পঞ্চান্নতম বছরের ঐশ্বর্য নিয়ে শিল্পীদল ‘পেন্টার্স অর্কেস্ট্রা’ সম্প্রতি নিজেদের কাজের নজির রাখল অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের নর্থ গ্যালারিতে। সাধারণ ভাবে অর্কেস্ট্রা বলতে চোখে ভাসে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের স্বরূপ অন্বেষণের একটি গমগমে পরিসর। যে আয়োজন একটি পরিচিত কর্ডের মতো ঐক্যের নিশ্চয়তা দেয়। মনে করা যেতে পারে, সেটি মাথায় রেখে শিল্পের মেলোডিয়াস ব্যক্তিত্ব ধরার জন্যই এই শিল্পীদলটির নাম ‘পেন্টার্স অর্কেস্ট্রা’।
দলটি প্রারম্ভিক চালনার ক্ষেত্রে হাল ধরেছিলেন পার্থপ্রতিম দেব, অমিত রায়, জহরচাঁদ দেশানি, বিপুলকান্তি সাহা, চিন্ময় রায়, শান্তনু ভট্টাচার্যের মতো কলাভবনের বিশিষ্ট ছ’জন শিল্পী। পরবর্তীতে দলে যোগদান করেন জহর দাশগুপ্ত, শুচিব্রত দেব, তাপসশঙ্কর বসু এবং অন্যান্য শিল্পীরা। সরাসরি না থেকেও, গ্রুপের স্থায়ী লোগো ও নামকরণ করেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত।
বার্ষিক রীতি অনুযায়ী প্রদর্শনী করার রেওয়াজে বেশ কয়েক জনের কাজের মধ্যে উত্তরণ যেমন দেখা যায়, আবার প্রতিষ্ঠিত কাজের দিশায় নতুন পরিচয়পত্র দলের মর্যাদা বাড়ায়। এ ক্ষেত্রে এই প্রদর্শনীর বেশ কয়েক জনের কাজ সেই বার্তাই বহন করে। শুরুতেই আসা যাক পার্থপ্রতিম দেবের সৃষ্টির কাছে। শিরোনাম দেওয়ায় অব্যাহতি নিয়ে, ছবি দেখার উপলব্ধিকে বহুমুখী ফর্মের দিকে নির্দিষ্ট করার পথে চলেন এই শিল্পী। প্রচলিত বা তথাকথিত আধুনিক শিল্পকে এককথায় ছক্কা মেরে এক একটি কৌশল অনায়াসে তৈরি করেন। ছবিতে রঙের জাদু, তরঙ্গায়িত রেখা ও সর্বোপরি ফর্মের একচ্ছত্র অধিকার নিয়ে আসে ত্রিকোণ আনুভূমিক ভারসাম্যের উলম্ব কনসেপ্ট। চেনা জগতের যাবতীয় ধারণাকে ধূলিসাৎ করে শিল্পীর বিরামহীন গবেষণার আকর্ষণে জড়ো হতে থাকেন উৎসুক শিক্ষার্থীর দল।
দলের একমাত্র মহিলা সদস্য ও জোরালো বিমূর্ত সৃষ্টির আধিকারিক শিল্পী মানসী মিত্রর ‘ইন সার্চ অব থট’ কাজটি ইন্টারেস্টিং। ক্যানভাসের উপরে পেপার পেস্ট করে অ্যাক্রিলিক ব্যবহারের পর, চারকোলে রেখার বাঁধুনি এনেছেন। এটি নতুনত্ব কিছু নয়। কিন্তু কম্পোজ়িশনে প্রথমে কোনও ভাবনা না থাকলেও, স্পেস যে ভাবে অবজেক্টের রূপ নিয়েছে, সেখানে শিল্পী সচেতন হয়েই একটি সর্পিল ফরমুলা দিয়ে ব্যালান্স তৈরি করেছেন, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
১৯৮৫ সাল থেকে দলের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী বিরাজ কুমার পাল একজন অভিজ্ঞ চিত্রশিল্পী। তাঁর কাজকে সরাসরি প্রকৃতির দর্পণ বলা যেতে পারে। এবং সেখানে দৃশ্যমান যতটুকু, সবটিকে নিখুঁত ভাবে পূর্ণ রূপ দেন। ফলে ছবিগুলি সাধারণ দর্শকের ভাললাগা কুড়িয়ে নেয় সহজেই।
প্রবীণ শিল্পী জহর দাশগুপ্ত শিল্পজগতে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। চারিত্রিক গতিময়তার মতোই তাঁর ছবিতে বহু ফর্ম সহকারী সঙ্গীর মতো পরিমণ্ডল তৈরি করে। তবে অতীতে রং নির্বাচনে শিল্পী যে ভাবে গহিন রহস্য বা রূপকথার জগৎ এনেছিলেন, সেখান থেকে বর্তমান কাজে চড়া রঙের প্রয়োগ বেশ বেসামাল লাগে। ‘ইলিউশন’ নিয়ে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাজগুলি ছিল নজরে আসার মতো। রেখাপ্রধান আকার এবং ভাবনার মধ্যে আগুন রঙের ঝলকানি বলে দেয়, চেতন-অবচেতনের চূড়ান্ত দমবন্ধ বিস্তার।
স্বপন কুমার সাহার কাজ সম্পর্কে শিল্পপ্রেমীরা অবহিত হলেও, এ বারে বেশ কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা গেল তাঁর কাজে। স্বকীয় স্টাইল রেখে, নৈশ প্রকৃতির রাজকীয় সৌন্দর্যে সাজিয়েছেন রাজা-রানির দু’টি ভিন্ন ফর্ম। কিছুটা অতীতের ভাস্কর্যের কথা মনে পড়ে। অ্যাক্রিলিক শিটে চাইনিজ় ইঙ্কে ড্রয়িং করে, অয়েলের পাতলা লেয়ারে বেসিক তৈরি করে উজ্জ্বলতা বাড়ান। এর পরে অ্যাক্রিলিক রঙে টোন অনুযায়ী বিষয়টি অনায়াসে শেষ করেন শিল্পী। প্রুশিয়ান ব্লু, অরেঞ্জ, হোয়াইটের ওপেক সৃষ্টি করে সম্পূর্ণ জ্যামিতিক ছকে নানাবিধ প্যাটার্ন দেখিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের বর্ষীয়ান সদস্য শান্তনু ভট্টাচার্য।

ভাস্কর শিশির রঞ্জন টিকাদারের ফাইবার নির্মিত পুরাণ ও আধ্যাত্মিক মহিমার ‘ওম শান্তি’ (মহাদেব), ‘হা গোবিন্দ’র (নিমাই) মনুমেন্টাল আকৃতি প্রদর্শনীর সেরা আকর্ষণ বলা যেতে পারে। পাশাপাশি উল্লেখ করার মতো ছবি ছিল শিল্পী দিব্যেন্দু বসুর। মোলায়েম অথচ ঘন প্রেক্ষাপটে নীল রঙের চমৎকার নিয়ন্ত্রণ ফেলে আসা শতাব্দীর নিদর্শন রেখে যায়। তিনটি বড় মাপের স্পেসে শিল্পী শ্যামল মুখোপাধ্যায় তৈরি করেছেন গোল্ডেন, স্কারলেট, অরেঞ্জ মিশ্রিত জমকালো আয়োজন। বনেদি ঘরের সুখী পরিবেশ ধরতে গোলগাল দম্পতি যে ভাবে এসেছে তাঁর কাজে। আবার ডিজ়াইনিংয়ে সতেজতা ও সাপোর্ট হিসেবে শিল্পী নিয়ে এসেছেন অটো, ফুলদানি, নানাবিধ পাখির রূপ। সংঘর্ষজনিত ভাইব্র্যান্ট রঙের কড়া মেজাজ যোগ হয় সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষায়, সেই হিসেবে শিল্পী অবশ্যই সার্থক।
এ ছাড়া আগামীর কিছুটা সম্ভাবনা দেখা যায় বিজয় বসাকের কনসেপ্টধর্মী গঠনে। পুলক দাসের বর্ণনামূলক বনানীতে রঙের অতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে আর একটু সচেতনতা দরকার। তবে অর্ধশতকের উপরে টিকে থাকা এই দলটির পূর্ণ সজীবতা নিয়ে কোনও দ্বিরুক্তি চলে না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)