E-Paper

রূপকল্পের অনন্ত বিস্তার

মৌলিক কাঠামোর নিরিখে প্রথমেই নাম আসে শিল্পী হিরণ মিত্রের। কাজ এবং অভিজ্ঞতার বিচারে উনি যথার্থই এগিয়ে।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২৫ ০৭:৩৯
সমকালীন: অ্যাকাডেমিতে ‘ওপেন উইন্ডো’ দলের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

সমকালীন: অ্যাকাডেমিতে ‘ওপেন উইন্ডো’ দলের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। নিজস্ব চিত্র।

সাম্প্রতিক সময়ের উদ্বেগ নিয়ে এক মনোজ্ঞ দৃষ্টান্ত রাখল ‘ওপেন উইন্ডো’। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে ছড়িয়ে পড়েছিল মুক্ত বাতায়নের ‘মোটিফ’। আয়োজনে দলের ১৬ জন সদস্য। সিরিজ়ের নাম ‘জ়িরো টু ইনফিনিটি’। শুরু থেকেই দলটির সৃষ্টিকল্প দর্শকের ঔৎসুক্য বাড়ায়। প্রদর্শনীতে যথার্থ ভাবেই ফুটে উঠেছিল তাঁদের নিজস্ব এক শিল্পভাষা।

সাল ১৯৯৭। কলকাতার বুকে একদল শিল্পপ্রেমী জোট বাঁধেন। সেই দলের প্রাথমিক শর্ত ছিল শিল্পের সমস্ত ধারাকে জড়ো করা, জ্ঞানের পরিধি বাড়ানো। এই ভাবেই দলটি এগিয়ে যায়। শাখাপ্রশাখা বাড়ে। এ বারে কিছু নতুন মুখের কাজ দেখা গেল, যাঁদের কাজে গতানুগতিকতার অনুকরণ নেই। বরং আছে অবচেতনের গহ্বর।

মৌলিক কাঠামোর নিরিখে প্রথমেই নাম আসে শিল্পী হিরণ মিত্রের। কাজ এবং অভিজ্ঞতার বিচারে উনি যথার্থই এগিয়ে। নাটক-চলচ্চিত্র বিভাগে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন। সেই প্রভাব তাঁর ক্যানভাসে আসবে, এটা স্বাভাবিক। একটি প্রসেসের মধ্য দিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে। শিল্পীর মতে, ছবি কেবল দৃশ্যমান নয়। এক-একটি পারফর্মার। রূপ, রং, তরলতার মধ্য দিয়ে ইমেজগুলি নড়াচড়া করে। লাল ও কালো রং দিয়ে সেটি বোঝানো হয় এবং এতে সংঘর্ষজনিত অস্থিরতা প্রকাশ পায়।

চিত্রশিল্পী প্রদীপ রক্ষিতের টেক্সচারে উঠে আসে সবুজের মিশেল। ‘ল্যান্ডস্কেপ পেন্টার’ হিসেবে তিনি স্বীকৃত। পাহাড়ি অঞ্চলে থাকার কারণে জমির রং তাঁর ক্যানভাসে প্লাবিত হয়। বর্তমানে কংক্রিটভিত্তিক জীবনে পুরনো দেওয়াল, পাঁচিলে সেই ল্যান্ডস্কেপ খুঁজে পান শিল্পী। রং দিয়েই ছবির পরত সেজে ওঠে। প্রুশিয়ান ব্লুর সঙ্গে কোবাল্ট মিশিয়ে নীলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা। এ ছাড়া সবুজ, ইয়েলো অকার, ভিরিডিয়ান গ্রিন। অদ্ভুত সাহসের রং, ভাঙতে ভাঙতে কখনও যেন মনে হয় গভীর জঙ্গল। নস্ট্যালজিক পরিবেশ। তারই মধ্যে আলোর শোভাযাত্রা। পুরোটাই তেলরঙের বিমূর্ত আঙ্গিক।

ভালমন্দ, দুঃখ ও দুঃখপ্রেমের আবেগ নিয়ে ক্যানভাসে বিচরণ করেন সমীর আইচ। যেহেতু তিনি একজন সমাজ-সচেতন, বলিষ্ঠ শিল্পী, তাই তাঁর কাজে সরাসরি ইঙ্গিত পাওয়া যায় সমাজের লোভ-লালসার দর্শন। ‘গ্রিড’ নামের ছবিটি মিশ্র মাধ্যমের কাজ। বাঁ-দিক ধরে সবুজ এবং নীচের লাল গালিচার কাজ দেখার মতো। নিখাদ জিভ লকলকে জান্তব চেহারার এক বিরাট রূপক। গভীর সঙ্কেত বয়ে আনে। কালোর গভীর ব্যবহারে কুশীলব জীবন্ত হয়ে ওঠে।

ভাস্কর্যর মাধ্যম হিসেবে লোহাকে বেছে নিয়েছেন ঋষি বড়ুয়া। ফেলে দেওয়া যন্ত্রাংশ, লোহার পাত এবং রডের উপকরণ। একই সঙ্গে কঠিন ও নমনীয় ফর্ম বোঝানো। উদ্দেশ্য, প্রাণিজগৎ নির্মাণের মধ্য দিয়ে সামাজিক অবিচারকে তুলে ধরা। যেমন, আয়রন ও স্ক্র‍্যাপে তৈরি চিত হয়ে শোয়া একটি ‘ইনসেক্ট’ পিষে ফেলার নির্মম ভঙ্গি। বিশিষ্ট ভাস্কর জনক ঝঙ্কার নার্জারির ব্রোঞ্জে এলায়িত নারী। ‘ডুয়াল আইডেনটিটি অব উইমেন’ নামের কাজটি নারীশক্তির মহিমা নিয়েও পড়ে থাকে তুচ্ছ ভূমিকায়।

জীবজগতের রূপ ও ছন্দের নিরন্তর প্রকাশে আকৃষ্ট হন শিল্পী চন্দ্রশেখর দাস। বৈচিত্রের আনন্দে গ্রথিত হতে থাকে শিল্পীর নির্মাণ। তাপস বিশ্বাসের উড এবং ব্রাসের টেক্সচারে ক্রমশ রূপান্তর ঘটলেও, উন্মুক্ত কেন্দ্রে মুখিয়ে থাকে একটি ফুলের বীজ। তাপস কোনারের অবচেতন মন থেকে ফর্ম নিজস্ব কথা বলে। সরল রং-রেখায় উচ্ছ্বসিত হয় নাইভ আর্ট। মিশ্র মাধ্যমে অবচেতন মনের ‘ফর্ম’ নিয়ে কাজ করেছেন সুমন দে। দু’দিক অন্ধকারের মধ্যবর্তী অংশে ফ্যাকাসে আলোর ঝলক। গঠন অনুসারে ধরা যেতে পারে, আলোটি ছবির প্রবেশপথ। পরিশীলিত ব্রাশে উদ্রেক হয়েছে বিমূর্ত ক্ষোভ।

‘পাওয়ার অব নিউ জেনারেশন’-এর স্রষ্টা দশরথ দাস। সম্পূর্ণ বিষয়টি পেপার মাসে করা। উল্লম্ব জমিতে কাদামাটির এফেক্ট। স্কাল, মেরুদণ্ড, কাঁচির প্রতীকে হাহাকার ধ্বনি। তবুও জন্ম হয় শিশুর। টেকনিকের নতুনত্বে আগ্রহী হন দর্শক। উমেশ জানার ছবিতে নগর উন্নয়নের নামে শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ। মেনে নেওয়ার অসহায় পরিস্থিতি। ‘অনামা’ কাজটি তার চূড়ান্ত নমুনার ডকুমেন্টধর্মী কাজ।

নারীর অভ্যন্তরীণ শক্তির খোঁজে সুদেষ্ণা হালদার। এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পী এগন শিয়েলের স্টাইল দ্বারা অনুপ্রাণিত তাঁর কাজ। ‘পাওয়ার’ ক্যানভাসে নারীর উদ্দাম রূপ। পৃষ্ঠতলের সাপোর্ট নিয়ে ভারসাম্য রেখেছেন শিল্পী। চয়ন রায়ের কাজের নাম ‘হোয়্যার উই আর’— জ্ঞানের উপায়ে নতুন সৃষ্টির পথ। ধূসর সারফেসে অস্তিত্বের সঙ্কট। ভাল লাগে সরু রেখার ঠিক পরিমাপ নির্ণয়।

অগ্রজ শিল্পী অমিতাভ ধর একজন সংবেদনশীল চিত্রকর। দ্রুত ব্রাশিংয়ে লেয়ারের পর লেয়ার চাপিয়ে যান। কোথাও পাতলা করে রং ছেড়ে দেওয়া। এতে কোনও সংঘাত তৈরি হয়নি। ‘স্টোরি অব আ চেয়ার’ স্মৃতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। আলো-ছায়ার করুণ সুরে সহগামী হয় ক্যাথারসিস। প্রসেনজিৎ সেনগুপ্তের সৃজনশিল্পে চিন্তাবিদ কান্টের তত্ত্ব অনুভূত হয়। যন্ত্রবিদ্যার লোভে মানুষ আত্মমগ্ন। নিষ্প্রভ আলোছায়ার খণ্ডচিত্র। ড্রয়িং ও রঙের নৈপুণ্যে অনুরণিত হয় সময়ের রেশ। নীচে ক্যালিগ্রাফির গ্রাফিটি, যা দর্শকের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।

প্রদর্শনীটি একটি সমকালীন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার গবেষণাগার বলা যেতে পারে। নতুন সম্ভাবনার ব্যাখ্যাতীত অনুভূতির সঞ্চার করে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Academy of Fine Arts

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy