E-Paper

মনখারাপের স্মৃতিগুলি

বর্ণ অনন্যর আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, দলের রিদম গিটারিস্ট, মূল সুরকার এবং আর এক কণ্ঠশিল্পী রাজর্ষি ঘোষের সুরারোপণ।

মঞ্চে শিল্পীরা।

মঞ্চে শিল্পীরা। —ফাইল চিত্র।

গৌরব দত্ত

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২৫ ০৮:২৪
Share
Save

একমাত্র নৈঃশব্দ্য ছাড়া অব্যক্তকে কেবল সঙ্গীতই ব্যক্ত করতে পারে— অ্যাল্ডাস হাক্সলের এই মহার্ঘ উপলব্ধি প্রায় সর্বার্থে সত্যি। মানুষের মন তার অন্তরতম আনন্দ, বেদনা, প্রেম ও আরও অনেক অননুকরণীয় অনুভূতির কণ্ঠস্বর হিসেবে সঙ্গীতকে বেছে নেয়। তারই কিছুটা ছাপ পাওয়া গেল বর্ণ অনন্যর সাম্প্রতিক অনুষ্ঠানে। কেসিসি অফস্টেজের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে ছিল বর্ণ অনন্য দলের সঙ্গীত পরিবেশনা। কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটির মঞ্চে জাঁকজমকহীন এই গান-আড্ডার আসরে বর্ণ অনন্যের সদস্যরা সুর আর কথার মধ্য দিয়ে যেন এক নকশিকাঁথা বুনে গেলেন। ইতিহাস, রাজনীতি থেকে লোকাচার, মেঠো আলপথের সারল্য থেকে শহুরে রাজপথের বিদ্রোহ, হৃদয়-ছেঁড়া অকল্পনীয় আবেগ থেকে শান্ত, অবদমিত নাগরিক অবসাদ— বর্ণ অনন্যের গান এঁকে চলল এক দীর্ঘ, বর্ণাঢ্য পটচিত্র।

দলের প্রথম পরিবেশনা ছিল একটি মৌলিক গান, ‘লালে লাল’। গানের কথা, সুর এবং উপস্থাপনার আবেগে সুস্পষ্ট দলের দুই মূল কণ্ঠশিল্পী সাত্যকি বন্দ্যোপাধ্যাায় এবং নবমিতা দাসের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সর্বোপরি দার্শনিক ঐতিহ্য। শ্রমিক দিবসে সৃষ্টি করা এই গানের মধ্যে সাত্যকি এবং নবমিতা বুঝিয়ে দিলেন, তাঁরা যে শ্রেণিহীন, বর্ণহীন, বিভেদহীন সমাজের স্বপ্ন দেখে বড় হয়েছেন, এই ক্রমবর্ধমান মেরুকরণের পৃথিবীতে সেই স্বপ্নের নির্যাস তাঁরা পরবর্তী প্রজন্মকে উত্তরাধিকারসূত্রে দিয়ে যেতে চান। দলের সদস্যদের বয়ান অনুযায়ী, গানের কথা এবং স্বরবিন্যাসে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ও গণনাট্য সঙ্ঘের গানের প্রভাব যেমন দৃশ্যমান, তেমনই স্পষ্ট মহীনের ঘোড়াগুলির অনুরণন।

বর্ণ অনন্যর আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, দলের রিদম গিটারিস্ট, মূল সুরকার এবং আর এক কণ্ঠশিল্পী রাজর্ষি ঘোষের সুরারোপণ। মন-কেমনের মাইনর কর্ড ব্যবহার করে তিনি প্রতিটি গানে এক তীব্র নস্ট্যালজিয়া ফুটিয়ে তুলেছেন। এই হারানো অতীতের স্মৃতি খুঁজে ফেরার ভাব কখনও যেমন গীতিকার-সুরকারের সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শনের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠছে, আবার কখনও প্রকাশ পাচ্ছে শহর কলকাতাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করা একাধিক গানের মধ্যে। ‘ঘরে ফেরার গান’, ‘ঘুম পৃথিবী’, ‘দিনান্তে’— এই গানগুলিতে মাইনর কর্ডের বিষাদ যেন গোধূলির আকাশের মতো। প্রতি মুহূর্তে রং পাল্টে যাওয়া এই শহরের ছবির কোলাজ যেন একটা আশ্রয় তৈরি করেছে সে সব গানে। অজানা ও ক্ষয়িষ্ণু ভবিষ্যতের হাতছানি উপেক্ষা করে মিঠে-কড়া স্মৃতির এক স্থায়ী আশ্রয়। শ্রোতারা বয়স নির্বিশেষে এই আশ্রয়ে জিরিয়ে নিয়েছেন ক্ষণকাল। এই মনকেমনের পটচিত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য বেস গিটারে মৈনাক নাগ চৌধুরী, ড্রামসে প্রেমজিৎ দত্ত, ভায়োলিনে দিব্যকমল মিত্রের সুর-তালের সূক্ষ্ম আলপনা।

বর্ণ অনন্যর গানে সুর ও বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি আসলে একটা জাতির ইতিহাস বহন করে চলেছে। যেহেতু নস্ট্যালজিয়া ও মেলানকলিয়া— এই দু’টি স্থায়ী ভাব তাঁদের গানে বিদ্যমান, তাই খুব সহজেই গানের বিষয় হিসেবে চলে আসে এই উপমহাদেশের ইতিহাসে নানা সময়ে ঘটে যাওয়া উদ্বা‌স্তুদের আশ্রয়ান্বেষণ। বিশেষ একটি গান ‘ঘরের মধ্যে খাঁচা’য় আমরা শুনতে পাই ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে হেঁটে চলা অসংখ্য জমিহারা, বাস্তুহারা, কর্মহীন মানুষের অর্তনাদ। দেশভাগের যন্ত্রণা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কোভিড লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের আর্তি পর্যন্ত— গানের মধ্য দিয়ে সবটাই ছুঁয়ে গিয়েছেন তাঁরা। প্রকাশ পেয়েছে লক্ষ লক্ষ গৃহহীন, দেশহীন মানুষের স্মৃতির সেই ‘ইম্যাজিনারি হোমল্যান্ড’-এর আশ্রয়ে দিনযাপন। ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’র শেষে যে ভাবে ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়’ গানটি ব্যবহৃত হয়েছিল, সে ভাবে এবং তার সঙ্গে একটি ভাষ্যের মাধ্যমে এক ঘরের খোঁজ এই গানটিতে আলাদা মাত্রা যোগ করে দেয়।

দলের নামের মধ্যে অক্ষর, তদুপরি ভাষা এবং সর্বোপরি সাংস্কৃতিক বৈষম্যকে বৈচিত্রে পরিণত করার একটা প্রয়াস দেখা যায়। তেমনই বৈচিত্র আরও স্পষ্ট হয়, যখন গানের দলটি এক দিকে শহুরে ধাঁচে মহীনের ‘রাবেয়া কি রুকসানা’ এবং অন্য দিকে ঝুমুরের সুরে ‘গিরগিটির বিষম জ্বালা’, ‘ঝাড়খন্ডে বানালি বিদেশি’ বা সিলেট অঞ্চলের ধামাইল ‘অনুরাগে তনু জ্বলে’ একই দক্ষতায় পরিবেশন করে। পুলক রতন ওঝার সৃষ্টি ‘কত ভয় আসে যায়’-এর সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর ‘হেঁইয়ো হো’ এবং হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘বাঁচব রে বাঁচব’ ঠিক একই ভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সুরের হাত ধরে, ভাবের কাঁধ ছুঁয়ে কতকগুলো অব্যক্ত আবেগ সরব হয়ে ওঠে। মনকেমনের স্মৃতি দিয়ে শুরু হওয়া সন্ধ্যা এক নতুন ভবিষ্যতের অঙ্গীকার দিয়ে শেষ হয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Music Program

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।