কলম: যামিনী রায়ের ছবি নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।

মৃত্যুর দু’মাস আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায়কে চিঠিতে লিখছেন, “ছবি কী? এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, সে একটি নিশ্চিত প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের সাক্ষী। তার ঘোষণা যতই স্পষ্ট হয়, যতই সে হয় একান্ত, ততই সে হয় ভাল। তার ভালমন্দের আর কোনও যাচাই হতে পারে না।” অর্থাৎ ছবির একমাত্র শর্ত, ছবি হয়ে ওঠা। ছবি যা বলার বলবে, তাতে আলাদা কোনও ব্যাখ্যা চলে না।

‌এমনকি কোনও আকারগত বা পরিমাপগত দিক থেকেও যে কোনও ছবি বিবেচ্য নয়, এই ধারণাকে আঘাত করে দেবভাষা আর্ট গ্যালারি যামিনী রায়ের ৮১টি অপ্রদর্শিত ছবির প্রদর্শনী করল সম্প্রতি। সে প্রদর্শনী দেখে বোঝা যায়, বস্তুতই একজন মাস্টার আর্টিস্ট ছিলেন যামিনী রায়, যিনি নিজের কাজে প্রমাণ করে গিয়েছেন হাত না থেমে থাকার রেওয়াজ। আলাদা করে ক্যানভাস নিয়ে আয়োজন করার ধারণাকেও বদলে দিয়েছিলেন তিনি। হাতের কাছে যা পেয়েছেন—কাগজ, বোর্ড, ভাঁজ করা খাম, ছেঁড়া রসিদ, সবেতেই যেটুকু জায়গা পেয়েছেন, সেখানেই এঁকেছেন।

কবি বিষ্ণু দে-কে বিভিন্ন সময়ে নানা মাপের খসড়া ও ছবি উপহার দিতেন যামিনী রায়। এই প্রদর্শনীতে যে ছবিগুলি দেখা গেল, তার সবই রাখা ছিল বিষ্ণু দে-র সংগ্রহে। ফ্রেম সংযোজন ছাড়া যামিনী রায়ের কাছ থেকে পাওয়া যাবতীয় ছবি, কবির পরিবার যে ভাবে রেখেছেন, ঠিক সে ভাবেই তুলে ধরা হয়েছিল প্রদর্শনীতে। এই সব ছবি দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আয়োজকদের পাশাপাশি ধন্যবাদ প্রাপ্য বিষ্ণু দে-র পুত্রবধূ মীরা দে-র।

কালো ও নীল কালির খসড়া ছাড়াও ছিল বিষ্ণু দে-র বইয়ের আকর্ষক প্রচ্ছদ। লোকশিল্পের সরল রেখা, রং ও তার ভঙ্গি নির্মাণে অনুভব করা যায় শিল্পীর দেশের মাটির প্রতি অবাধ টান। বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড় গ্রামে পটচিত্রীদের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন শিল্পী। সেই শিল্পের বিশুদ্ধ রূপ ও রসের নব আবিষ্কারে যামিনী রায় একজন আত্মপ্রত্যয়ী শিল্পী তো বটেই, সেই সঙ্গে আধুনিকতার প্রতীকও বটে। অগ্রজ বন্ধুর প্রসঙ্গে কবি এক জায়গায় বলছেন, “প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষকে ছবি দিয়ে তার দেওয়াল সাজানো এবং আলোকিত করতে সহায়তা করতে চেয়েছিলেন তিনি। নিজের কাজকে যতটা সম্ভব সুলভ করে তুলেছিলেন।”

—নিজস্ব চিত্র।

যামিনী রায়ের অনুপ্রেরণায় ছবি নিয়ে অজস্র লেখা লিখেছেন বিষ্ণু দে। যেমন ‘আর্ট অব যামিনী রায়’, ‘দ্য পেন্টিংস অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর’, ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড মডার্ন আর্ট’ ইত্যাদি। হাতেকলমে বোঝার জন্য ৭০টির মতো ছবি এঁকেছিলেন কবি বিষ্ণু দে। উভয় সংযোগের ভাবনাচিন্তায় যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তার বহু প্রমাণ মেলে চিঠি-বিনিময়, আড্ডা এবং সৃষ্টিশীলতায়। ১৯৩৯ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত দু’জনের পত্র বিনিময়ে প্রায় সাড়ে তিনশো চিঠি আছে, যা তাঁদের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির সখ্যকে পরিস্ফুট করে। সাহিত্য ও শিল্প যে একে অপরের পরিপূরক, তার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন এই অসমবয়সি দুই দিকপাল। বস্তুত সেই সময়ে একটি মাধ্যমের সঙ্গে আর একটি মাধ্যমের যে গভীর যোগাযোগ ছিল, এখন তা ম্রিয়মাণ।

‌যামিনী রায়ের সৃষ্টিকলা আমাদের দেশের জাতীয় সম্পদ হিসেবে বরাবরই বিবেচিত। সময় যত এগোয়, যামিনী রায় ততই নিবিড় হন। এই শিল্পী মানেই একটি সমভঙ্গ ফর্ম। আয়ত চোখের বিশেষ ভূমিকা এবং বাংলার পটচিত্রের জাদুকর ছিলেন তিনি। কিন্তু তার আগে যে কঠোর অনুশীলন, যা ৫০ বছরের চর্চায় গড়ে উঠতে পারে, তার পূর্বাভাস পাওয়া যায় এই নিদর্শনে। ‌যেমন মাত্র ২.৩"/১.৬"-এর নীল কালির রেখায় স্পেস জুড়ে ছন্দোময় এক নারী। আনুভূমিক ভাবে চরকায় কর্মরত এক রমণী। দেবদেবী, সাঁওতাল, পালকি, কুকুর, পাখি, নারী, স্থানচিত্রের লে-আউট। বালিগঞ্জ প্লেসের ঠিকানায় আসা একটি খামের উপরে চিরাচরিত মা-শিশুর মনুমেন্টাল গঠন (৪.৫"/৫.৩")। আর একটি ডাকে আসা খামের উপরে মুখোমুখি দুই মা (৪"/৪.৩")। অন্য একটি সযত্ন ছেঁড়া কাগজের উপরাংশে চিঠির লেখনী (৫./৩.৪"), নীচে শিল্পীর লেখা দু’লাইন, “দশ দিনের অভ্যাসেই মানুষ দাস, ২০০ বৎসরের অভ্যাসে পোকা।” তবে পারিপার্শ্বিক ও দৈনন্দিন জীবন থেকে উঠে আসা প্রতিটি স্কেচ ও ড্রয়িংয়ে কোথাও নগরজীবন ধরা পড়েনি।

প্রত্যেকটি ছবিতে শিল্পীর সই যেমন রয়েছে, কিছু খসড়ার নীচে নিজের নামের সঙ্গে লিখে দিয়েছেন বিষ্ণু দে-র নাম। কতটা ভালবাসা থাকলে এ কাজ করা যায়! কবি ও কবিপত্নী প্রণতি দে-র যত্নসহকারে রাখা এই ছবিগুলির সামনে দাঁড়ালে মনে হয়— যামিনী রায়ের যে পেন্টিং দেখে আমরা অভ্যস্ত, সেই জায়গা থেকে এ রকম অরিজিনাল কাজের একটি প্রদর্শনী বিরল। ছোট ছোট ছবি পাওয়া এবং গ্রাহকের যে ভালবাসা দিয়ে কী ভাবে সেই ছবি রাখতে হয়, ওইটুকু কাগজের ছবিকে বোর্ডে পেস্ট করে রাখার মধ্যে কী পরিমাণ যত্ন, এই প্রদর্শনী দেখে সেই অনুভবে স্নাত হওয়ার সুযোগ ঘটে শিল্পপ্রেমীদের।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Jamini Roy exhibition Art Art exhibition Art Gallery

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy