E-Paper

স্বৈরাচারের মুখে আয়না তুলে ধরে

যে-সমাজ স্বৈরাচারের জন্ম দেয়, তার শ্রেণিবিভাগ অত্যন্ত শৈল্পিক ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

সৌভিক গুহসরকার

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২৫ ০৭:৫৩
নাটকের একটি দৃশ্য।

নাটকের একটি দৃশ্য।

গত ১ এপ্রিল অ্যাকাডেমির প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চস্থ হল রাসবিহারী শৈলুষিক নাট্যগোষ্ঠীর নতুন নাটক— ‘সিজার’ (৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ)। নাটকটি নির্দেশনা করেছেন কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। শেক্সপিয়রের প্রখ্যাত নাটক ‘জুলিয়াস সিজার’ এ নাটকের প্রস্থানবিন্দু। আধার হিসেবেই ব্যবহৃত। কিন্তু এ নাটক কথা বলে এই সময়ের— যে সময়ে রাজ্য দেশ ও পৃথিবীর নানা প্রান্তে স্বৈরাচারের নগ্ন নৃত্য অবলোকন করছে শৃঙ্খলিত গণমানুষ। যা কিছু মুক্ত, তাকে দমন করে ব্যক্তিগত ক্ষমতাবৃত্তের মধ্যে টেনে আনার যে নিরলস প্রচেষ্টায় শাসকবর্গ উন্মত্ত, এই নাটকটি সেই উন্মত্ততার সম্মুখে আয়না তুলে ধরেছে। গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে যে বিশ্বজোড়া একনায়কতন্ত্র মাথা চাড়া দিচ্ছে, ‘সিজার’ তার হাড়মজ্জা খুলে মেলে ধরেছে দর্শকের সামনে।

রোমান গণতন্ত্রের প্রসিদ্ধ রাজনীতিবিদ ও সেনানায়ক জুলিয়াস সিজারের স্বৈরাচারের উত্থান ও পতন নিয়ে নানা ঐতিহাসিক তথ্য দ্বারা পুনর্নির্মিত এই নাটকের কাহিনি খুবই পরিচিত, সুতরাং এর আখ্যানভাগ বিবৃত করা নিষ্প্রয়োজন। দেখার বিষয় হল উপস্থাপনা। প্রথমেই বলতে হয় এই নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনা দেখার মতো। যে-সমাজ স্বৈরাচারের জন্ম দেয়, তার শ্রেণিবিভাগ অত্যন্ত শৈল্পিক ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রেমেন্দু বিকাশ চাকীর সুপরিকল্পিত আলোক-বিন্যাস নাটকটির ভিতরের ‘এপিক’ ভাব জাগ্রত করেছে। পৃথা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পোশাক পরিকল্পনার মধ্যে ডিটেলের প্রতি যত্ন প্রকাশ পেয়েছে। সে যুগের রোমান পোশাক নিয়ে যে তিনি বিশেষ চর্চা করেছেন, তা স্পষ্ট। এর পর আসে আবহসঙ্গীতের কথা। দেবাশিস সোমের আবহ পরিকল্পনা অত্যন্ত প্রসংশাযোগ্য। এই আবহসঙ্গীতের ব্যবহার দর্শককে মহাকাব্যিক বিস্তারের দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং একই সঙ্গে তা নাটকীয় ‘টেনশন’টি ধরে রাখে। মহম্মদ আলীর রূপসজ্জা এই নাটকটিকে প্রাণবন্ত করেছে। বিশেষ ভাবে ভাল লেগেছে চার ক্রীতদাস ও চারুবাকের সজ্জা। দৃশ্যগত ভাবে ‘সিজার’ নিঃসন্দেহে উচ্চমানের কাজ।

এ বার আসা যাক অভিনয়ের ক্ষেত্রে। গোড়াতেই অদৃজা ভট্টাচার্যর বলিষ্ঠ নৃত্য নাটকের মূল সুরটি বেঁধে দিয়েছে। এই নৃত্য যেন ক্ষমতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার উন্মত্ততা প্রকাশ করে। জুলিয়াস সিজারের ভূমিকায় শঙ্কর দেবনাথের অভিনয় শক্তিশালী। তাঁর অভিনয় সিজারের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতালিপ্সাকে তীব্র ভাবে রূপদান করেছে। পাশাপাশি অর্ণ মুখোপাধ্যায় তাঁর অনুচ্চকিত অভিনয়-ভঙ্গিমার মধ্য দিয়ে দ্বিধা-বিদীর্ণ ব্রুটাসের ছবি এঁকেছেন নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে। লোকনাথ দে নিঁখুত ফুটিয়ে তুলেছেন ক্যাসিয়াসের ভিতরের আগুন। পদ্মনাভ দাশগুপ্ত মার্ক অ্যান্টনির ভূমিকায় উজ্জ্বল। মোহময়ী ক্লিয়োপেট্রার চরিত্রে পিয়ালী বসুর কাজ ভাল। ক্যালপুর্নিয়ার চরিত্রে নবনীতা দত্ত, সারভিলিয়ার চরিত্রে পৃথা বন্দ্যোপাধ্যায়, পোর্শিয়ার ভূমিকায় মৌলি রায় ও কর্নেলিয়া হিসেবে লিপিকা চট্টোপাধ্যায় সাবলীল। নাটকে বিদূষক মারুলাসের ভূমিকায় অগ্নিজিৎ সেন ও ফ্লাভিয়াসের ভূমিকায় সুজয় চট্টোপাধ্যায় বিশেষ উল্লেখ্য। পরিচালক যে ভাবে এই চরিত্র দু’টিকে ব্যবহার করেছেন, তা প্রশংসনীয়। কারণ মূল টেক্সট ভেঙে এঁদের দিয়েই এই সময়ের ন্যারেটিভ বলানো হয়েছে। আর একটি জুটির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য— তাঁরা হলেন শেক্সপিয়র নিজে ও চারুবাক। শেক্সপিয়রের ভূমিকায় অনির্বাণ ভট্টাচার্য চমৎকার কাজ করেছেন। তাঁর অভিনয়ের সহজাত ‘হিউমর’ এই নাটকের তীব্রতার ভিতরে বিশেষ ভাবে উপভোগ্য। ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা ও চারুবাকের চরিত্রে শ্রেয়া সিংহের কাজ নজর কাড়ে।

যে নাটক অতিপরিচিত, সারা পৃথিবীতে বহু-অভিনীত, সেই নাটকটিকে নতুন আঙ্গিকে ভাবা এবং পরিবেশন করা সহজ নয়। সেই কাজটিই অতিশয় দক্ষতার সঙ্গে করেছেন নাট্য-নির্দেশক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। তিনি শেক্সপিয়রকে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু আটকে থাকেননি। পুরনো ভিসুয়াল রেফারেন্স সরিয়ে নতুন ভাবে মঞ্চকে ভাবতে পেরেছেন। একটি নাটক উন্নতমানের হয় শুধু তার অভিনয় দিয়ে নয়, সামগ্রিক প্রযোজনার কারণেই তা দর্শকের চেতনায় আঘাত করতে সক্ষম হয়। সিজার নাটকটি তার আলো, আবহসঙ্গীত, মঞ্চসজ্জা, পোশাক, রূপসজ্জা— এই সব কিছু নিয়ে সামগ্রিক ভাবেই ঘনত্ব ও তীব্রতা সৃষ্টি করতে পেরেছে।

তবে প্রায় তিন ঘণ্টার অধিক সময় ধরে চলা নাটকটির দৈর্ঘ্য কিছু ক্ষেত্রে ঘটনাস্রোতকে ব্যাহত করেছে। বিশেষত দ্বিতীয়ার্ধের শেষের দিকে নাটকীয়-মুহূর্ত থেকে বেশ কয়েকবার সরে যাওয়াতে দৃশ্যের ঘনত্ব নষ্ট হয়েছে। হয়তো কিছু সম্পাদনার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে হয়। তা হলে নাটকটি আর একটু নির্মেদ হতে পারে। তবে পরিশেষে এ কথাও বলা প্রয়োজন যে এই নাটকটি দর্শকদের একটি নতুন অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে নিয়ে যায়। সাম্প্রতিক কালে ‘সিজার’ একটি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের কাজ এবং এখানেই বোধ করি অন্তর্নিহিত রয়েছে এর মূল শক্তি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Academy of Fine Arts

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy