Advertisement
E-Paper

কথা রাখতে বিনা পারিশ্রমিকে গান গেয়েছিলেন প্রসূনদা

তিনি গাইতেন মনের সুখে, সুরের মাদকতায় বুঁদ হয়ে। ধ্রুপদী সঙ্গীতের পাশাপাশি রাগাশ্রয়ী বাংলা গানকে জনপ্রিয় করতে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। জানালেন অজয় চক্রবর্তীতিনি গাইতেন মনের সুখে, সুরের মাদকতায় বুঁদ হয়ে। ধ্রুপদী সঙ্গীতের পাশাপাশি রাগাশ্রয়ী বাংলা গানকে জনপ্রিয় করতে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। জানালেন অজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৭ ০৮:২০
পণ্ডিত প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়।

পণ্ডিত প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়।

উত্তমকুমারকে দেখতে বেশি ভাল ছিল না প্রসূনদাকে, সে কথা বলা কিন্তু সহজ নয়! প্রসূনদার কথা মনে করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নায়কতুল্য রূপবান অথচ মৃদুভাষী, শান্ত এক মানুষের ছবি। এমন অপূর্ব কণ্ঠ বাংলা গানে হয়তো কমই এসেছে। পণ্ডিত প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার গুরুভাই প্রসূনদা। আমরা দু’জনেই তো গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ছাত্র। যদিও একসঙ্গে গান শেখার সুযোগ কিন্তু কখনও হয়নি। কারণ তিনি গুরুজির প্রথম দিককার ছাত্র। এমন নমনীয়, সুমিষ্ট আবেগপ্রবণ অথচ অলঙ্করণে সমৃদ্ধ কণ্ঠস্বর শ্রোতাদের আচ্ছন্ন করে রাখত। ধ্রুপদী সঙ্গীতের পাশাপাশি রাগাশ্রয়ী বাংলা গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়িতে। সেই সময় ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ছায়াছবিতেও প্রসূনদার গান বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। হঠাৎ এক দিন লক্ষ করলাম, প্রসূনদা আর গুরুজির বাড়িতে আসছেন না। অনেকের কাছেই তাঁর খোঁজ নিতাম। কারণটা অবশ্য পরে জেনেছিলাম। গুরুজির কাছে তালিম নিলেও প্রসূনদার খুব ইচ্ছে ছিল যে, তিনি উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানের কাছে গান শেখেন। অথচ সে কথা তিনি গুরুজিকে বলতে পারছিলেন না। এমনই এক অবস্থায় প্রসূনদা গুরুজিকে না বলেই উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানের কাছে গান শিখতে শুরু করলেন। এতে গুরুজির খুব অভিমান হয়েছিল।

আসলে প্রসূনদা বরাবরই ছিলেন অন্তর্মুখী। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, পরে নিজে গিয়ে সে কথা গুরুজিকে বলবেন। কিন্তু কোনও ভাবে গুরুজি ব্যাপারটা জানতে পারেন। এর পরে সহজ-সরল প্রসূনদার মন দ্বন্দ্বে ভরে উঠেছিল। সে কথা প্রকাশ্যে বেশ কয়েক বার আমায় বলেছিলেন। প্রসূনদার মধ্যে ছিল এক শিশুসুলভ সরলতা। খান সাহেবের কাছে গান শিখতে চাইলে গুরুজি কখনওই আপত্তি করতেন না। বরং সানন্দে প্রসূনদাকে নিয়ে যেতেন খান সাহেবের কাছে। এমনই এক ঘটনায় গুরু-শিষ্যের মধুর সম্পর্ক যেন মান-অভিমানের মেঘে ঢেকে গিয়েছিল।

লোকমুখে অবশ্য শুনেছি, চন্দননগরে এক অনুষ্ঠানে প্রসূনদার গান শুনে খান সাহেবের ভাল লেগেছিল। পরে প্রসূনদার সঙ্গে মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিয়ের পর খান সাহেব মীরাদিকে বলেছিলেন, প্রসূনদা যদি তাঁর গান শিখতে চান তা হলে তিনি নিজে নাড়া বেঁধে গান শেখাবেন। ঠিক তেমনটাই হয়েছিল।

প্রসূনদাকে নিয়ে লিখতে বসে কত স্মৃতি, কত মুহূর্ত আজ ছবির মতো ভেসে উঠছে... গুরুজি হাতে ধরে প্রসূনদাকে তৈরি করেছিলেন। শিখিয়েছিলেন একশোর উপর রাগ। এর অবশ্য একটা কারণও ছিল। সে সময় অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর আপ গ্রেডেশন পাওয়া ছিল বেশ কঠিন। আপ গ্রেডেশন পেতে হলে কম করে একশোটা রাগ জানতে হতো। কলকাতায় ইন্ডিয়া রেডিয়োর আপ গ্রেডেশনের সেই ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম এস এন রতনজঙ্কার। তিনি প্রসূনদাকে রাগ-রাগিণী নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন। রেডিয়োর প্রথম অনুষ্ঠানে রাগ মূলতানি গেয়ে তিনি পেয়েছিলেন দশ টাকা।

প্রসূনদার কাছে আমি বেশ কিছু বন্দিশ শিখেছিলাম। একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে। সে সময় আমি প্রসূনদা–সহ মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র প্রমুখ শিল্পীর গান নকল করে গাইতাম। তখন গানের স্কুল সৌরভ-এ রামায়ণের রেকর্ডিং চলছে। একটা গান ছিল প্রসূনদার সঙ্গে। গানের মধ্যে ছিল কথোপকথন। রাবণের চরিত্রে প্রসূনদা আর রামের চরিত্রে আমি। রেকর্ডিংয়ের দিন তিনি কোনও কারণে অনুপস্থিত ছিলেন। তখন সৌরভ-এর কর্ণধার নমিতা চট্টোপাধ্যায় আমাকে বললেন, ‘‘ওটা তুমিই গেয়ে দাও।’’ আমিও সেই অংশটুকু হুবহু প্রসূনদার মতো করে গেয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পরই গুরুজি এসে সেই অংশটুকু শুনলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন প্রসূনকে তো দেখছি না। তখন নমিতাদি বললেন, ‘‘ওটা অজয় গেয়েছে।’’ এর পর যখন প্রসূনদা এসে অংশটা শুনলেন, কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ভায়া, এ অংশটা আমি কবে গাইলাম বলো তো? মনে পড়ছে না তো? তবে মন্দ হয়নি।’’ এর পর নমিতাদি বলেছিলেন, ‘‘কিছু দিন আগে আপনিই ওটা গেয়েছিলেন। আপনার মনে নেই?’’

প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম পটনায়, ১৯২৬ সালের ১৫ অগস্ট। বাবা সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বিল্ডিং কন্ট্রাক্টর। পটনায় সম্ভ্রান্ত এই প্রবাসী বাঙালি পরিবারে ছিল গানবাজনার চর্চা। ছোট থেকেই গানের প্রতি ছিল আকর্ষণ। তবে প্রসূনদার বাবা চাননি ছেলে গানকে পেশা হিসেবে বেছে নিক। গান গাওয়া ছাড়াও তিনি ভাল এস্রাজ এবং বাঁশি বাজাতেন। বিশেষ করে রেডিয়োর অনুষ্ঠানে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় এবং জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর গান শোনা কখনও বাদ পড়ত না। ১৯৪৬ সালে পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সঙ্গীত সম্মেলনে গান গেয়েছিলেন উস্তাদ ফৈয়াজ খান, বড়ে গুলাম আলি খান, ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, ডি ভি পালুস্কর প্রমুখ। এমনই এক অনুষ্ঠানে তিনি ডি ভি পালুস্করের সঙ্গে তানপুরায় বসেছিলেন। এঁদের প্রত্যেকের গান শুনে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, একদিন নিজেও মঞ্চে বসে গান গাইবেন। বাবার চোখ এড়িয়ে বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে মাঝেমধ্যেই যেতেন সারা রাতব্যাপী গানের জলসায়। তবে ঠিক ভোরের আগে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়তেন বৈঠকখানা বা রেডিয়ো ঘরে। বাবা ভাবতেন, ছেলে বোধহয় সারা রাত পড়াশোনা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এতটাই গান ভালবাসতেন তিনি। পটনায় থাকাকালীন রেডিয়ো শুনে শুনে বিলম্বিত খেয়াল গাইতে শিখেছিলেন তিনি।

বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও গানের প্রতি প্রসূনদার আকর্ষণ ক্রমেই বাড়তে থাকে। ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করে পটনা সায়েন্স কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল এমন নানা বিষয়ে ছিল তাঁর আগ্রহ। বি এসসি পড়াকালীন ঠিক করে ফেললেন, পড়াশোনা আর গান একসঙ্গে করা সম্ভব নয়। ১৯৪৬-এ মাত্র কুড়ি টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এলেন কলকাতায়। এ শহরে তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তাঁর বেশ কিছু আত্মীয়। সে সময় প্রসূনদা আশ্রয় নিয়েছিলেন বেহালায় দিদির কাছে। এর পর থাকতেন শিয়ালদহে একটি মেসবাড়িতে। সেখান থেকে কাছেই ডিক্সন লেনে গান শিখতে যেতেন।

কলকাতায় এসে তিনি প্রথম দেখা করেন প্রবাদপ্রতিম রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গে। প্রসূনদার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তিনি হীরু গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে পাঠালেন। এর পর হীরুবাবু প্রসূনদাকে যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। শুরু হয় প্রথামাফিক ধ্রুপদী সঙ্গীতচর্চা। তবে প্রসূনদার জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের। জ্ঞানবাবুই প্রসূনদার কথা মাথায় রেখে বেশ কিছু গান সৃষ্টি করেছিলেন। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষই তাঁকে ছবির জগতে নিয়ে আসেন নেপথ্য কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে। প্রথম কাজ করেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘যদুভট্ট’ ছবিতে। এর পর ‘আশা’, ‘ঢুলি’, ‘বসন্তবাহার’, ‘রাজদ্রোহী’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘বিলে নরেন’ ইত্যাদি ছবিতে নেপথ্য কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তাঁর অবদান স্মরণীয়।

মনে পড়ছে পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষের কাছে শোনা একটি ঘটনা। এক বর্ষার দিনে আকাশ কালো করে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। খানিক পরেই গোটা শহর জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল। প্রসূনদা মেসবাড়ির বারান্দায় একমনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে খালি গলায় গাইতে শুরু করলেন মিঞা কী মল্লার। মনে হচ্ছিল তিনি যেন ঈশ্বরের উদ্দেশে সেই গান নিবেদন করে গাইছিলেন।

১৯৫৭–য় তাঁর বিয়ে হয় মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দু’জনেই যেন ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। দেশের বিভিন্ন শহরে দু’জনে একসঙ্গে দ্বৈতসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। বিয়ের পর একদিন প্রসূনদা ৮ নম্বর দেবেন সেন লেনে শ্বশুরবাড়িতে রয়েছেন। হঠাৎ গভীর রাতে কে যেন বাড়ির দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ছিল। সে সময় কসবা অঞ্চলটা ছিল বেশ নিরিবিলি। সবাই ভেবেছিল বুঝি বাড়িতে ডাকাত পড়েছে! ভয়ে ভয়ে দরজা খুলতেই দেখা গেল, একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বেগম আখতার! তিনি প্রসূনদার গানের কথা শুনে সোজা বাড়িতেই চলে এসেছিলেন গান শুনতে। সেই মায়াবি রাতের গানের সুর বোধহয় ছড়িয়ে পড়েছিল নক্ষত্রলোকেও।

আজও মুগ্ধ শ্রোতাদের মুখে মুখে ঘুরেফিরে আসে প্রসূনদার অনুষ্ঠানের কত মন মাতানো স্মৃতি! একবার কলামন্দিরে আয়োজিত এক সঙ্গীত সম্মেলনে শিল্পীর তালিকায় ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত সব শিল্পী। সেখানে প্রসূনদাও ছিলেন শিল্পী-তালিকায়। তিনি মনে মনে ঠিক করে গিয়েছিলেন, মি়ঞা কী মল্লার গাইবেন। সম্মেলনের তৃতীয় দিনে ছিল তাঁর গান। সেখানে পৌঁছে প্রসূনদা শুনলেন, আগের দিন ভীমসেন যোশীও ওই রাগটি পরিবেশন করেছেন। তবু প্রসূনদা রাগটি বদলালেন না। একই রাগ গাইলেন। বাকিটা আজ ইতিহাস। শ্রোতারা সে দিন তাঁর গানের মধ্য দিয়ে এক স্বর্গীয় ভাবলোকে পৌঁছে গিয়েছিলেন।

মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ

ঠিক তেমনই প্রবীণদের মুখে শুনেছি, অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সের আসরে তিনি ওই মিঞা কী মল্লার গেয়ে সকলের নজর কেড়েছিলেন। বহু রাগের উপর বিভিন্ন বন্দিশ তৈরি করেছেন তিনি। তাঁর প্রথম বন্দিশ ‘নির্গুণ কে গুণ দেহো দাতা।’ জীবনের প্রথম দিকটা কেটেছিল পটনায়, তাই হিন্দি ভাষায় তাঁর আধিপত্য ছিল বেশি।

প্রসূনদার অনুষ্ঠানের কত স্মৃতি আজও ঘুরেফিরে আসে। এক বার খড়্গপুর আইআইটির একটি অনুষ্ঠানে শিল্পী-তালিকায় ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আমজাদ আলি খান, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে ভোর হয়ে গিয়েছে। সে দিনই হাওড়ার শিবপুরে একটি অনুষ্ঠানে প্রসূনদার গান গাওয়ার কথা ছিল। খড়্গপুরের অনুষ্ঠান শেষে প্রসূনদা যখন শিবপুরে পৌঁছলেন, ততক্ষণে অনুষ্ঠান শে‌ষ হয়ে গিয়েছে। প্রসূনদা এতে খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন এবং উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করেছিলেন পরে আরও একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে। উদ্যোক্তারা তাঁর কথায় তেমনটাই করায়, তাঁদের কথা রাখতে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে গান গেয়েছিলেন।

তেমনই তাঁর জীবনের শেষের দিকের একটি অনুষ্ঠানের কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ভবানীপুর সঙ্গীত সম্মিলনীর এক অনুষ্ঠানে তিনি গেয়েছিলেন শ্রী রাগ। সেখানে উপস্থিত হীরুবাবু আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, সে দিন তিনি অনুষ্ঠানে প্রত্যক্ষ ভাবে যেন শ্রী রাগের উপস্থিতি অনুভব করতে পেরেছিলেন।

তিনি নজরুলগীতিও ভাল গাইতেন। যদিও অনুষ্ঠানে সচরাচর গাইতেন না। একবার কাজী সব্যসাচী তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন কাজী সাহেবকে গান শোনাতে। কাজী নজরুলের সামনে বসে তিনি শুনিয়েছিলেন, ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয়’ গানটি। গান শুনে আবেগে আপ্লুত কাজী সাহেবের দু’চোখ থেকে
সে দিন দরদর করে জলের ধারা ঝরে পড়েছিল।

ডায়াবেটিস থাকায় প্রসূনদা মাঝে মাঝে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়তেন। একবার এক অনুষ্ঠানের আগে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ায় সকলেই ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো সে দিন আর গাইতে পারবেন না। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, জ্ঞান ফেরার পর তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। গান শেখাতেন সুরের মাদকতায় বুঁদ হয়ে। ছাত্রছাত্রীদের গলায় যতক্ষণ না রাগটি ঠিক ভাবে বসত, তিনি অনুশীলন করাতেন। গাইতে গাইতে যেন চলে যেতেন গানের গভীরে।

আজও তাঁর অভাবটা অনুভব করি নানা কারণে। কখনও আসানসোল, ডোমজুড়, কখনও বা বাগনানে তাঁর সঙ্গে অনুষ্ঠানে গিয়েছি। একবার হঠাৎ আমায় বললেন, ‘‘ভায়া, হারমোনিয়ামটা বাজাবে নাকি?’’ প্রসূনদা গান গাইতেন মনের সুখে, এক অনাবিল আনন্দে। আর সেই সুরের জাদুতে শ্রোতাদের মন তোলপাড় করার দক্ষতা ছিল তাঁর। গান শুনে হয়তো শ্রোতারা পেতেন এক স্বর্গীয় তৃপ্তি।

গুরুজি চলে যাওয়ার ঠিক এগারো মাস পর প্রসূনদাও চলে গেলেন ২২ মার্চ, ১৯৯৭। সেই শূন্যতা কখনওই পূর্ণ হওয়ার নয়।

অনুলিখন: বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

Prasun Banerjee Singer Vocalist Ajoy Chakrabarty প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy