Advertisement
E-Paper

অর্ধ শতাব্দী পেরিয়েও জনপ্রিয়তার শীর্ষে ০০৭

জেমস বন্ড। অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে জনপ্রিয়তা এখনও তুঙ্গে। রহস্যটা কী? খুঁজলেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্যসাদা বাংলায় যাকে বলে তড়পানো, তার প্রায় এক টেমপ্লেট বা ছাঁদ খাড়া হয়ে গিয়েছে দুনিয়াময় জেমস বন্ড ছবির এক হেক্কারি ডায়ালগে। যখন গোয়েন্দা ০০৭ বলে, ‘‘মাই নেম ইজ বন্ড।’’ এক মুহূর্তে থেমে ফের, ‘‘জেমস বন্ড।’’

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
ডক্টর নো-তে উর্সুলার সঙ্গে শন কনারি

ডক্টর নো-তে উর্সুলার সঙ্গে শন কনারি

সাদা বাংলায় যাকে বলে তড়পানো, তার প্রায় এক টেমপ্লেট বা ছাঁদ খাড়া হয়ে গিয়েছে দুনিয়াময় জেমস বন্ড ছবির এক হেক্কারি ডায়ালগে। যখন গোয়েন্দা ০০৭ বলে, ‘‘মাই নেম ইজ বন্ড।’’ এক মুহূর্তে থেমে ফের, ‘‘জেমস বন্ড।’’

তখনকার হিন্দি ছবির ভিলেন প্রেম চোপড়াও ছবিতে ছবিতে বলা ধরেছিলেন বেধড়ক রোয়াবে, ‘‘মেরা নাম হ্যায় প্রেম। … প্রেম চোপড়া।’’

খুনের লাইসেন্সধারী ব্রিটিশ এজেন্ট ০০৭-এর বাঙালি জীবনে অবতরণ প্রথম বন্ড ফিচার ফিল্ম ‘ডক্টর নো’ দিয়েই সেই ১৯৬২-৬৩-তে। শন কনারি-র সেই বন্ড বাঙালিকে মাত করেছিল খুনখারাবি দিয়ে তো বটেই, তবে প্রধানত সেক্স দিয়ে।

স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছেলে আমি, অ্যাডাল্টস ওনলি ছবিতে ঘুসে পড়া খুব সহজ ছিল না, তবু পড়েছিলাম। এবং স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম সমুদ্রতটের সেই দৃশ্যে, যেখানে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কনারি, স্ক্রিন ভরিয়ে গান চলছে ‘আন্ডার দ্য ম্যাংগো ট্রি’, আর স্নান সেরে জল থেকে ভেসে উঠে ক্ষীণতম বিকিনিতে পাড়ে আসছেন ৩৬-২৪-৩৬-এর চোখ ও স্নায়ু ঝলসানো উর্সুলা অ্যান্ড্রেস। যে-দৃশ্যের দোহাইয়ে নায়িকার নামকরণই হয়ে গিয়েছিল, বানানের ঈষৎ হেরফেরে, Ursula Undress.

সেক্স এবং ভায়োলেন্সের মিশেলে জেমস বন্ড ছবি অচিরে থ্রিলার ছবির সেরা, আধুনিক ঘরানা হল। যারা এর পর ছবি দেখে দেখে বন্ডভক্ত হল তারা হয়তো খেয়ালই করেনি যে ওই সিনেমার পিছনের উপন্যাস ও গল্প দিয়ে লেখক ইয়েন ফ্লেমিং মাত্র এগারো বছরে থ্রিলার সাহিত্যেও যুগান্তর ঘটিয়ে দিয়েছেন।

ওঁর বন্ড রচনাবলির ভক্ত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট কেনেডি। এবং দুর্ধর্ষ গোয়েন্দালেখক রেমন্ড চান্ডলার লিখেই দিয়েছেন সানডে টাইমস-এ, ‘বন্ড হল তা-ই যা সব পুরুষ হতে চায়।’

বটেই তো! ইচ্ছেমতো সব বদমায়েসকে পেটাতে চায় সবাই। আর পছন্দসই সব সুন্দরীকে বাহুবন্ধনে, চুম্বনে, শয্যায় পেতে। সিনেমা মূলত বন্ড নিয়ে পুরুষের এই আকাঙ্ক্ষারই ছায়াছবি।

তা হলে প্রেসিডেন্ট কেনেডি বা রেমন্ড চান্ডলারের প্রিয় গোয়েন্দা এই রঙিন বাসনাবৃত্তের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে? এই ধন্ধ নিরসনের জন্যই কেনেডি-হত্যার পরে পরেই হাতে তুলে নিয়েছিলাম ফ্লেমিং-এর সদ্য প্রকাশিত বন্ড উপন্যাস ‘অন হার ম্যাজেস্টিজ সিক্রেট সার্ভিস’ এবং তাতে খুনের লাইসেন্সধারী ০০৭-এর প্রথম ছবিটা কী পেলাম? পড়ুন…

‘‘…অর্ডার করা আধ বোতল পানীয় এসে গিয়েছিল। ওয়েট্রেস ওর গ্লাস আধখানা ভর্তি করে চলে যেতে বন্ড গ্লাসটাকে টইটুম্বর করে ভরল। মেয়েটির দিকে তুলে ধরে বলল, ‘‘আমার নাম বন্ড, জেমস বন্ড। দয়া করে বেঁচে থাকো, অন্তত আজ রাতটুকু।’ তারপর এক লম্বা চুমুকে গ্লাস খালি করে আবার সেটা ভরল।

‘‘মেয়েটি বেশ গম্ভীর চোখে ওকে দেখে গেল, তার পর গ্লাসে চুমুক দিল। বলল, ‘আমার নাম ট্রেসি, টেরেসার অপভ্রংশ। তবে টেরেসা দেবী ছিলেন, আমি দেবী নই। … তা আমরা কি উঠতে পারি?

মেয়েটি একটা বড় বিছানায় থুতনি অবধি চাদর টেনে শুয়েছিল। … বন্ড ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ওর বিছানার ধারটায় এসে বসল, আর বেশ শক্ত করে হাত রাখল ছোট্ট পাহাড়টার ওপর, যা আসলে ওর বাম স্তন। ‘তা হলে শোনো, ট্রেসি’ বলে দু’একটা প্রশ্ন রাখল, যাতে এই আশ্চর্য মেয়েটা কেন জুয়ো খেলে খেলে ফতুর হচ্ছে তার একটা ধারণা করা যায়। কী পরিস্থিতি ওকে সুইসাইডের মুখে ফেলছে, তারও আঁচ পাওয়া যায়।’’

এই যৌন মিলনে গড়ে ওঠা সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়, ০০৭ এজেন্ট জেমস বন্ডের জীবনের একমাত্র বিয়ে। টেরেসা ট্রেসি দি ভিচেঞ্জো-র সঙ্গে। যে-ট্রেসি খুন হল বিয়ের রাতেই বন্ডের শত্রু ব্লোফেল্ড-এর হাতে।

বিয়ের রাত মানে ঠিক আনুষ্ঠানিক বিবাহ নয়, অস্ট্রিয়ার অপরূপ শহর সালজবুর্গের পথে হাইওয়েতে বন্ডের হঠাৎ প্রস্তাব করে বসা। বলল, ‘‘লক্ষ্মীটি, দুটো কাজ আছে, গাড়িটা একটু দাঁড় করাও।’’

গাড়ি দাঁড়াতে ও খুব নম্র একটা চুমু দিল ঠোঁটে, বলল— ‘‘এটাই প্রথম কাজ। অন্যটা হল আমি তোমার জীবনের ভার নিতে চাই, ট্রেসি। আপত্তি আছে?’’

ট্রেসি ওর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘‘শ্রী ও শ্রীমতী হওয়ার মানে তো তাই, না?’’

ক্যাসিনো রয়্যাল-এ ক্রেগ-গ্রিন জুটি

একটু পরেই ওদের লাঞ্চিয়া গাড়ির পিছনে একটা লাল মাসেরাতি দেখা গেল। ট্রেসি স্টিয়ারিং-এ থাকলে ওকে ওভারটেক করার সাধ্যি কারও নেই। তবু বন্ড বলল, ‘‘যেতে দাও ওকে। দুনিয়ার সমস্ত সময় আমাদের হাতে।’’

মাসেরাতিকে রাস্তা ছাড়া হল, কিন্তু পাশাপাশি আসতেই বেরিয়ে এল একটা অটোম্যাটিক বন্দুক এবং বন্ডের গাড়ির কাচ আর চালকের সিটে বসা ট্রেসিকে ঝাঁঝরা করে দিল।

নায়কের সম্বিৎ ফিরতে তাবৎ বন্ড সাহিত্যের সম্ভবত সেরা মুহূর্তটা এল। এক তরুণ টহলদার পুলিশের প্রশ্নে ট্রেসির নিথর দেহটা আঁকড়ে ধরে বন্ড বলল, ‘‘না, না, সব ঠিক আছে। ও একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। আমরা একটু পরে চলে যাব, কোনও তাড়াহুড়ো নেই।’’

বলতে বলতে ওর মাথাটা ট্রেসির মুখে নেমে এল, ও ওর সদ্য পাণিগ্রহীতার এলানো চুলের মধ্যে ফিসফিস করে বলল, ‘‘দেখছ তো, পৃথিবীর সমস্ত সময় এখন আমাদের হাতে।’’বলা বাহুল্য, প্রেম-ভালবাসা ও গোয়ন্দাগিরির এই রোম্যান্টিক বন্দিশে তৎক্ষণাৎ মজে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু সত্যি সত্যি ধাঁ হয়ে গিয়েছিলাম ফ্লেমিং-এর রীতিমতো অভিজাত গদ্য , কাহিনি মেলার তরিকা এবং হায় হায়, আশ্চর্য অবিশ্বাস্য গবেষণায়! বন্দুক হোক, পাণীয় হোক, চরবৃত্তি বা খুনখারাবির বীজমন্ত্রই হোক, কিংবা স্পোর্টস কার-এর রকমসকম বন্ড কাহিনি যেন নতুন, নতুন দরজা খুলে নতুন, নতুন জগতে নিয়ে ফেলছে।

ষাটের দশক শেষ হওয়ার আগেই ইংরেজি থ্রিলার পড়া বাঙালির মধ্যে জেমস বন্ড ছবির মতো বন্ড সাহিত্যও কিছুটা নেশার মতো হয়ে ছিল। শন কনারির মতো ইয়েন ফ্লেমিংও গল্পে, আড্ডায় আসছিলেন।

•••

একটু একটু করে বাজারে চরে গিয়েছিল খবরটা যে ফ্লেমিং তাঁর নায়কের নামটা নিয়েছিলেন মার্কিন অর্নিথোলজিস্ট বা পক্ষিবিজ্ঞানী জেমস বন্ডের নাম থেকে। কেন? ফ্লেমিং, যিনি নিজেও পোক্ত পক্ষিপর্যবেক্ষক ছিলেন, জেমস বন্ডের স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘‘কারণ আমার মনে হয়েছিল এই ছোট্ট, অ-রোম্যান্টিক, অ্যাংলো-স্যাক্সন এবং ভারী পুরুষালি নামটাই আমার চাই। ফলে এক দ্বিতীয় জেমস বন্ডের জন্ম হল।’’

আর কীরকম চেহারাচরিত্র ভেবেছিলেন নায়কের? ‘ডক্টর নো’ ছবি যখন বাজার মাতিয়েছে এবং রাতারাতি শন কনারি মেল আইকন, ইয়েন ফ্লেমিং দ্য নিউ ইয়র্কার পত্রিকাকে সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘‘যখন প্রথম বন্ড উপন্যাসটা লিখি ১৯৫৩-য় আমি চেয়েছিলাম ও খুব নিষ্প্রাণ, সাধারণ হোক যার জীবনে সারাক্ষণ অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার ঘটেই চলেছে, ও হোক একটা ভোঁতা অস্ত্রের মতো… তো এমন একটা নায়কের নাম তো জেমস বন্ডই হওয়া উচিত, যেমন একটা অনুত্তেজক নাম, হে ঈশ্বর, জীবনে শুনিনি।’’

ভাবলেন বটে, তবে পারলেন কি লেখক বন্ডকে সাধারণ, অনুত্তেজক, ভোঁতা করে রাখতে? প্রথম বই ‘ক্যাসিনো র‌য়্যাল’-এর শুরুর কয় পৃষ্ঠার মধ্যেই লেখক বন্ডের সমস্ত বৈশিষ্ট্য আর পাগলামি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। যার মধ্যে ওর চেহারা, ওর বেন্টলি গাড়ি, অবিরত ধূমপান ও মদ্যপানের বৃত্তান্ত এসে গেল। ওর মার্টিনি পানের কায়দা-কানুনও এল সপ্তম পরিচ্ছেদের মধ্যে। বিবরণটা এরকম…

‘‘একটা ড্রাই মার্টিনি’ ও চাইল। ‘একটাই। একটা লম্বা শ্যাম্পেন পাত্রে।’

‘হ্যাঁ, স্যার,’

‘দাঁড়াও। ওর সঙ্গে তিন দাগ গর্ডনের জিন মেশাও। তাতে এক পেগ ভদকা ফেলো, আর আধ পেগ ‘কিনা লিলে’। তার পর ভাল করে ঝাঁকাও, আর একটা বড়, সরু লেবুর চোকলা চুবিয়ে দাও। ঠিক আছে?’

‘অবশ্যই মঁসিয়ুর।’ বারম্যানের বেশ দারুণ লাগল আইডিয়াটা। লাইটার বলল, ‘বাপ রে, একটা পানীয়ই বটে!’’’

•••

কালে কালে সিনেমার দাক্ষিণ্যে, শন কনারি থেকে আজকের ড্যানিয়েল ক্রেগ অবধি বন্ডের মদ দাঁড়িয়েছে মার্টিনি, নাড়ানো নয়, জোরে ঝাঁকানো। উপন্যাসে ব্যবহৃত বেন্টলি গাড়িও সিনেমায় রূপান্তরিত হল অ্যাস্টন মার্টিনে। আর প্রথম কাহিনি ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ থেকে পঞ্চম উপন্যাস ‘ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ’ অবধি ব্যবহৃত নায়কের পছন্দের অস্ত্র .২৫ এসিপি বেরেত্তা অটোম্যাটিক পিস্তল যে পরে বদলে জার্মানির তৈরি ভাল্টার পিপিকে হয়ে গেল তাতে সিনেমার হাত নেই, বদলটা ঘটাল ফ্লেমিংকে লেখা বিখ্যাত আগ্নেয়াস্ত্র বিশেষজ্ঞ জেফ্রি বুথরয়েডের একটা চিঠি। বুথরয়েড লিখেছিলেন…

‘‘আমি এটাই ধরিয়ে দিতে চাই যে জেমস বন্ডের মতো কেউ কখনও বেরেত্তা ব্যবহার করবে না। ওটা কার্যত মহিলাদের অস্ত্র— এবং খুব বিশিষ্ট আদবকায়দার মহিলার অস্ত্রও নয়! আমি সাহস করে বন্ডের উপযুক্ত একটা অস্ত্রের প্রস্তাব রাখব? ওর উচিত .৩৮ কিংবা ৯ মিমি এক অস্ত্র সঙ্গে রাখা— ধরা যাক একটা জার্মান ভান্টার পিপিকে? সেটা ঢের মানানসই হবে।’’

চিঠি পেয়ে ফ্লেমিং পরের উপন্যাস ‘ডক্টর নো’-য় বন্ডের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ভাল্টার পিপিকে এবং এই চমৎকার পরামর্শের জন্য কাহিনির এক চরিত্রের নাম রেখেছিলেন মেজর বুথরয়েড। যার কাজ ছিল বন্ডের অস্ত্র সরবরাহ করা। কারণ তার পদ সিক্রেট সার্ভিসের শস্ত্রবিশেষজ্ঞের।

এই এত কিছু আয়োজন যে-মানুষটার জন্য সেই বন্ড কেমন দাঁড়িয়েছিল গল্পে এবং ছায়াছবিতে? প্রথম চেহারাটা দেখা যাক…

বন্ড সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’-এর এক চরিত্র ভেস্পার লিন্ডকে বলতে শোনা যায়, ‘‘বন্ডকে দেখলে আমার মনে পড়ে যায় হোগি কারমাইকেলকে, তবে বন্ডের মধ্যে একটা শীতল নিষ্ঠুরতাও দেখতে পাই।’’

এই হোগি কারমাইকেল হলেন এক জন নামকরা গায়ক-অভিনেতা, যাঁর সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছে ‘মুনরেকার’ উপন্যাসের মহিলা স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসার গালা ব্র্যান্ড। যে মনে করে বন্ড ‘অবশ্যই ভাল দেখতে… কিছুটা হোগি কারমাইকেলের মতো। কালো চুল ঝুলে পড়েছে ডান ভুরুর ওপর। হাড়ের গড়নও ওদের একই রকম। তবে মুখের মধ্যে বন্ডের একটা নৃশংসতা আছে, আর নীল চোখ জোড়ায় ঠান্ডা চাহনি।’’

বন্ডের গড়ন ছিপছিপে, ডান গালে তিন ইঞ্চি লম্বা কাটা দাগ, কালো চুল ছোট করে ছাঁটা, যার থেকে একটা সুতো কমা’র মতো ঝুলে থাকে কপালে, ওর উচ্চতা ছ’ফুট।

প্রথম ছবি ‘ডক্টর নো’ থেকে হালের ‘স্পেক্টর’ অবধি ২৬টা ছবি হল বন্ড নিয়ে। তাতে শন কনারি থেকে মাইকেল ক্রেগ অবধি সাত জন অভিনেতা অভিনয় করলেন ওই ভূমিকায়। ইয়েন ফ্লেমিং একজন ইলাস্ট্রেটর কমিশন করে ওঁর মনের মতো একটা বন্ড আঁকিয়েছিলেন, সেই চেহারার সব চেয়ে কাছাকাছি আসেন শন কনারি, যাঁকে আদর্শ, আর্কিটাইপাল জেমস বন্ড বলে মেনে নিয়েছে অধিকাংশ বন্ডভক্ত। যদিও হালফিল সেই কনারিকেও দেদার প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন বন্ডের আধুনিক অবতারে অবতীর্ণ ড্যানিয়েল। চোখমুখ, হাবভাবে নিষ্ঠুরতা কাকে বলে তা বুঝে নেওয়া যায় ‘স্কাইফল’ বা ‘স্পেক্টর’-এর ক্রেগের দিকে এক বার তাকালেই। তবে এ সবের পাশাপাশি বন্ড বলতে যে-এক অম্লান এলিগ্যান্স সেখানে কনারির কাছে সবাই বেপাত্তা।

•••

আজকাল বন্ড কাহিনির পেপারব্যাক সংস্করণের একটা ট্যাগলাইন দেখতে পাই টাইটেলের নীচে— দেয়ার ইজ্ ওনলি ওয়ান বন্ড। বন্ড একটাই।

সিনেমায় নেই-নেই করে সাতজন বন্ড ভূমিকায় এসেছেন বলেই কি উপন্যাস-গল্পের জেমস বন্ডকে স্বতন্ত্র করার চেষ্টা? জানি না। তবে এটাও তো ঘটনা যে বন্ড নিয়ে ১৪টা বই লিখে ইয়েন ফ্লেমিং-এর মৃত্যু হলে ওঁর সাহিত্যসম্পত্তির নিয়ন্ত্রকরা আরও অনেককেই বরাত দিয়েছেন বন্ড কাহিনি চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। এঁদের মধ্যে বিখ্যাত আধুনিক লেখক কিংসলি এমিসও আছেন। সে-সব বই বিক্রিও হয়েছে, কিন্তু মানুষ মনে রেখেছে শুধু ফ্লেমিং-এর কাজই। বন্ড যদি একটাই হয় তো তার নির্মাতাও শেষ বিচারে সেই একজনই। এটা আরও বেশি মনে হচ্ছে ইদানীং, কারণ ২৬টা বন্ড ফিল্মের মধ্যে শেষের বেশ ক’টা অন্য লেখকদের কাজ এবং সেই সব চিত্রনাট্যের বড় অংশ জুড়ে লাগাতার মারপিট এবং কার চেজ। ‘স্পেক্টর’ ছবির প্রথম বিশ মিনিট জুড়ে তো কেবলই ভিলেনের পিছনে বন্ডের ধাওয়া করা। তাও এক দেশ থেকে আরেক দেশ হয়ে অন্য দেশে। মেক্সিকো থেকে ইতালি, মরক্কো হয়ে অস্ট্রিয়ায় এবং আধুনিক সিনেমার টেকনিকে এমন ভাবে তোলা যে গোয়েন্দা গল্প এবং ভ্রমণ সাহিত্য মিলেমিশে একাকার। ফলে ০০৭ (ইংরেজিতে উচ্চারণ হয় ডাবল ও সেভেন) এখন একটা অভিনব ফ্র্যাঞ্চাইজ। ‘লাইসেন্সড টু কিল’ বন্ড এখন ‘লাইসেন্সড টু থ্রিল’। এখন যখন বন্ড ছবি দেখি খেয়াল রাখতে চাই নতুন কী যন্ত্রপাতি, টেকনিক, ধামাকার আমদানি হল। ফ্লেমিং কাহিনিগুলোর সঙ্গে সূত্র আবিষ্কারে অত নজর দিই না। যদিও ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংগঠন এমআই সিক্সে বন্ডের বস ‘এম’, সেখানে ওর পদের প্রতিযোগী ‘সি’, ওর নাছোড় শত্রু ব্লোফেল্ড বা শিফর্ বা ওবারহাউসারকে দিব্যি ফিরিয়ে আনা হচ্ছে খেলা জমানোর জন্য। ‘স্কাইফল’ তো শুরুই হল একটা চার শব্দের বার্তা দিয়ে— দ্য ডেড আর অ্যালাইভ। মৃতেরা এখনও জীবিত।

কনান ডয়েলের শার্লক হোমস কাহিনির মতো ০০৭-ও নতুন নতুন প্যাকেজিং-এ ফিরে আসছে, আসতে থাকবে। আমাদের হিন্দি সিনেমাতেও বন্ড খেলানো হচ্ছে কখনও ‘রাওডি রাঠোর’, কখনও ‘ফ্রম চাঁদনিচক টু চায়না’ আজগুবি যাত্রায়। শুধু ‘ডক্টর নো’-র একটা দৃশ্য থেকেই যে কত হিন্দি ছবির ডন তৈরি হল তার ইয়ত্তা নেই। যেখানে বন্ড ডক্টর নো-র গোপন কেন্দ্রে ঢুকে পড়ে দেখছে কেউ কোথাও নেই, শুধু নো-র গলা ভেসে আসছে সাউন্ড সিস্টেমে এবং অলক্ষ্যে থেকেই সে বন্ডের প্রতিটি মুভমেন্ট অনুসরণ করছে।

বিনোদনের তাগিদে (০০৭ এখন হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য) মূল রচনা ও চলচ্চিত্রায়নের মধ্যে কত খানি দূরত্ব ঘটে যায়, তার একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত ইয়েন ফ্লেমিং-এর প্রথম কাজ ক্যাসিনো রয়্যালের ভূমিকা পরিচ্ছেদ (যার শিরোনাম রেখেছেন লেখক ‘দ্য সিক্রেট এজেন্ট’) এবং কয়েক বছর আগে ড্যানিয়েল ক্রেগকে নিয়ে তোলা ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’-এর শুরুতে জেল পালানো সন্ত্রাসকারীর পিছনে বন্ডের দৌড়। ছবির ওপেনিং সিকোয়েন্স আসন্ন রোমাঞ্চ ও বিনোদনের উদ্দাম ইঙ্গিত, উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদ কাহিনির জটিল রহস্যের বিলম্বিত আলাপ। দেখুন…


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন....

‘‘কোনও ক্যাসিনোর ধোঁয়া, গন্ধ, ঘাম ভোর তিনটের সময় গা ঘিনঘিন করে তোলে। বড় দানের জুয়োতে আত্মার যে-ক্ষয়ক্ষতি— যা আসলে লোভ, ভয় ও টেনশন ঘটিত পচন— তা সহ্যের বাইরে চলে যায়, ইন্দ্রিয়রা বিদ্রোহ করে।

‘‘জেমস বন্ড হঠাৎ বুঝল ও খুব ক্লান্ত। ও সব সময় টের পায় শরীর আর মন যখন আর টানতে পারছে না। তাতে যে ভুলভাল ঘটে একঘেয়েমি আর অবসাদ থেকে তা এড়াতে পারে।

‘‘ও সবার অগোচরে রুলেত টেবিল থেকে সরে টপ টেবলের এক ধারে এসে দাঁড়াল।

‘‘ল্য শিফর্ তখনও খেলে যাচ্ছে এবং মনে হয়, জিতছেও। ওর সামনে লাখ লাখ ফ্রাঙ্কের প্লাস্টিক টোকেনের পাহাড় জমে আছে। ওর বাঁ হাতের ছায়ায় ঢাকা পড়েছে পাঁচ লক্ষ ফ্রাঙ্কের বড় বড় হলদে টোকেন।

‘‘বন্ড ওর চোখকাড়া প্রোফাইলটা মন দিয়ে নজর করল, তারপর মাথা হাল্কা করার জন্য গা ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে গেল।’’

‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ উপন্যাস ও সিনেমা দুই-ই অবশ্য শেষ হয় রহস্যের ইতি এবং নায়িকা ভেস্পার লিন্ড-এর মৃত্যুতে। ০০৭-এর গোয়েন্দাগিরির সাফল্য ও তার ভালবাসার বিপন্নতায়।

শেষমেশ বেপরোয়া জীবনের এক অপরূপ আলেখ্য হয়েই থেকে যাবে জেমস বন্ড কাহিনিমালা ও ছায়াছবিরা, জীবন ও রূপকথার প্রমোদ মিশেল।

james bond shankarlal bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy