ক্যালকাটা পেন্টারসের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
সেই ১৯৬৪ সালে ক্যালকাটা পেন্টারস দলটি তৈরি হয়েছিল, সে সময়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সচেতনতা মাথায় রেখে। এ ছাড়া পুরো বিশ্বের ঘটনাক্রমও দলের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল। বিড়লা অ্যাকাডেমি অব আর্ট অ্যান্ড কালচারে দলের ৫৯তম প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল সম্প্রতি। এ বারের প্রদর্শনীতে রয়েছেন যোগেন চৌধুরী, শিবপ্রসাদ কর চৌধুরী, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, নীরেন সেনগুপ্ত, সুশান্ত চক্রবর্তী, সুব্রত ঘোষ, গৌতম ভৌমিক, অনুপ মণ্ডল, রাকেশ সাধক, মানিক কুমার ঘোষ প্রমুখ।
যোগেন চৌধুরীর বেশ কিছু আকর্ষক চারকোল ড্রয়িং প্রদর্শনীতে দেখা গেল। অনেক সময়ে তিনি চারকোল ড্রয়িংয়ের সঙ্গে একটু প্যাস্টেল রংও ব্যবহার করেন। মিশ্রমাধ্যমে ছবিগুলো করেন। ড্রয়িংগুলো তিনি স্থির হাতে, দৃঢ়তার সঙ্গে এক টানে সম্পন্ন করেন। এই প্রদর্শনীতে এক শায়িত নগ্ন নারীর অবয়ব বেশ চোখ টানে। মাটি কামড়ে থাকা এই সব লাইন ড্রয়িং কিছুটা যেন ভাস্কর্যের উৎকর্ষ প্রাপ্ত হয়।
দিল্লি আর্ট কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ নীরেন সেনগুপ্তের রঙের ব্যবহার চমকপ্রদ। বহুবিধ জ্যামিতিক আকারে নানা বর্ণে নিজের বক্তব্য রেখেছেন ‘শরণাগত’ নামের কাজগুলিতে। এর মধ্যে দু’টি কাজের দিকে তাকিয়ে থাকলে, দর্শকের কাছে নানা আকারের, নানা রূপকে মোড়া অনেক গল্প মূর্ত হয়ে ওঠে। এই ছবি শুধুমাত্র রঙিন নকশা বা ছক নয়। এই শিল্পীর ছবি মানুষকে ভাবায়। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে এঁকেছেন শিল্পী।
এর পর বলা যাক অন্য এক বর্ষীয়ান শিল্পী শিবপ্রসাদ কর চৌধুরীর ছবির কথা। কাগজের উপর অ্যাক্রিলিক রঙে করা একটি ছবির নাম ‘আনটাইটেলড’। লাইন এবং অনবদ্য রঙের ব্যবহারে ছবিটি সম্পূর্ণ এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। এটি পুরোপুরি ভাবেই বিমূর্ত ছবি, কিন্তু তবুও একটি জানালার মতো ফর্মের দিকে চোখ যায়। যেন অনেক কিছু আছে ওই জানালাটির বাইরে। শুধু ক’টা লাইনে ওই ডিজ়াইনের সাহায্যেই তিনি মানুষের মনের অদ্ভুত অনুভূতিটি জাগাতে সক্ষম হয়েছেন।
এখানে সুশান্ত চক্রবর্তীর কিছু ছবি দর্শক দেখতে পাবেন। তার মধ্যে দু’টি ছবি কিছু দিন আগেই অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে তাঁর একক প্রদর্শনীতে দেখেছেন দর্শক। চেয়ারের সেই ছবিগুলি প্রিন্ট মেকিংয়ে শিল্পীর পারদর্শিতার স্বাক্ষর বহন করে। এখানে বোর্ডের উপরে অ্যাক্রিলিক এবং অয়েল প্যাস্টেল মাধ্যমে করা একটি বাঘের পার্শ্বমুখ দেখা গেল। অয়েল প্যাস্টেলে করা ওঁর অসামান্য একটি ছোট কাজ। আপাতদৃষ্টিতে যা বলতে চেয়েছেন সেটাই কিন্তু ছবিটির বক্তব্য নয়, আরও গভীরে গিয়ে সুশান্ত চক্রবর্তীর ছবি ভাবায়।
শিল্পী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ক্যালকাটা পেন্টারস দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বহু বছর। এখানে তাঁর যে ক’টি ছবি দেখা গেল, সে সবই ড্রাই প্যাস্টেলের কাজ, কাগজের উপরে। ছবিগুলোর নাম ‘ফ্লো’, অর্থাৎ ধারা। এখানে অনেক রকম স্রোত বা প্রবাহের ধরন দেখিয়েছেন শিল্পী। সেটা সামুদ্রিক ঢেউয়ের হতে পারে, মেঘের হতে পারে, বৃষ্টির ধারার হতে পারে, এমনকী নদীর জোয়ারও হতে পারে। আবার মানুষের মনের আনন্দ-উচ্ছলতাও হতে পারে। সুন্দর এক রূপক সৃষ্টি করেছেন। আমাদের সমস্ত জীবনটাই যে প্রবহমান, সেটাই সম্ভবত শিল্পী দেখাতে চেয়েছেন তাঁর এই ফ্লো সিরিজ়ে।
এই দলের সম্পাদক শিল্পী সুব্রত ঘোষের ‘লা গ্র্যান্ড ভয়েজ’ ছবিটিতে দর্শক জীবনের প্রতিফলন দেখতে পান। সম্পূর্ণ ভাবে বিমূর্তকরণ করেছেন। কাগজের উপরে মিশ্র মাধ্যমে করা ছবি। হয়তো জীবনের শেষ যাত্রার কথাই বলতে চেয়েছেন। হয়তো শিল্পী বলতে চেয়েছেন, এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডে মানুষ জীবনাবসানের পরে একটা শুকনো পাতার মতো। এ সব ছবির বহিরাঙ্গের পারদর্শিতা, বিমূর্তকরণ, স্বল্প রঙের ব্যবহার, লাইনের ব্যবহার ইত্যাদি ছাপিয়ে জেগে ওঠে শিল্পীসুলভ পরীক্ষাসিদ্ধতা। উপরোক্ত ছবিটিতে সেই সফলতারই পরিচয় পাবেন দর্শক। খুবই অন্য রকম, সুন্দর ছবি।
ক্যালকাটা পেন্টার্সের বহু দিনের সদস্য গৌতম ভৌমিকের নিজস্ব ধরনে মোটা করে ক্যানভাসের উপরে তেলরঙে ফিগারেটিভ এবং নন ফিগারেটিভ কাজ দেখা গেল। মোনোক্রোমে এই ধরনের ইম্প্রেশনিস্টিক কাজ খুব একটা দেখা যায় না। এ ছাড়া চারকোলে করা প্রতিকৃতি এবং মানুষের অবয়বগুলি চোখ টানে। এর মধ্যে একটি ছবিতে দেখা গেল, মণিপুর যখন জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে, তখন এক নারীমূর্তি নিজের লজ্জা নিবারণ করছেন। এই চারকোল ড্রয়িংগুলি খুবই মনোগ্রাহী।
এ বারের প্রদর্শনীতে ছাপাই ছবির কাজ দর্শক বিশেষ দেখতে পেলেন না। ‘স্যাড বাট ট্রু’ ছবিগুলিতেই একমাত্র উডকাট এবং এচিংয়ের কাজ দেখা গেল। তরুণ শিল্পী মানিককুমার ঘোষ এচিংয়ের সঙ্গে ডিজিয়োগ্রাফি ব্যবহার করে অদ্ভুত একটা এফেক্ট নিয়ে এসেছেন। তাঁর কাজ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে অতটা কালো প্রেক্ষাপটে এ রকম একটা সুন্দর ছাপাই ছবি যতটা উপভোগ্য হতে পারত, তা হতে পারল না, গ্যালারির আলোছায়ায় অনেকটাই হারিয়ে গেল। আশা করা যায়, এই তরুণ শিল্পী পরবর্তীকালে নন-রিফ্লেকটিভ (যে কাচে প্রতিফলন হয় না) কাচ ব্যবহার করবেন।
তরুণ ভাস্কর রাকেশ সাধক সরকারি আর্ট কলেজ থেকে পাশ করেছেন। আর এক ভাস্কর অনুপ মণ্ডল রবীন্দ্রভারতীর স্নাতক। রাকেশ সাধকের ‘নস্টালজিয়া’ কাজটি একটু অন্য রকম। পুরনো স্থাপত্যের জন্যে মন খারাপ করা, ধাতু এবং কাঠের একটি স্তম্ভ। অনুপ মন্ডলের ‘আনটাইটেলড’ কাজটি ভারী অন্য রকম। সম্পূর্ণ ধাতুর তৈরি অ্যালুমিনিয়াম এবং পিতলের কাজ। এটিকে খানিকটা মানুষের বদ্ধ একটি বাসস্থান বলে ভাবা যায়, যেখানে জানালা নেই, শুধু একটি গুপ্ত দরজা। আবার মানুষের অবয়ব বলে কল্পনা করলে, তা যেন সমস্ত দিক দিয়ে বন্দি বলেও ভাবা যেতে পারে, কারণ এ কাজ শিরোনামহীন।
এই দলের প্রবীণ এবং নতুন সব শিল্পীরাই নিজস্ব চিন্তাধারা এবং কাজে অদ্বিতীয়। ক্যালকাটা পেন্টার্সের ষাট বছর সম্পূর্ণ হলে, এই সব শিল্পী তাঁদের কাজের অভিনবত্বে দর্শককে সমৃদ্ধ করবেন বলে আশা করা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy