পুরুষতন্ত্রের একচেটিয়া রাজত্বে নারীশিল্পীদের উপস্থিতি এক সময়ে ছিল নামমাত্র। তাঁদের কাজ সম্পর্কে সে ভাবে সম্যক ধারণাও গড়ে উঠত না। চতুর্দিকে পুরুষবেষ্টিত দলের খ্যাতি তখন মধ্যগগনে। এই চাপা পড়ে যাওয়া ক্ষমতাকে মুক্ত করতে এগিয়ে এলেন পাঁচ ক্ষুব্ধ নারী। বলা ভাল, মহাকাব্যের পঞ্চশক্তি। নামান্তরে করুণা সাহা, মীরা মুখোপাধ্যায়, শানু লাহিড়ী, সন্তোষ রোহাতগী মৈত্র ও শ্যামশ্রী বসু। গড়ে উঠল ভারতের প্রথম মহিলা শিল্পীদল। প্রতিভা, সাহস ও আভিজাত্যের প্রতিভূ ছিলেন এঁরা। মন্ত্র ছিল একটিই— সমাজে যথার্থ নারীশিল্পীদের পরিচয় মেলে ধরা। সেই অভিপ্রায়ে ১৯৮৩ সালে শুভারম্ভ হল ‘দ্য গ্রুপ’-এর। পরবর্তীতে দলের সদস্যসংখ্যা বাড়তে লাগল। সময়ের নিয়মে পঞ্চবাতির অবসান হল পর্যায়ক্রমে।
সারা বছরের বিবিধ কর্মকাণ্ডে পূর্বসূরিদের ধারাবাহিকতায় আজও দাঁড়িয়ে এই দল। পঞ্চকন্যার শিল্পের সেই মান, বর্তমান শিল্পদশায় কিছুটা ফিকে হলেও, কয়েকজনের রচনা সেই আগের অবস্থাকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রাখে। সে রকমই কিছু নিদর্শন নিয়ে সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের নিউ সাউথ গ্যালারিতে প্রদর্শিত হল গ্রুপের ৪১তম প্রদর্শনী।
অগ্রজ শিল্পী অঞ্জলি সেনগুপ্তের কাজে বরাবরের মতোই লোকশিল্পের ফর্ম দেখা যায়। নজর কাড়ার মতো ছিল তাঁর ‘তিন কন্যা’র বর্ণনা। চড়া মিশ্র রঙের সাবেকি প্রথায় শিল্পীর অভিজ্ঞতার পুঁজি বাঙ্ময় হয়ে ওঠে তাঁর কাজে। অ্যাক্রিলিকের কাজ ‘অনামা’য় নকশিকাঁথার রূপক-এর মাধ্যমে প্রকৃতিকে চমৎকার যত্নে বুনেছেন মহুয়া ভট্টাচার্য। তাঁর এই কাজ পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ সূচিশিল্পের উৎকর্ষের কথা মনে করায়।
নারীশক্তি: অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে দ্য গ্রুপ আয়োজিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম
মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়ের ‘মেলোডি অ্যান্ড রিদম’ ছবিটি অনায়াসে শাস্ত্রীয় পরিমণ্ডল হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু নীলের সুন্দর আবহ চোখ টানলেও, ড্রয়িংয়ের ফিগারেটিভ ত্রুটি চোখে পড়ে। শিল্পী তমালী দাশগুপ্তর মেধাবী চর্চায় মূল বক্তব্য স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। রং ও ব্রাশিংয়ের দক্ষ মিশেলে স্পষ্ট ‘ইন সার্চ অব পিস’ কাজটি নান্দনিক গুণের যথার্থ উদাহরণ। উপরাংশ ও নিম্নাংশে অফ হোয়াইটের ব্যবহার আগমনীর আলো তৈরি করে। অগণিত মানুষ জড়ো হয় নতুন দিশার আশায়। এ বারের কাজে বিশেষ ভাবে নজর কাড়ে চিত্রপটের বিভাজন রেখার সৌন্দর্য। আয়তন ও তল অনুসারে সীমা ঘোষ ভট্টাচার্যের ‘বিয়ন্ড দ্য ডার্কনেস’ সবুজ বর্ণচক্রের একটি বিমূর্ত কাঠামো। রঙের গভীরতায় সুপ্ত কামনা উঁকি দেয়। স্প্যাচুলার অনুরূপ স্ট্রোকে নিসর্গকে একই ধারায় রেখেছেন রিনা মুস্তাফি। তবুও তার মধ্যে ব্যতিক্রমী ছিল একটি কাজ— ‘নেচার’। নুয়ে পড়া বর্ণিল বৃক্ষরাজি ছাপিয়ে, দূরের এক ছিটে কমলা রং দৃষ্টিসুখ কয়েক গুণ বাড়িয়ে তোলে।
‘উই আর দ্য রেসিডেন্ট অব আ ভ্যানিশিং ওয়র্ল্ড’ কাজটি সম্ভবত সিমেন্ট এফেক্টের রেপ্লিকা। শিল্পী নীলিমা গোয়েল জানান, ‘এটি সম্পূর্ণ বর্জ্য পদার্থ ও ভূমিজ রঙের মাধ্যমে তৈরি।’ কাজের বৈশিষ্ট্য অনায়াসেই এই শিল্পীকে আলাদা করে দেয়। সভ্যতা সৃষ্টির পূর্বে পাওয়া প্রাচীন লিপি, চিহ্ন, উপাদানই শুধু নয়, বাকি জিনিসেরও একটি আস্তরণের পথ গড়ে তুলেছেন শিল্পী গোয়েল। ভাস্কর্যের দক্ষ শিল্পী বনশ্রী খানের ‘মিউজ়িক ইজ় গড’ ব্রোঞ্জের উজ্জ্বলতাই শুধু নয়, স্টাইলের কমনীয়তায় মন ছুঁয়ে যায়। বাছাই রঙের লেপনে শিল্পী সুদেষ্ণা দাসের ‘দি আউল’ ত্রিমাত্রিক দৃষ্টির উপযুক্ত নজির।
মধুশ্রী মুচ্ছালের স্বপ্নে ধরা দেয় মহাকর্ষ শক্তির আয়োজন। তেলরঙের ‘শিবা’য় সেই শক্তিরই বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে পড়ে মৌলিক বর্ণের জোর নিয়ে। ঝাঁঝালো রঙের প্রয়াস, ঠিক নিরীক্ষণের দূরত্ব দাবি করে। মিনতি নাথ তাঁর কাজে প্রাঞ্জল ভঙ্গিতে স্থাপন করতে চেয়েছেন নারীর শিকড়। তবে শিল্পীর অতীতের কাজে আত্মবিশ্বাসের যে জোর পাওয়া যায়, সাম্প্রতিক টেক্সচারে তার কিছুটা অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে রং ও ড্রয়িংয়ের সমতা ব্যাহত হয়েছে কোনও কোনও জায়গায়।
প্রথাসিদ্ধ চারুকলায় রপ্ত দলের অন্যতম উদীয়মান শিল্পী মালিয়া ভট্টাচার্য। কাজের মধ্য দিয়ে তাঁর শিল্পীসত্তার কতটা উত্তরণ ঘটেছে, তার চেয়েও বেশি আকর্ষণ করে, তাঁর কাজে নতুন ধরনের মিশ্র পদ্ধতি। কমবেশি মাত্রায় পোড়ানো চা ও কফির ব্রাউনিশ রং, কম্পিউটার নির্মিত কিছু ডকুমেন্টস পেস্ট করা এবং ভাস্কর্যের ভলিউম আনা... সব মিলিয়ে ইতিহাসের মুমূর্ষু এক চেহারা। সময়ের ক্ষতকে খুঁচিয়ে বার করার প্রক্রিয়ায় শিল্পীর দীর্ঘমেয়াদি শ্রমকে সেলাম জানাতে হয়।
৪১ বছর শিল্পজগতে সগৌরব টিকে থাকা কম নয়। পরবর্তী কালে কোনও মহিলা শিল্পীদলও সে ভাবে উঠে আসেনি। তাই সেই শিকড়ের কাছে ফিরে যেতে হয় বারবার। সেই পঞ্চকন্যা, যাঁদের অলক্ষ্য নির্দেশনামা আজও অনুসরণ করে চলেছেন দলের সদস্যরা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)