Advertisement
E-Paper

মহাভারতের বর্ণাঢ্য আখ্যান

ইতিহাস, বাস্তবতা ও কল্পনার মিশ্রণেই যে রচিত এই মহাকাব্য, সে কথা আমরা জানি। তাই স্বভাবতই এর চিত্রায়নে শিল্পীর অফুরন্ত কল্পনার অনুলিখনের সুযোগ থাকে।      

সোহিনী ধর

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২২ ০৬:১২
চিরকালীন: শুভাপ্রসন্নের ‘দ্য মিস্টিক অব দি এপিক’ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম

চিরকালীন: শুভাপ্রসন্নের ‘দ্য মিস্টিক অব দি এপিক’ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম

ষোড়শ শতকে সম্রাট আকবর শ্রুতি মাধ্যমে ‘মহাভারত’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর দরবারি শিল্পীদের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধটি সচিত্রকরণের নির্দেশ দেন। সৃষ্টি হয় ‘রজ়মনামা’। তেমনই যুগ-যুগান্ত অবধি মহাভারতের মাহাত্ম্য ও ভাবাদর্শের ব্যাখ্যান নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বহু শিল্প, সাহিত্য ও পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রও। রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে থেকে পিটার ব্রুকের মতো স্বনামধন্য সাহিত্যিক, লেখক, চলচ্চিত্রকার সকলেই নিজেদের স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। ‘মহাভারত’ যেন মানবসভ্যতার নৈতিকতার এক চলন্তিকাসম। প্রাচীন হয়েও সমকালীনত্বের পরিভাষায় সিক্ত। প্রেম, ভালবাসা, ক্রোধ, হিংসা, জিঘাংসা... জীবনের নানাবিধ আবেগ ও অনুভূতির লীলাক্ষেত্র। তাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যগুলির মধ্যে তা অন্যতম। কল্পনা ও বাস্তবের সংশ্লেষে সৃষ্ট এই মহাকাব্যটি শিল্পকলা ও সাহিত্যের নিরিখে তাই এক অতি মূল্যবান সম্পদ। ভারতীয় লোকশিল্প থেকে স্বদেশী ভাবনায় উজ্জীবিত শিল্পীদের রচনায় ‘মহাভারত’-এর উপাখ্যানগুলি তাই বারংবার জায়গা পেয়েছে। পাশাপাশি, এই কাব্যের অগণিত চরিত্রের মতোই এর আঙ্গিক, বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনার রূপ হয়ে উঠেছে অফুরন্ত। ভারতীয় আধুনিক শিল্পের প্রেক্ষাপটে রবি বর্মা, নন্দলাল বসু, এম এফ হুসেন থেকে শুরু করে পরবর্তী বহু শিল্পীর ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য।

সেই রকমই মহাভারতের সারাৎসার অবলম্বনে সম্প্রতি কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটিতে (কেসিসি) উন্মোচিত হল সমকালীন শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের এক একক বর্ণাঢ্য চিত্র প্রদর্শনী। নাম ‘দ্য মিস্টিক অব দি এপিক’। ক্যানভাসে চিত্রিত মোট ২৪টি ছবির নান্দনিক বিন্যাসে আয়োজিত এই প্রদর্শনীটি শিল্পরসিকদের কাছে এক মহার্ঘ প্রাপ্তি।

ইতিহাস, বাস্তবতা ও কল্পনার মিশ্রণেই যে রচিত এই মহাকাব্য, সে কথা আমরা জানি। তাই স্বভাবতই এর চিত্রায়নে শিল্পীর অফুরন্ত কল্পনার অনুলিখনের সুযোগ থাকে। এ ক্ষেত্রেও শিল্পী তাঁর এই ছবিগুলিতে কল্পনা ও বাস্তবের মেলবন্ধনে এক ন্যারেটিভ কাব্যময়তা ফুটিয়ে তুলেছেন। কেসিসি-র বিস্তৃত প্রদর্শশালায় তাঁর ২৪টি ছবি যেন ‘মহাভারত’-এর অগণিত চরিত্রের মতোই বহুমাত্রিক, রং, রেখা ও রূপের মিছিল হয়ে সরব।

গত দু’বছর যাবৎ বিশ্ব জুড়ে অতিমারির ভয়াবহ প্রকোপে মানবজাতির সকরুণ আর্তির মাঝে শুভাপ্রসন্নর এই ছবিগুলি খুবই অর্থবহ। এ যেন এই মহাকাব্যের আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে সমকালীন অনিশ্চয়তার এক আবেগপূর্ণ উপস্থাপন। ভোগতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের অধার্মিক কর্মকাণ্ডের মাঝে ন্যায় ও ধর্মের প্রতি এক নিঃশব্দ আকুতি!

সৃজনশীল মন, শিল্পীকে করে রাখে চিরনবীন। এই প্রদর্শনীর প্রশস্ত ক্যানভাসগুলি (২০ x ২০ ইঞ্চি) মূলত তারই প্রতিফলন ঘটায়। মাধ্যমগত ভাবে ছবিগুলি তেল ও অ্যাক্রিলিকের মিশ্রমাধ্যমে রচিত। কিন্তু এমন বৃহৎ পরিসরে, ‘মহাভারত’-এর এমন বর্ণময় উপস্থাপনা সাম্প্রতিককালে নেহাতই এক বিরল দৃষ্টান্ত।

প্রায় প্রতিটি ছবির ক্ষেত্রেই সেটির শৈল্পিক আবেদনকে আরও দৃঢ় ভাবে সুনিশ্চিত করেছে শিল্পীর নিজের হাতে লেখা সুদৃশ্য অক্ষরমালা। বহু ছবিতেই সরাসরি ‘মহাভারত’-এর শ্লোককে চিত্রপটে নিপুণ ভাবে সংযোজনের মাধ্যমে ভাবার্থটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছবিগুলির সমতলীয় উজ্জ্বল রং ও সুডৌল বহিঃরেখা মূলত ধ্রুপদী ধারার সমার্থক। কিন্তু গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী, শকুনি, দুর্যোধন, অর্জুন, কৃষ্ণ, কর্ণ অথবা পিতামহ ভীষ্ম... প্রায় সব চরিত্রায়নে চমৎকার উজ্জ্বল ফ্লুরোসেন্ট রঙের মহিমায় তারা উদ্ভাসিত। অভূতপূর্ব রঙের এই বিন্যাস, এই প্রাচুর্য যেন বর্তমান পৃথিবীর হতাশা ও মলিনতার মাঝে এক আশা ও আশ্বাসের সূচকস্বরূপ!

প্রতিটি ছবিই তার নিজগুণে সমৃদ্ধ, কিন্তু তারই মধ্যে যেন বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ‘জরাসন্ধ বধ’-এর ছবিটি। অতিকায় ভীম ও বলশালী জরাসন্ধের মাত্র দু’টি মানবিক আকৃতি দিয়ে গোটা চিত্রপটটি রচনা করেছেন শিল্পী। কিন্তু বলা বাহুল্য, ভীমের অপরিসীম বাহুবলের কাছে ধরাশায়ী জরাসন্ধের যে সমর্পণ, অথবা ধর্মের হাতে অধর্মের যে বিনাশ, সেই দ্বৈত বার্তা ফুটে উঠেছে উজ্জ্বল বেগুনি ও গোলাপি বা ম্যাজেন্টা রঙের অত্যাধুনিক বিন্যাসে। প্রচলিত ধ্রুপদী রঙের বিরুদ্ধে পুনরায় এক যুগোপযোগী নবীনত্বের প্রতিশ্রুতি যেন বহন করে এই রঙের ব্যবহার।

‘মহাভারত’ এমনই এক মহাকাব্য, যার মধ্য দিয়ে জাতিভেদ, ক্ষমতায়ন, ধর্মযুদ্ধ ইত্যাদির প্রতিফলন পেয়ে থাকি আমরা। এই বাংলায় কালীঘাটের পট, বটতলার ছাপাই ছবি থেকে বহু একক শিল্পীর কাজেই আমরা ‘মহাভারত’-এর উল্লেখ পাই। কিন্তু এই প্রদর্শনীর ছবিগুলি তার আয়তন, বর্ণন ও প্রাসঙ্গিকতার নিরিখে দর্শকের দৃষ্টি বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করে, যা মনে থেকে যাবে দীর্ঘ সময়।

Art exhibition Mahabharata Review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy