উত্তর আধুনিক চিত্রকলা: কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যকলা বিভাগের প্রদর্শনী
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যকলা বিভাগে কোনও স্নাতক পর্যায়ের ব্যবস্থা নেই। এর ফলে এম এফ এ-র পড়ুয়াদের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ সেমেস্টারের প্রদর্শনীতে দেখা গেল, প্রায় সকলেই বিস্তীর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে, একটা কনসেপচুয়াল আর্টের ধারণাকে প্রশ্রয় দিয়ে কাজ করেছেন। এ ক্ষেত্রে সেই উত্তর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি যতটা না ফলপ্রসূ হয়েছে, অতি স্বাধীনতার মাধ্যমগত বিশ্লেষণে অনেকটাই ফাঁক থেকে গিয়েছে। বেশ কিছু শিল্প নির্মাণে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার থেকে কিছুটা সরে এসে তাকে যেমন ভাঙার চেষ্টা করেছেন শিল্পীরা, অন্য দিকে কম্পোজ়িশন ও মাধ্যমকে বুঝতেই চেষ্টা করেননি। কিন্তু সকলেরই উদ্দেশ্য ছিল নতুন বাঁকের দিকে এগোনোর। ভাবনাচিন্তার গভীরতার অভাব আর মূলত অতি স্বাধীনতার প্রকোপে প্রদর্শনীটি ঝকমকে হলেও তাই শেষরক্ষা হয়নি। অথচ তরুণ কিছু শিল্পশিক্ষক এই শিক্ষানবিশদের খুব যত্ন-সহকারেই ক্রমাগত শিক্ষাদান করেন। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে ওঁদের প্রদর্শনীটি শেষ হল সম্প্রতি। কয়েক জনের কাজে দুর্বলতা লক্ষ করা গেলেও সকলের কাজে তা হয়নি। এমনকী কয়েক জন তো বেশ ভাল কাজই করেছেন!
প্রদর্শনীর অন্যতম চমক শুধু মাত্র সাদা কাগজের লম্বা ছাটের গুচ্ছ দিয়ে মেঝের উপরে সবজে ক্যানভাসে সাজানো ‘আনটাইটেলড সিরিজ়’। অজস্র তরঙ্গস্রোতের মতোই কাগজের ভাঁজের লাবণ্য এক কম্পমান বিভ্রমের অনুভূতি দিচ্ছে। স্বল্পদৈর্ঘ্যের ভাস্কর্য-সুলভ উচ্চাবচ ও তার দ্রব্যগুণের আলো-আঁধারি এক নীরব ছন্দেরও আভাস দিচ্ছে। তাঁর ভাবনার এই রূপ দেওয়াটিই অন্য রকম। সব দিক থেকে চতুর্থ সেমেস্টারের কমলেশ মণ্ডলের এই কাজটি যথেষ্ট বাঙ্ময়।
পাতলা কাগজ অথবা নেপালি কাগজের নিচ থেকে ভেদ করে ওঠা ছোট্ট ছেঁড়া অজস্র সুতোর মতো ছড়ানো এক আবহ পটভূমির আকাশ ভরা শূন্যতাকে এবং নীচের পোড়া খয়েরি জমির দৈন্যকে একাকার করে দিচ্ছে। ঊর্ধ্বে উঠে থাকা সূক্ষ্মতার উপরে হালকা ঘষামাজার ফলে গোটা কাজটিতেই একটা বার্তা দিয়েছেন মৌমিতা কুণ্ডু। দিকচিহ্নহীন বিস্তৃত নির্জনতায় রুক্ষ টেক্সচারে ভরানো আপাত সাদা জমিতে একগুচ্ছ কালো ক্ষুদ্র ছাগল ও সামনে গজানো কিছু ঘাসে ঘেরা জায়গা নিয়ে ক্যানভাসে আর্থ কালার, পেন-ইঙ্ক-পেনসিলে অপূর্ব কাজ করেছেন মৃণ্ময় কর্মকার। স্পেসের অনেকখানি শূন্যতার জন্য ছবিটি এক নিবিড় অনুভূতি আনে।
মাউন্ট বোর্ডের সরু চিপস, সিমেন্ট দিয়ে ম্যাসোনাইট বোর্ডে ক’টি কাজ করেছেন শুভঙ্কর বণিক। ওঁর অনেক সুযোগ ছিল কম্পোজ়িশনকে সংগঠিত করার, কিন্তু তা করতে পারেননি।
প্রিন্ট নয়, কাঠের বুকে রুক্ষ এনগ্রেভিংয়ের উপরে কালো রঙের রোলার চালিয়ে ওই ব্লকটিকেই একটি কাজ হিসেবে তুলে এনেছেন গৌতম চক্রবর্তী। অন্য রকম চমৎকারিত্ব রয়েছে এই কাজটিতে।
বিভিন্ন ফর্মে কাঠকে পুড়িয়ে তাকে সামান্য কাটাছেঁড়া করে, অল্প রঙের ব্যবহার রেখে, ফুটো করে, আঁচড়ে, ঘষে এবং বিবর্ণ করে—নানা ভাবে কাঠের বিভিন্ন টুকরোকে বড় একটি কাঠের সমতলে পাশাপাশি বিন্যস্ত করে, ‘জার্নি অব লাইফ’কে এ ভাবেই প্রতিপন্ন করেছেন সুমনা সুর। ভাবনা চমৎকার, কিন্তু বিন্যাস ও অন্য মাধ্যম নিয়ে আর একটু চিন্তাভাবনার দরকার ছিল।
ক্যানভাসে টেক্সচার-হোয়াইট, ইঙ্ক এবং অ্যাক্রিলিকে দারুণ কম্পোজ়িশন করেছেন দ্বিতীয় সেমেস্টারের কৃষ্ণ রায়। এখানেও টেক্সচারের এক সাদা-কালো রুক্ষতায় লাল কনস্ট্রাকশনটি অত্যন্ত প্রাণবন্ত। সেখানে ঘষামাজার বৈপরীত্যে একটা ছন্দোময় অনুরণন এসেছে। ‘আনকমফর্টেবল সিচুয়েশন’ নামে হ্যান্ডমেড পেপারে মিশ্র মাধ্যমে স্পেস ট্রিটমেন্ট কম্পোজ়িশন টেকনিক ও অ্যারেঞ্জমেন্টকে গভীরতার সঙ্গে উপস্থাপন করে, সুমন পাত্র দর্শককে একটি স্টেটমেন্ট দিতে চেয়েছেন— এ হল নৈঃশব্দ্যেরই এক উন্মাদনা!
ইন্দ্রাণী পাল কাঠের রোলারে জড়ানো কাপড়ে আলঙ্কারিক কালো, লালচে, হলদেটে ফুলেল প্রিন্ট গোটানো অবস্থায় পরপর বিন্যস্ত করেছেন। যদিও সেখানে কৃষ্ণবর্ণের ডিজ়াইনের আধিক্য কিছু একঘেয়েমি এনে দিয়েছে, বৈপরীত্য থাকা সত্ত্বেও।
সত্যজিৎ দত্তের মিক্সড মিডিয়াটি আলো-অন্ধকারের নিহিত কাব্য যেন! রং এখানে স্বল্প হলেও রোম্যান্টিক আবহে উপস্থিত। চিন বা জাপানের স্ক্রোল পেন্টিংয়ের মতোই তিনটি ঝোলানো কাজে হালকা বর্ণে নির্জন কাব্যময়তার তরঙ্গকে যেন প্রস্ফুটিত করেছেন সুশান্ত মিস্ত্রি।
এ ছাড়া ভাল কাজ করেছেন জয়িতা ধাড়া, শেখ অভীক, শেফালি কর, গৌরব ধারা প্রমুখ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy