Advertisement
E-Paper

না-প্রেম সময়ের কাতর কান্না

মেঘনাদ ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় সায়ক নাট্যদলের নতুন নাটক ‘পাসিং শো’। দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।শোয়ার্মা-পিৎজা নয়, পান্তা ভাত- আলু পোস্ত খাওয়া বাঙালিকে তাঁর চেয়ে বেশি চেনেন, বাংলা থিয়েটারে এমন মানুষ এখন হাতে গোনা।ঈশ্বরকণা কী তেল-যুদ্ধ তাঁর নাটকের বিষয় হয় না।

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৩০
নাটকে মেঘনাদ ও সমীরণ

নাটকে মেঘনাদ ও সমীরণ

শোয়ার্মা-পিৎজা নয়, পান্তা ভাত- আলু পোস্ত খাওয়া বাঙালিকে তাঁর চেয়ে বেশি চেনেন, বাংলা থিয়েটারে এমন মানুষ এখন হাতে গোনা।

ঈশ্বরকণা কী তেল-যুদ্ধ তাঁর নাটকের বিষয় হয় না।

তাঁর সংলাপে কথায় কথায় পোস্ট মডার্ন তক্ক-তত্ত্বও উঠে আসে না।

তাঁর থিয়েটার যেন পিদিমজ্বলা তুলসী মঞ্চটা ফিরিয়ে দেয়, চিলের ছাদে ভোকাট্টা আওয়াজটা শুনিয়ে নেয়, শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় থমকে থাকা পুকুরঘাট, খাঁ খাঁ দুপুরের নির্জন শহুরে অলিগলি, বর্ষাধোওয়া বিকেল-সন্ধেয় ফেরিওয়ালার ডাক, হঠাৎ লোপাট হওয়া আলসে জীবন, তার সাদা, এমনকী কাদাতেও পা রাখে।

তাতে যে সব সময় যুক্তি থাকে এমন নয়, কিন্তু থাকে টলমল আবেগ। শান্ত নদীটির পটে আঁকা ছবিটির মতো।

যার অন্দরে রাজ করে যে ভঙ্গি, তাতে যেমন কোনও ভান নেই, তেমন চটক দিয়ে চকমকি আলো তৈরির ভণিতাও নেই। আর কথায় কথায় ‘স্মার্ট’ হতে চাওয়ার লম্ফঝম্প তো নেই-ই।

নির্দেশক মেঘনাদ ভট্টাচার্য এমনই।

তাঁর ‘সায়ক’ নাট্যদল তেমনই।

তাকে আপনি গ্রহণ করতে পারেন অথবা বর্জন। অবজ্ঞা করা সম্ভব নয়।

তবু এক মেঘনাদের মধ্যে বোধহয় দু’জন মেঘনাদ বয়ে চলে।

যার একটি ধারা সোজাসাপটা কাহিনি নিয়ে ‘দায়বদ্ধ’, ‘বাসভূমি’-র মতো নাটক করায়।

অন্য ধারাটি ‘যদিও স্বপ্ন’, ‘কর্ণাবতী’, ‘দামিনী হে’-র মতো এক রঙা ছবি হতে হতেও হঠাৎ করে বর্ণিল ‘ক্যালাইডোস্কোপ’ হয়ে যাওয়ার মতো থিয়েটার করতে বলে।

তাঁর নতুন নাটক ‘পাসিং শো’। ‘সায়ক’-এর পঁচিশ নম্বর থিয়েটার। মেঘনাদের বাইশতম নির্দেশনা।

এ নাটকে তাঁর মধ্যে অন্তর্লীন দুটি ধারা যেন চলতে চলতে একটি অন্যটির হাত ধরে এগিয়েছে।

সাহিত্যিক অমর মিত্রর পাঁচটি গল্পর কাহিনি ভেঙে জুড়ে নাটকটি লিখেছেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়।

যার কাহিনি অনেকটাই ইচ্ছাপূরণের। স্বপ্নলালনেরও। তার সঙ্গে ঐতিহ্যের কাছে নতজানু হতে চাওয়ার গল্প। আবার প্রকৃতির ছন্দে নিজেকে মিলিয়ে দিয়ে প্রতি মুহূর্তের গ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়ার, স্বস্তি খোঁজার আখ্যান।

মধ্যবয়েসি অতীন (মেঘনাদ ভট্টাচার্য) খুঁজছে তার বাবা, ধূর্জটিপ্রসাদ দত্তর লেখা একমাত্র গানের রেকর্ডটি। যেটি গেয়েছিলেন বাবারই এক সহকর্মী অতুলানন্দ দে।

তার প্রাণান্তকর খোঁজার পথে সে পেয়ে যায় এক আশ্চর্য জাদু-মানবকে— গোলাম রেকর্ডিয়া (সমীরণ ভট্টাচার্য)। যাঁর কাছে নাকি সিরাজের তলোয়ার, তাঁতিয়া টোপির টুপি, পুরনো রেকর্ড সবই পাওয়া যায়।

গোলাম বলেন, এ দুনিয়ায় হারায় না কিছুই। সব ধরা থাকে। সেলিম দুরানির ছক্কা, পুরনো গান, দিন বদলের স্বপ্ন... সব। মনের গভীরে টোকা দিলে তারা জেগে ওঠে।

শুধু খোঁজাটা সাচ্চা হওয়া চাই।

গোলামের এক-একটা মুশকিল-আসানিয়া ফুঁয়ে অতীন কখনও ফিরে পায় তার স্কুলবেলার বন্ধু, কখনও তার সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে বহু কাল ধরে স্তব্ধ হয়ে থাকা গ্রামাফোন, কখনও আধো আলোয় সে দেখে ফেলে এক কালের দামি সিগারেট পাসিং শো-এর গায়ে ছাপ্পা হয়ে থাকা সাহেব জন ম্যাকার্থি আর তাঁর প্রেমিকা রেশমী বাঈকে।

এই ঘোরলাগা স্বপ্নালু জার্নিতেই অতীন এগোতে থাকে অমূল্য সেই রেকর্ডটিকে হাতে পেতে।

গোলামের কথায়, যা কিনা হতে হয় ‘ইস্টেপ বাই ইস্টেপ’।

এই কাহিনির গায়ে ভেসে থাকে মধ্যবিত্ত জীবনের এলোমেলো নকশা। সম্পত্তি নিয়ে টানাপড়েন, প্রমোটারিরাজ, পাড়ার দাদাগিরি, উঠতি বড়লোকের দেখনদারি জীবন, তার আত্মসুখের দপদপানি, ছন্নছাড়া সময়ে তুড়ি মেরে কেরিয়ার গড়ার ফোঁপরা বাগাড়ম্বরপনা। আবার পাগলের প্রলাপের মধ্যেও জেগে ওঠে পচে যাওয়া, নষ্ট সময়ের প্রতি ঘৃণা, ফেলে আসা দিনকালের জন্য হাহাকার।

সেট (সৌমিক-পিয়ালী) বলতে দু’পাশ থেকে কোনাকুনি দুটো পাটাতন গিয়ে মিশেছে পিছন দিকের আড়াআড়ি থাকা আরেকটি পাটাতনে।

যার ডান ধারে কখনও দেখা দেয় বাড়ির বসার ঘর। তার আসবাব। কখনও বা চালাওলা বাজার।

বাঁ ধারে কখনও সওদা হয় পুরনো গানের সিডি। কখনও’বা দেখা দেয় পাড়ার দাদার ‘ঠেক’।

পিছনের দিকে কালো পর্দার গায়ে দু’পাশে দুটো সিঁড়িওয়ালা ‘এক্সিট’।

পাটাতন, দেওয়াল, ঝোলানো পর্দায় চওড়া চওড়া রেখার কাটাকুটি। যাকে কখনও মনে হয় পাঁচিলের ফাটল, কখনও আবার মাকড়সার জাল। ঢাকা পড়া সময়ের অনুষঙ্গে তো এ দুটো চিত্রকল্প যেতেই পারে, তাই না?

শুরু থেকে শেষ এ নাটকের আধার হয়ে থেকেছে পুরনো দিনের বাংলা গান।

বারেবারে ফিরে ফিরে এসেছে অতীনের বাবার গান— ‘নদীটি গিয়াছে চলিয়া/ পথ পড়ে আছে ধুলায়/ পথটি গিয়াছি ভুলিয়া/ মন পড়ে আছে কুলায়...’ (কথা: অমর মিত্র, গায়ক: অরিজিৎ চক্রবর্তী)। রাগ সোহিনীতে গানটি বেঁধেছেন নাটকের মিউজিশিয়ান জয় সরকার। সানাইয়ের পোঁ-এর মতো একটানা সং-ভায়োলিন চলেছে গানের পাশাপাশি। এক লহমায় তার টিউনটা দর্শককে নিয়ে হাজির করায় চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকে। এই সময়কালকে ধরতাই দিতে গানের কোলাজও রেখেছেন জয়।

আবার নাটক যখনই খিদিরপুরে মুসলিম এলাকায় ঢুকেছে গিটারে জয় এনেছেন রবাব-এর (সরোদের মতো দেখতে তার-যন্ত্র) মেজাজ, আরবীয় সুরের মতো। ধর্মতলার ব্যস্ত পাড়া, এলাকার বাজার কী বাঈজির ডেরায় জয় কখনও সঙ্গী করেছেন মুখের বোল, পিয়ানো বা বেস গিটারের রহস্যময়তা, কখনও’বা সারেঙ্গিতে ঠুংরির সুর, তবলার ঠেকা...।

সুরের সেই মুখটা ধরে গোটা নাটকে রয়েছে বেশ কয়েকটি কোরিওগ্রাফ। সুকল্যাণ ভট্টাচার্যের। তাতে টুকরো টুকরো হয়ে জুড়ে থেকেছে ভারতনাট্যম কী মণিপুরী নাচের মুদ্রা।

কাহিনির ধারে ধারে ‘গার্নিশিং’-এর খামতি নেই। তাতে রং লেগেছে আরওই। তার পাশাপাশি মেঘনাদের অতীন, কিংবা বিশ্বনাথ রায়ের পাড়ার দাদা রতনলাল, সুখরঞ্জন ভট্টাচার্যর পাগল হরিনাথকে দেখলে মনে হয় যেন বহু কালের চেনা চেনা মুখের সারি।

সমীরণ ভট্টাচার্যের গুলাম রেকর্ডিয়ার স্বরক্ষেপণ, শরীরী চলন, হাতের মুদ্রা অতি জরুরি এক স্বপ্নাবেশ তৈরি করে।

শুধু দু-একজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংলাপ বলার ঢং একটু উচ্চকিত, পুরনো থিয়েটারি স্টাইলে সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি। তাতে সহ অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার চেয়ে দর্শককে সংলাপ শোনানোর প্রবণতা যেন একটু হলেও বেশি। নাটকের মূল সুর থেকে এই বেতালা অংশটুকু বাদ দিলে কিন্তু গোটা থিয়েটারটাই এক মনকেমন করা নস্টালজিয়া। যেখানে আষ্টেপৃষ্টে মাখামাখি ষাট-সত্তর-আশির দশকের কৈশোর, কী যৌবনবেলা।

যার অগোচরে বেড়ে ওঠে না-প্রেম সময়ের কাতর কান্না। স্বপ্নভাঙা সময়ের নিরুচ্চারিত যন্ত্রণা।

একেবারে মেঘনাদীয় ঢঙে।

তাকে আপনি গ্রহণ করতে পারেন অথবা বর্জন। অবজ্ঞা করা সম্ভব নয়।

Meghnad Bhattacharya Sayak
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy