সোসাইটি অব কন্টেম্পোরারি আর্টিস্টস ট্রাস্টের নিজস্ব প্রদর্শশালা বি আর পানেসর গ্যালারিতে সম্প্রতি আয়োজিত হয়েছিল অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম একক প্রদর্শনী। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার ঝোঁক ছিল অনির্বাণের। ড্রয়িংয়ের হাত খুব ভাল থাকায় পরবর্তীকালে প্রাদেশিক আর্ট কম্পিটিশনে একাধিক পুরস্কারও পান তিনি। তা সত্ত্বেও বাড়ি থেকে ছবি আঁকায় তেমন সমর্থন পাননি বলে পড়াশোনা শেষ করেই একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় যোগ দেন শিল্পী। সেখানেও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ হয়তো হয়নি, কিন্তু শিল্পের সঙ্গেই যুক্ত থেকেছেন নানা ভাবে। ছবি দেখেছেন প্রচুর। এখন অনির্বাণ সম্পূর্ণ ভাবেই শিল্পচর্চা করেন। ইতিমধ্যে কিছু দলীয় প্রদর্শনীতে যোগদান করেছেন তিনি।
ষড়রিপু নিয়ে বেশ কিছু ছবি এঁকেছেন শিল্পী। এ ছাড়াও প্রদর্শনীতে তাঁর অন্যান্য অনেক ছবির সঙ্গেই পরিচিত হলেন দর্শক। সব মিলিয়ে ২৯টি ছবি প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত করেছিলেন তিনি।
‘কাম’ ছবিতে অনির্বাণ বলতে চেয়েছেন যে, জীবদ্দশায় আমাদের শরীরে, মনে যে কামনা-বাসনা কাজ করে, মৃত্যুর পরেও সেগুলো থেকে যায় পৃথিবীর কোথাও না কোথাও— আকাশে, বাতাসে, অন্তরীক্ষে। সেই কারণেই মৃত মানুষের ব্যবহৃত জিনিস ধ্বংস করার নিয়ম আছে শাস্ত্রে। আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস রয়েছে শিল্পীর, কাজটি দেখে তেমনই মনে হয়।
‘ক্রোধ’ ছবিটিতে মানুষের ব্যক্তিগত ক্রোধের সঙ্গে প্রকৃতির রুষ্ট ভাব মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। একমাত্রিকতা ছাড়িয়ে ছবিটি বহু স্তরে ব্যাপ্ত। এক দিকে মানুষের শরীরের ক্রোধকে লাল রঙে দেখিয়েছেন তিনি। আবার কোথাও দেখিয়েছেন, সেই ক্রোধরূপী অবয়ব কিছুটা ত্যাগ করতেও পারছে মানুষ। অপর দিকে প্রকৃতির উগ্র রূপে গাছপালার ছিন্নভিন্ন অবস্থা। এ যেন বিশ্বজগৎ সৃষ্টির আগের এক কল্পিত অবস্থা। এ ছবি দর্শকের মনে আরও জানার ঔৎসুক্য জাগায়।
‘লোভ’ ছবিটিতে শিল্পী এমন অনেক মানুষ দেখিয়েছেন, যারা তাদের পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা লণ্ডভণ্ড করে ছুটে চলেছে কিছু পাওয়ার সন্ধানে। এই দৌড়ে কোনও শান্ত ভাব নেই। মানুষের শরীর এবং মনের অস্থিরতাই প্রকাশ পেয়েছে। সমস্তটাই যেন লোভের ফলাফল।
‘মোহ’ ছবিতে অনির্বাণ কোনও রং ব্যবহার করেননি। এটি সম্পূর্ণ ভাবেই কালো সাদায় আঁকা। মোহ মানুষের অন্তরের সব স্তরেই কাজ করে বলে দেখিয়েছেন শিল্পী। বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষ মোহে মত্ত। বিষয় আসক্তিতে, প্রেমে, স্নেহে মানুষ কখনও কখনও উদ্ভ্রান্ত, কখনও উচ্ছৃঙ্খল এবং যথেচ্ছাচারী। ফলে মনে কোনও আনন্দ নেই। সব সময়ে হারানোর আশঙ্কা ও বেদনা। শিল্পী এখানে একজোড়া পা দেখিয়েছেন। তবে সেই পায়ের অধিকারী কোনও একজন মানুষ নয়, বহু মানুষ। এ ছবির রচনাশৈলী নজর কাড়ে।
এর পরে বলা যাক ‘মদ’ ছবিটির কথা। শাস্ত্রে মদ শব্দটি ‘অহঙ্কার’ বা ‘দম্ভ’র প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অনির্বাণের ছবিটিতে চেয়ারে বসা একটি মাথাসর্বস্ব মানুষকে দেখানো হয়েছে, যে উগ্র স্বভাবাপন্ন এবং অহঙ্কারী। শুধু তাই নয়, এর মস্তিষ্কের ভিতরে শিল্পী এঁকেছেন একটি স্পিচ বাবল। এর ভিতরে কোনও কথা নেই, কারণ হয়তো চিন্তা এবং তার প্রকাশের অভ্যন্তরে যে স্তব্ধতাটুকু রয়েছে, সেটুকুই শিল্পী দেখাতে চেয়েছেন। আত্মচিন্তায় মগ্ন মানুষের ছবিটির ভাবনাতেও শিল্পীর নিজস্বতা যথেষ্ট বর্তমান।
‘মাৎসর্য’ শব্দের অর্থ পরশ্রীকাতরতা বা ঈর্ষা। মানসিক স্থিরতা হারিয়ে একটি চেয়ারে বসা মানুষের ছবি। তার বহু হাত নানা দিকে ছড়ানো। আকাশ-বাতাস ছাড়িয়ে সেগুলি অপরের কাছ থেকে, এমনকি প্রকৃতির কাছ থেকেও সর্বস্ব গ্রাস করতে চাইছে। ছবিটির আঙ্গিক বা পরিভাষায় শিল্পীর দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। অপূর্ব রঙের ব্যবহার। এই সমস্ত ছবি অ্যাক্রিলিক, কালি-কলম এবং আর্থ কালারের মিশ্র কাজ।
অনির্বাণের ছবিতে অনুভব করা যায় কিছুটা পরাবাস্তববাদী রহস্য এবং অস্পষ্টতা। তাঁর শিল্পকলায় সাররিয়ালিজ়ম বাস্তববাদকে প্রতিমুহূর্তে আহ্বান করেছে। কিন্তু সেখানেও স্বগতোক্তির অংশ এবং নিজের সৃজনশীলতার উদ্বেগ প্রকাশে হয়তো একটি ক্যাথার্টিক ভাব দেখতে পাওয়া যায়। আবার জায়গায় জায়গায় প্রকাশ-বিষণ্ণতা বা সামান্য করুণরসের আভাস লক্ষণীয়।
চিত্রকলা মানেই শুধু সুন্দর ছবি তো নয়। শিল্পীর কাজে দর্শকের হৃদয়, মনন, চিন্তাভাবনা সমস্ত কিছু সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এ ছাড়াও আমাদের মনের কোমল ও সূক্ষ্ম অনুভূতি এবং জীবনবোধকে বিস্তৃত করার কাজটিও করে থাকে শিল্প। হয়তো সেই কারণেই শিল্পী অনির্বাণের রূপকধর্মী ছবির সংগ্রহ দর্শককে অন্য এক রসের সন্ধান দেয়, ভাবায়।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)