E-Paper

দূষণহীন প্রকৃতির মায়াবী আস্তর

কতটুকু ছাড়ব বা কতটুকু রাখব, শিল্পকলায় এটি বোধহয় সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। চোখই হচ্ছে প্রথম শিক্ষক। যতক্ষণ নিজের চোখ না তৈরি হয়, ততক্ষণ এই সিদ্ধান্তে যাওয়া মুশকিল।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২৫ ০৮:১২
প্রকৃতি: শিল্পী বাদল পালের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

প্রকৃতি: শিল্পী বাদল পালের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। নিজস্ব চিত্র।

মূলত প্রতিফলিত আলোর জন্যই স্বচ্ছ জলরং অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় বেশি দীপ্যমান হয়ে ওঠে— শিল্পী বাদল পালের গড়িয়ে পড়া জলরং নিয়ে এই কথাগুলি বলেছেন প্রবীণ শিল্পী গণেশ হালুই। স্পর্শকাতর এই মাধ্যমটিতে নিয়ন্ত্রণ-দক্ষতা না থাকলে তা সামলানো মুশকিল। সেহেতু অন্যান্য মিডিয়ামের চর্চা হয়তো তুলনায় অনেকটাই নিরাপদ। যদিও ইদানীং স্বচ্ছ জলরঙের জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে।

স্বচ্ছ জলরঙের কাজে অন্য রকম আবেদন রাখলেন চিত্রশিল্পী বাদল পাল। এই মাধ্যমে তাঁর সহজাত বিচরণ বলেই দেয়, শিল্পীর প্রিয় মাধ্যম জলরং। অত্যন্ত স্বল্প মূহূর্তে স্বচ্ছতাকে ধরেন তিনি। আর বিষয় বাংলার মাটি, বাংলার জল। দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তরে শিল্পীর মুনশিয়ানায় তৈরি হয় এক মনোরম ভুবন। সম্প্রতি উত্তর কলকাতার গীতা আর্ট গ্যালারি গৃহীত প্রদর্শনীটিতে ছিল শিল্পী বাদল পালের ২৪টি ছবি। সিরিজ়ের নাম, “সিম্ফনি অব নেচার”। রঙে রঙে মিলনের ঐকতান।

কতটুকু ছাড়ব বা কতটুকু রাখব, শিল্পকলায় এটি বোধহয় সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। চোখই হচ্ছে প্রথম শিক্ষক। যতক্ষণ নিজের চোখ না তৈরি হয়, ততক্ষণ এই সিদ্ধান্তে যাওয়া মুশকিল। সে ক্ষেত্রে দীর্ঘ চর্চায় রত শিল্পীরা অনায়াসেই এই কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন। সে রকমই একজন বর্ষীয়ান শিল্পী বাদল পাল। নীল, হলুদ, সবুজ বর্ণের নানান শেডের প্রয়োগে স্থানচিত্র ভিন্ন ভিন্ন মোড় নির্মাণ করে। আকাশ-নদী বোঝাতে, উপর থেকে এমন ভাবে ব্রাশ টেনেছেন, মনে হয় অন্ধকার ভেদ করে, গলে গলে পড়ছে হলুদ আলোর ঝর্ণা। আর একটি ছবির আকাশে আল্ট্রামেরিন ব্লু-র উজ্জ্বল লেপন। নীচে হলুদ, বাদামির আবছা জমি। এই ছবিটিও চটজলদি ব্রাশিং-এর অন্যতম কাজ। ডিটেলে কোনও ফর্ম না দেখিয়ে, তাৎক্ষণিক ইমপ্রেশনে যোগসূত্র টেনেছেন। নিঃসন্দেহে অনবরত অভ্যাসের ফল, ভেজা তুলির জাদু।

বর্তমানে সৃষ্টির জন্য অফুরন্ত সময় থাকলেও,অতীতের ইতিহাস তা বলে না। ঢাকা, বিক্রমপুরে জন্ম (১৯৩৭)। সপরিবার বাধ্যতামূলক চলে আসতে হয় ১৯৫০-এ। ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক থাকলেও, সেই সময় প্রায় প্রতিটি পরিবারই ছিল এর পরিপন্থী। জেদেই ভর্তি হওয়া ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে। ফাইন আর্টস নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন (১৯৬০)। পেয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় গোবর্ধন আশ,অতুল বসু, চিত্ত দাস প্রমুখ যোগ্য শিক্ষকদের। ফলে ঠিক বুনিয়াদ তৈরি হয়। যা আজকাল বড়ই অভাব।

কলেজ থেকে বেরোনোর পরে, কাজের তাগিদে নিযুক্ত হন বিজ্ঞাপন জগতে। বড় বড় প্যাভিলিয়ন ডিজ়াইনিং-এ অত্যন্ত দক্ষতা অর্জন করেন। পরবর্তীতে ‘টিসিপি অ্যাডভারটাইজ়িং’-এর একজন স্থপতি হিসেবে বিজ্ঞাপন জগতের প্রশংসা কুড়িয়ে নেন। সফলতা সত্ত্বেও ছবির মূল চাহিদা থেকেই যায়। ফলে শুরু হয় আবার লাগাতার চর্চা।

একসময় অবয়বী ছবি আঁকলেও, ধীরে ধীরে নিসর্গের ভিতরে ডুবে যান। গ্রামীণ বাংলার মাটি, জলরাশি, জলবায়ু, বৃক্ষরাজি সমন্বয়ে প্রকৃতির বিশেষ বিশেষ রূপ ফুটিয়ে তোলেন। বর্ষা, হেমন্ত ও শীত-বসন্তের বর্ণ-বৈচিত্র‍ চোখ ও মনের কালিমা ধুয়ে দেয়। সুরের মোহময় ঐকতান সৃষ্টি হয়। একজন বিশুদ্ধ জলরঙের রূপকার হিসেবে, তাঁর কাজের স্টাইল বরাবরই আকৃষ্ট করে। যে কোনও অবস্থাতেই দ্রুত ভাবে তিনি কাজ করেন। কাগজের উপরে জলের পাতলা লেপন দিয়ে ছেড়ে দেন। সাময়িক বিরতির পরে, ফ্ল্যাট ব্রাশ দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় যান। এক টানে ছোট ছোট স্ট্রোকে তুলে ধরেন মানুষের ভঙ্গি। প্রায় এক লহমায় ফুটে ওঠে ছবি।

অতীতের দিকে তাকালে, ভারতীয় চিত্রশিল্পে বিশুদ্ধ জলরঙের স্থানিক চিত্র সে ভাবে দেখা যায় না। কোনও কাহিনি বা ঘটনার পরিবেশ অনুযায়ী তার আসা। যেমন ভারতীয় মিনিয়েচারধর্মী ছবির ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট। পরবর্তীতেও ঠাকুর পরিবার, নন্দলাল বসু বা পরম্পরাতে দেখা গেলেও, শুধুই স্থানচিত্র নিয়ে রচনা খুবই কম। পরবর্তীতে নিসর্গ-র প্রাধান্য নিয়ে কাজ করতে দেখা যায় বেশ কয়েকজন শিল্পীকে। তাঁর মধ্যে অন্যতম গোপাল ঘোষ, ইন্দ্র দুগার প্রমুখ। এই ধারাবাহিকতায় উল্লেখযোগ্য শিল্পী শ্যামল দত্ত রায়, গণেশ হালুই, রামলাল ধর প্রমুখ। সেই যোগ্যতার বিচারে বর্তমানে অন্যতম উত্তরসূরি শিল্পী বাদল পাল।

দূষণহীন প্রকৃতির মূর্ছনায় ছবির গতিময় প্রাণশক্তি অনুভব করা যায়। এককথায় ভূদৃশ্য নিয়ে সহজ, সরল শিল্পীর অভিযাত্রা, যে যাত্রার মূলধন ভারতীয় এবং ব্রিটিশ জলরঙের স্বচ্ছ নির্যাস। প্রদর্শনীতে স্বচ্ছ জলরং ছাড়া ছিল কিছু ওপেক স্টাইলের কাজ। এ ছাড়া অল্প ইমপ্যাস্টো নকশায় পার্শ্ববর্তিনীর অভিব্যক্তি। অয়েল বারের ঘর্ষণে সেখানে স্পষ্ট হয় উনিশ শতকের গরিমা।

৮৭ বছরে পা রেখেও, শিল্পী বাদল পালের প্রাণপ্রাচুর্য আজও জলরঙের মতোই সমুজ্জ্বল। আজও ভবিষ্যতের প্রেরণা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Paintings Artwork

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy