Advertisement
E-Paper

ঠাকুরমার ঝুলি

ভূত-পেতনি, দৈত্য-দানো। লালকমল, নীলকমল। সুয়োরানি, দুয়োরানি। আলিবাবা, আলাদিন...। গল্পের অন্ত ছিল না মা-ঠাকুরমাদের! পাতা উল্টোলেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্যগল্পের জন্ম নাকি স্বপ্নে। জেগে জেগে দেখা স্বপ্নে। আর স্বপ্নের জন্ম? তা নাকি গল্পে। রাতের বেলা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভাবা গল্পে। মনোবিজ্ঞানী বলবেন, দিনের গল্পগুলোই রাতে স্বপ্ন হয়ে ভেসে উঠবে। আর রাতের বেলাকার স্বপ্নিল, আপাত অলীক দৃশ্যেরা অপেক্ষায় থাকবে দিনের ঘটনায়, গল্পের ভাবনায়, কথার সত্যে রূপ নেবার। ফলে সব সাহিত্যই এক অর্থে, গূঢ় রূপকথা। জগতের এক সেরা রূপশিল্পী পিকাসো তাই বলতেন, ‘‘তুমি যা- কিছু কল্পনা করতে পারো তা-ই সত্যি।’’

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৫ ০০:০৩

গল্পের জন্ম নাকি স্বপ্নে। জেগে জেগে দেখা স্বপ্নে।
আর স্বপ্নের জন্ম?
তা নাকি গল্পে। রাতের বেলা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভাবা গল্পে।
মনোবিজ্ঞানী বলবেন, দিনের গল্পগুলোই রাতে স্বপ্ন হয়ে ভেসে উঠবে।
আর রাতের বেলাকার স্বপ্নিল, আপাত অলীক দৃশ্যেরা অপেক্ষায় থাকবে দিনের ঘটনায়, গল্পের ভাবনায়, কথার সত্যে রূপ নেবার।
ফলে সব সাহিত্যই এক অর্থে, গূঢ় রূপকথা। জগতের এক সেরা রূপশিল্পী পিকাসো তাই বলতেন, ‘‘তুমি যা- কিছু কল্পনা করতে পারো তা-ই সত্যি।’’
এই জেনেই আরেক স্বপ্নের কারবারি, জগতের প্রিয় কবি ইয়েটস গল্পকারদের প্রণোদনায় লিখলেন, ‘‘তাহলে চলো আমরা, গল্প বলিয়েরা, প্রাণে যা চায় নির্ভয়ে শুনিয়ে যাই। সব কিছু আছে, সব কিছু সত্যি, এই পৃথিবী পায়ের তলায় একটুকুন ধুলো মাত্র।’’
গল্প কী, রূপকথা কী, এসব কিছুই কি জানা ছিল ছেলেবেলায়? গরমের রাতে ছাদে ঢালা বিছানায় ভাইবোনেরা পাশাপাশি শুয়ে, আকাশের বাঁকা চাঁদ আর টিমটিমে তারা দেখতে দেখতে, মনোরমা মাসির যে-হাড় হিম করা গল্প শুনতাম তা দুনিয়ার যে-কোনও ভূতের গল্পের বাড়া।
এরকম একটা গল্প ছিল এক ভয়ানক খুনির। সে তার মা’কে বটি দিয়ে খুন করেছিল বলে তাকে চিড়িয়াখানার বাঘের খাঁচায় ফেলা হয়েছিল। তারপর সেই বাঘ যে কী করল তাকে নিয়ে মনোরমা মাসির সেই বর্ণনা মনে করলে আজও আমার মধ্যেকার সেই পাঁচ বছরের শিশুটি ফেরত আসে।

গল্পকে জোরালো করতে মনোরমা মাসি হালের কোন কাগজে ব্যাপারটা পড়েছে তাও বলত। আর এমন ভাবে শোনাত যেন নিজের চোখে দেখেছে। তাতে ফল হয়েছিল এই যে, মাসি ভাল-ভাল, মিষ্টি-মিষ্টি গল্প শুরু করলে আমরা সমস্বরে দাবি তুলতাম, ‘না না না, ভয়ের গল্প বলো’।

এর কিছু দিন পর কলকাতায় ছবি এল ‘অ্যান্ড্রোক্লেস অ্যান্ড দ্য লায়ন’। কাকার সঙ্গে সে ছবি দেখতে গিয়ে এক অদ্ভূত প্রতিক্রিয়া হল আমাদের। অ্যান্ড্রোক্লেসকে যখন সিংহের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়েছে আমরা সব্বাই তখন ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছি। ছবিতে কী হবে তা জানি না, আমরা মনোরমা মাসির গল্পের দৃশ্য মনে করে ভয়ে কাঠ!

আমি আরেকটা গল্প শোনার গল্প শুনিয়ে রূপকথার চর্চায় যাব। আমার মামাতো দাদার সম্বন্ধ করার জন্য ওপার বাংলা থেকে এক সুশ্রী, শিক্ষিতা পাত্রী আনা হয়েছিল, যে দিন তিনেক থেকেওছিল আমাদের বাড়িতে। তখন সন্ধে হলে সে দু’চারটে গল্প শোনাত আমাদের। তার মধ্যে একদিন শোনাল পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ ভয়ের গল্প ‘দ্য মাঙ্কিজ প’।

উফ্! সে অভিজ্ঞতা আর জীবনেও হয়েছে কিনা সন্দেহ। বাঁদরের অভিশপ্ত পাঞ্জা ধরে বাবা-মা ছেলেকে ফেরত চাইলেন আর দেখলেন তার গোটা শরীরটা একটা বড় চাকার মতো ঘুরতে ঘুরতে ঢুকে আসছে ঘরে!

ইংরেজি গল্প পড়ার বয়সে প্রথমেই খুঁজে নিয়েছিলাম ডবলিউ ডবলিউ জেকবস-এর ‘দ্য মাঙ্কিজ প’ গল্পটা। এবং টের পেলাম যে, শিশুকালে কারও মুখে শোনা ভূত বা ভয়ের গল্প বা রূপকথার স্বাদ বইয়ের ছাপানো পাতা পড়েও ফিরিয়ে আনা কষ্ট। আরও বড় হয়ে বুঝলাম শৈশবে দাদু-দিদা, মা-মাসি, খুড়োখুড়ি, কাজের লোকের কাছে রূপকথা শোনার আনন্দ, বিস্ময়, সোহাগ ও আবিষ্কার প্রথম প্রেম ও প্রথম চুম্বনের মতো স্থায়ী অনুভূতি।

কে জানে, আমাদের ছেলের যুগটা হয়তো বরপ্রাপ্ত ছিল তাই গল্প শোনানোর বয়স্কজনের দুর্ভিক্ষ পড়েনি; তাই শুনে, পড়ে বা বানিয়ে হোক, ছেলেপুলেদের রূপকথা শোনানো দিব্যি চালু। বাড়িতে বাড়িতে পাঁজি, গীতা, বাংলা ক্যালেন্ডারের মতোই থাকতে হবে একটা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ ও একটা ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’।

গল্প না জানা থাকলেও রেহাই নেই, পড়ে শোনাতে হবে ঠাকুমা’র ঝুলি থেকে ‘কাঁকনমালা কাঞ্চনমালা’, ‘নীলকমল আর লালকমল’, ‘সোনার কাটি রূপার কাটি’, ‘শিয়াল পন্ডিত’ বা ‘সাত ভাই চম্পা’-র গল্প। নয়তো ‘ঠাকুরদার ঝুলি’ থেকে ‘মধুমালা’, ‘মালঞ্চমালা’, ‘শঙ্খমালা’-র উপন্যাস।

রামায়ণ-মহাভারতের হাজার উপাখ্যানের মতো এসব কাহিনিও আমাদের না পড়েও জানা হয়ে যেত। পুঙ্খানুপুঙ্খ। তাই প্রথম বার রাজশেখর বসুর ‘মহাভারত’ বা দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঝুলি’ পাঠ আমাদের কাছে হত পুনর্পাঠের মতো।

অথচ সেই সুদূর অতীতে, ১৯০৭-এ, ‘ঠাকুরমা’র ঝুলি’-র ভূমিকা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বইটির ভূয়সী প্রশংসা করেও শেষ করেছেন বিলাপের সুরে: ‘‘এক্ষণে আমার প্রস্তাব এই যে, বাংলাদেশের আধুনিক দিদিমাদের জন্য অবিলম্বে একটা স্কুল খোলা হউক এবং দক্ষিণাবাবুর এই বইখানি অবলম্বন করিয়া শিশু-শয়ন-রাজ্যে তাঁহারা পুনর্বার তাঁহাদের নিজেদের গৌরবের স্থান অধিকার করিয়া বিরাজ করিতে থাকুন।’’

‘বিলাপের সুর’ কথাটা কিঞ্চিৎ কঠিন শোনালেও ব্যবহার করলাম কারণ এর কদিন মাত্র পরে তাঁর প্রিয় সন্তান, বালক শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ তার হাতে তুলে দেওয়ার সুযোগ হয়নি কবির।

‘বিলাপের সুর’ কথাটা ব্যবহারের আরেক কারণ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভূমিকার শুরুতেও এক আশঙ্কা করেছেন ‘‘এখনকার কালে ফেয়ারি টেলজ আমাদের ছেলেদের একমাত্র গতি হইয়া উঠিবার উপক্রম করিয়াছে। স্বদেশের দিদিমা কোম্পানী একেবারে দেউলে। তাঁহাদের ঝুলি ঝাড়া দিলে কোন কোন স্থলে মার্টিনের এথিকস্ এবং বার্কের ফরাসী বিপ্লবের নোটবই বাহির হইয়া পড়িতে পারে, কিন্তু কোথায় গেল—রাজপুত্র পাত্তরের পুত্র, কোথায় বেঙ্গমা-বেঙ্গমী, কোথায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের সাত রাজার ধন মাণিক।’’

রবীন্দ্রনাথের সেই সময়টাও কিছু কম জটিল নয়। স্ত্রীশিক্ষার বহর বেড়েছে, বইয়ে ন্যস্ত হতে গিয়ে মহিলাদের গল্প বলা তাকে চড়তে বসেছে। ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে দক্ষিণারঞ্জন মায়ের মুখের সব আশ্চর্য রূপকথা হুবহু মায়ের কথার ঢঙে কলমে এলে বাংলার রূপকথার এক নবজাগরণই ঘটালেন।

তাঁর নিবেদনে দক্ষিণারঞ্জন লিখছেন: ‘‘এক দিনের কথা মনে পড়ে, দেবালয়ে আরতির বাজনা বাজিয়া বাজিয়া থামিয়া গিয়াছে, মা’র আঁচলখানির উপর শুইয়া রূপকথা শুনিতেছিলাম। ...

সেই যেন কেমন—কতই সুন্দর! পড়ার বইখানি হাতে নিতে নিতে ঘুম পাইত; কিন্তু সেই রূপকথা তারপর তারপর তারপর করিয়া কত রাত জাগাইয়াছে! ...

বাঙ্গালার শ্যামপল্লীর কোনো কোণে এমনি আনন্দ ছিল, এমনি আবেশ ছিল। মা আমার অফুরান রূপকথা বলিতেন। জানিতেন বলিলে ভুল হয়, ঘরকন্নায় রূপকথা যেন জড়ানো ছিল; কিন্তু এত শীঘ্র সেই সোনা-রূপার কাটি কে নিল? আজ মনে হয় ঘরের শিশু তেমন করিয়ে জাগে না, তেমন করিয়া ঘুম পাড়ে না।’’

আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলল ‘ঠাকুমা’র ঝুলি’-র হীরকজয়ন্তী সংস্করণ হয়ে গেছে! বাষট্টি বছরে ষাট সংস্করণ। পাশাপাশি দক্ষিণারঞ্জনের অন্য সব কীর্তি—‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’, ‘ঠানদিদির থলে’, ‘দাদামশায়ের থলে’, ‘চিরদিনের রূপকথা’ ইত্যাদি—তো রয়েইছে। এই বিপুলসংখ্যক রূপকথা বাঙালি কিনেছে কেবল পড়ার আনন্দে নয়, পড়ে শোনানোর আবেগ ও তৃপ্তি থেকে।

বেডটাইম স্টোরিজের চল কোন বিলাত থেকে ধার করা কালচার নয়। যদিও ঘুম পাড়ানোর গল্পকথাকে লিখে বই করা বিলাতের প্রভাবে বললেও বলা যায়। যদিও আমিও এমন ঠাকুরমা (বাবার কাকিমা) পেয়েছি যিনি বইফইয়ের ধারই ধারতেন না। দিব্যি মন গড়া সব গল্পের পর গল্পের পর গল্প শুনিয়ে আমার রাতকে দিন, দিনকে রাত করে দিতেন।

ওঁর এমনই একটা গল্প ছিল এক ভূতকে নিয়ে যে রাতে বেরুতে ভয় পেত। আর দিনে তাকে কেউ দেখতে পায় না বলে তার কোনও বন্ধুটন্ধু ছিল না। তাই দিনের বেলায় সবার অলক্ষ্যে সে নায়েব মশাইয়ের হিসেবে গন্ডগোল পাকিয়ে দিত, জমিদারবাবুর কোমরে সুড়সুড়ি দিয়ে তাঁকে অস্থির করে মারত আর সভাগায়ক ওস্তাদ বজির মিঞা ভীমপলাশী গাইলেই তাতে হঠাৎ হঠাৎ ‘ভীম!’ ‘ভীম!’ ডাক ঘটিয়ে দিত।

তাতে জমিদার একদিন বলে বসলেন, ‘‘কী যন্ত্রণা, অযথা ভীম-ভীম কচ্চো কেন? ভীম দারোয়ানকে দিয়ে কী হবে? পালে কি বাঘ পড়েছে?’’

তাতে বিনীত ভাবে মাথা হেলিয়ে বজির মিঞা বললেন, ‘‘আজ্ঞে হুজুর, তাইলে আমি ‘বাঘেশ্রী’ খ্যাল গাই? ওটিতে বাঘ আসে না।’’

এই জমিদারবাবু স্বর্গে যাবার পরও মর্ত্য ছাড়তে পারেন না। পিছুটান একটাই—তাঁর খাজনাদার শ্যামাচরণের সাত সিকে খাজনা এখনও বাকি। অগত্যা ভূত হতে হল জমিদারকে।

চাঁদনি রাতে কুঁড়ে ঘরে শোওয়া শ্যামাচরণ দেখল তার খরের চাল এই খোলে, এই বন্ধ হয়। আর সমানে জমিদারবাবুর হেড়ে গলার বদলে নাকি সুরে চন্দ্রবিন্দু যোগে ডাক, ‘‘কী শ্যামাচরণ, খাজনা দিবি নে?’’

এই ভাবেই এক গল্প থেকে আরেক গল্পে। এক ভূত থেকে আরেক ভূতে চলে যেতেন ঠাকুরমা। আর অম্লান বদনে দাবি করতেন অন্ধকার রাতে তিনি চাইলেই ভূত দেখতে পান। বলতে বলতে জপের মালাটাও গুনতে থাকতেন। ডবলিউ ডবলিউ জেকবসের পাশাপাশি এই ঠাকুরমাও আমাকে নিজের অজান্তে ভূতের গল্পের জগতে উৎক্ষেপ করেছিলেন।

কত সহস্র ভয় ও ভূতের গল্প পড়া হল অ্যাদ্দিনে, কিন্তু কই সেভাবে তো জমিদারের ওই ডাক—‘কী শ্যামাচরণ, খাজনা দিবি নে? ফিরে এল না। ক্রমে বুঝেছি জগৎ জুড়ে এটাই হয়—গল্প অমর হয় বলায় ও শোনায়। সেই গল্পই লেখা হয়ে এক অন্য বলায় দাঁড়ায়।

সেই লিখিয়ে যদি ফরাসি রূপকথাকার শার্ল পেরো (১৬২৮-১৭০৩) হন তাহলে অমরত্ব পায় এমন সব গল্প জগদ্বাসী যা সেই থেকে পড়ে আসছে ‘সিন্ডারেলা’, ‘লিটল রেড রাইডিং হুড’, ‘টম থাম্ব’ কাহিনি বলে। সেই লিখিয়ে যদি হন জার্মান ভ্রাতৃদ্বয় ইয়াকব গ্রিম (১৭৮৫-১৮৬৩) ও ভিলহেলম গ্রিম (১৭৭৬-১৮৫৯), সংক্ষেপে গ্রিম ভায়েরা, তাহলে জগৎ বুকে ধরে পড়তে পায় ‘স্নো হোয়াইট’, ‘রাপুনজেল’, ‘রাম্পেলাস্টিল্টস্কিন’ এবং ‘দ্য গোল্ডেন গুজ’-এর মতো গল্প।

আর লিখিয়ে যদি হন ওলন্দাজ হান্স কৃশ্চন অ্যান্ডেরসেন (১৮০৫-১৮৭৫) তাহলে বিশ্ব পায় ‘দ্য লিটল মার্মেড’, ‘দ্য আগলি ডাকলি বা ‘দ্য টিন্ডার বক্স’।

একটা সময় বাঙালির বাড়িতে বাড়িতে কাঞ্চনমালা, মধুমালা, শঙ্খমালার গায়ে গায়ে জায়গা হল সিন্ডারেলা, রেড রাইডিং হুড, দ্য স্নো হোয়াইটের। মহাভারতের ভীমসেনের গায়ে টারজানের, ঘটোৎকচের গায়ে কিং কং-এর।

নিউক্লিয়াস ফ্যামিলিতে দাদু-দিদাদের জমানো বাতিল হয়ে গল্পবলা দাদু হল টিভি-ভিডিও। খুব কম জনাই টের পেলেন যে দাদু-দিদাহীন সংসার ছোটদের এক ধরনের নিঃশৈশব সৃষ্টি করে। তাদের কল্পনার ব্রহ্মাণ্ডকে সিনেমা বা কার্টুনের যান্ত্রিক চৌখুপিতে আঁট করে দেয়। তাদের মনোজগৎ বাঁধা পড়ে টিভি ও কম্পিউটারের বর্গক্ষেত্রে।

আমার বন্ধু, বিজ্ঞাপন কোম্পানির মালিক বাসুদেব মুখোপাধ্যায়ের বাবা ছিলেন এমন এক গল্পবলা দাদু। তিনি থাকতেন হাজারিবাগের জঙ্গলের ধারে নিজস্ব বাংলোতে। কলকাতায় এলে দুই ছেলের পুত্র ও কন্যাকে নিয়ে চলত তাঁর গল্পদাদুর আসর।

জঙ্গলের বাঘ-ভল্লুকের গল্প তো থাকতই। একদিন গপ্পো বানাতে বানাতে দেখি এক রিমোট কন্ট্রোল ডাস্টবিনের গপ্পে ঢুকে গেলেন। রিমোট দিয়ে ঝাড়ু চালিয়ে বাড়ির সব আবর্জনা নিয়ে ফেলা হয়েছে ডাস্টবিনে। কিংবা ডাস্টবিন নিজেই উড়ে এসে উঠিয়ে নিচ্ছে ময়লা।

অন্তত তিরিশ বছর আগেকার ঘটনা বলছি। তখন রিমোটের এতশত কেরামতি ছিল না। তার চেয়ে আশ্চর্যের যে দাদুর নাতিটি অবলীলায় ডাস্টবিনের অ্যাক্টিভিটি নিজের কল্পনা দিয়ে বাড়িয়ে বাড়িয়ে এক অদ্ভূত ইন্টারাক্টিভ স্টোরিবিল্ডিং-এ নিয়ে গেল। আমি ও আমার গিন্নি তো শুনতে শুনতে থ। গল্পের খেলা যেন ক্রমশ বিজ্ঞানে পৌঁছে যাচ্ছে!

বাবার এই গল্পের ক্ষমতা পেয়েছে বাসুদেবও। ওর জীবনেও অশরীরী ঘটনার যোগ ঘটেছে বার কয়েক। হাজারিবাগ, দার্জিলিঙের প্লান্টার্স ক্লাব এবং একবার এক মড়া পোড়াতে গিয়ে এন্টালির ছাতুবাবুর বাজার পেরিয়ে রেললাইনের বাঁকে। অন্য কারও মুখে শুনলে আজগুবি বলে ঝেড়ে ফেলতাম। কিন্তু বাসুদেব তীক্ষ্ণ মেধার বুদ্ধিজীবী এবং সত্যভাষী।

ওর মুখে ওই বিদেহী আত্মার বৃত্তান্ত শুনেছি। আমার সেই শৈশবের বিস্ময়ে। কারণ ওই বলার মধ্যে একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরির ভাষা কাজ করত। ছিমছাম, ডিটেলে সাজানো, সত্যকার ঘটনা রিপোর্ট করার দগদগে শব্দে ধরা। কিছুটা সত্যজিৎ রায়, কিছুটা এম আর জেমস-এর ভূতের গল্পের ভাষা।

বন্ধুকে নিয়ে বলার এটাই কারণ যে, এই ট্র্যাডিশন আর সমানে চলছে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যে-রূপকাহিনির রুপালি সেতুটি দীর্ঘকাল প্রসারিত ছিল, আজ তা সঙ্কুচিত হতে হতে নিজেই প্রায় রূপকথায় দাঁড়িয়েছে।

টিভি এবং হলিউডের দাক্ষিণ্যে আজকের রূপকথার নায়ক সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যান, হ্যারি পটার। আজকের বিশিষ্ট ইংরেজি কাগজের প্রথম পাতার লিড নিউজের শোল্ডার হেডিং-এও দেখলাম হ্যারি পটার কাহিনিমালার চরিত্র ভলডেমর্টের নাম! দিন যে কখন বদলে গেছে বয়স্করা টের পাননি। নবীনরা যেমন জানতে পারেনি কী তারা পায়নি।

লোককাহিনি ও রূপকথার মস্ত গবেষক ও সংগ্রাহক জেমস রায়োর্ডান-এর শৈশব ও বাল্য কেটেছিল দারিদ্রে ও ক্ষুধার তাড়নায়। হ্যামলিন প্রকাশনার জন্য তাঁর বন্দিত ফোক ও ফেরি টেলজ সংগ্রহের ভূমিকায় তিনি কিন্তু লিখছেন সেই দারিদ্র ও অনাহার তিনি টের পাননি। কারণ, লোককথা ও রূপকথার সব আশার বাণী, ভরসার ছবি, সব খিদে, সব কষ্ট কাটিয়ে দিয়েছে। বলছেন, খেয়ে পরে দিব্যি আছি, অথচ জীবনে গল্প নেই এ তো ভাবতেই পারি না।

রায়োর্ডান-এর কথায় মনে এল বয়স নির্বিশেষে এই আধুনিক যুগের এক প্রিয়, সেরা লেখকের কথা। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। ওঁকে নিয়ে লেখা বইয়ে ওঁকে প্রশ্ন করেছিলেন বন্ধু প্লিনিও আপুলেয়ো মেন্দোজা: আচ্ছা, বলতে পারো তোমার লেখকজীবনের প্রস্তুতিপর্বে সব চেয়ে বড় কাজে এসেছেন কে?

মার্কেজের উত্তর ছিল: ‘‘প্রথম, এবং সব চেয়ে বেশি, আমার ঠাকুরমা। কপাল থেকে একটা চুলও না সরিয়ে তিনি আমাকে নৃশংস, ভয়াবহ সব ঘটনার গল্প শোনাতেন। আর এমন ভাবে যেন এই মাত্র দেখেছেন। আমি বুঝেছিলাম যে ওঁর ওই নিরুদ্বেগ কথন এবং দৃশ্যকল্পের ভাণ্ডারই ওঁর গল্পগুলোকে অত বিশ্বাসযোগ্য করে তুলত। আমি ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড’ লিখেছিলাম ঠাকুরমার ওই কথনভঙ্গিতে।’’

আর নিজের ভেতরেও যে একটা লেখক আছেন সেটা বুঝলেন কবে? মার্কেজ বলছেন, ‘‘কাফকার গল্পসংগ্রহ ‘মেটামর্ফোসিস’ পড়ে।

যখন প়ড়লাম এক সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর সামসা দেখছে, সে এক মস্তকায় গুবরে পোকায় পরিণত হয়েছে। আমি নিজেকে বললাম, ‘ওহে, তুমি এ সব পারবে কি না জানি না। তবে যদি পারো তা হলে আমি লেখালেখিতে আছি।’’

আগের দিনের গল্পবলিয়েদের অভাবে যতই আহা! উহু! করি না কেন মেনে নিতেই হবে আজকের দিনের গল্প বলিয়ে হচ্ছেন লেখকরা। মার্কেজের ঠাকুরমা ছিলেন, আমাদের আছেন মার্কেজ। তবু প্রশ্ন ওঠে, আছেন কি?

সে ভাবে থাকলে হয়তো মার্কেজ বা ইতালো কালভিনো পড়েও সাবেক রূপকথাকারদের খোঁজে বেরুতেন অনেকে। এই রকম ভাবেই গল্পকথা, স্বপ্ন, শিকড় ও অতীতের খোঁজে বেরিয়ে এক অপূর্ব বই লিখেছিলেন কালভিনো— ‘আওয়ার অ্যানসেস্টার্স’। আমাদের পূর্বপুরুষ।

এই রচনা লেখার আগে কালভিনোর বইটা নামিয়ে পড়ছিলাম। তিনটি আধা-কাল্পনিক, উপকথা ভিত্তিক সুদূর অতীতের চরিত্র নিয়ে কী তিনটি উপন্যাসই না ফেঁদেছেন ভদ্রলোক! যেখানে রূপকথা ও ইতালির ইতিহাস, ভূগোল মিলেমিশে একাকার। এই কাজে, কালভিনো গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন, তাঁর মডেল ছিলেন রবার্ট লুই স্টিভেনসন। যাঁর গল্প ধরনের মধ্যেই রূপকথার আবেশ।

আমরাও জানি বা না-জানি আমাদের আহ্লাদের কথার মধ্যে এখনও রূপকথা। যেমন ধরা যাক, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র ‘কলাবতী রাজকন্যা’র গোড়াপত্তন:

‘‘এক যে রাজা। রাজার সাত রাণী। বড় রাণী, মেজ রাণী, সেজ রাণী, ন-রাণী, কনে রাণী, দুয়ো রাণী আর ছোট রাণী।

রাজার মস্ত বড় রাজ্য; প্রকাণ্ড রাজবাড়ী। হাতীশালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া, ভাণ্ডারে মানিক, কুঠীভরা মোহর, রাজার সব ছিল। এ ছাড়া— মন্ত্রী, অমাত্য, সিপাই, লস্করে রাজপুরী গমগম করিত।

কিন্তু রাজার মনে সুখ ছিল না। সাত রাণী, এক রাণীরও সন্তান হইল না। রাজা, রাজ্যের সকলে, মনের দুঃখে দিন কাটান।’’

ব্যস, একটা রূপকথায় ভেসে যাওয়ার জন্য আর কী চাই? বাংলার সব গল্পবলিয়েদের গল্প শুরুর সহজ ‘উঠান’। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলছেন, ‘সমস্ত বাংলাদেশের চিরন্তন স্নেহের সুরটি’— এ তো সেই সুর।

কিংবা ধরা যাক ‘ডালিম কুমার’ গল্পের অন্ধ রাজকুমারের বৃত্তান্ত। দক্ষিণারঞ্জন লিখছেন:

‘‘অন্ধ রাজকুমারকে পিঠে করিয়া পক্ষিরাজ ঝড়-বৃষ্টি অন্ধকারে শূন্যের উপর দিয়া ছুটিতে ছুটিতে— হাতের রাশ হারাইয়া রাজকুমার কখন কোথায় পড়িয়া গেলেন। পক্ষিরাজ এক পাহাড়ের উপরে পড়িয়া পাথর হইয়া রহিল।

রাজকুমার যেখানে পড়িলেন সে এক নগর!’’

কিংবা ধরা যাক, ‘নীলকমল লালকমল’-এর গল্প। ...

‘‘নীলকমল লালকমল আপন সিপাই দিয়া বুকে খিল পিঠে খিল রাজার দেশে রাক্ষসের মাথা পাঠাইয়া দিলেন।

‘ও-মা!!’— মাথা দেখিয়াই রাণী নিজ মূর্তি ধারণ করিল—

‘করম্ খাম্ গরম খাম্!

মুড়মুড়িয়ে হাড্ডি খাম্!

হম্ ধম্ ধম্ চিতার আগুন

তবে বুকের জ্বালা যাম্!!’

বলিয়া রাক্ষসী–রাণী বিকটমূর্তি ধরিয়া ছুটিতে ছুটিতে নীলকমল লালকমলের রাজ্যে গিয়া উপস্থিত হইল।’’

এক শিশুর নিজের কল্পনায় ভর করে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে যেতে কতক্ষণ। বন্ধুত্ব করতে কতক্ষণ লাগে সাত ভাই চম্পা আর পারুল বোনের সঙ্গে? বেঙ্গমা-বেঙ্গমী, চ্যাং-ব্যাং, শিয়াল পণ্ডিত, সুখু আর দুখু বা সাড়ে সাত চোরের সঙ্গে?

বাঙালি শিশুর এই তো শিশু থাকা এবং বড় হওয়া। পৃথিবীর সব মানুষই তো শৈশবে এক, বয়সে বয়সে ভিন্ন। পৃথিবীর লোককথায় এক, শহুরে কথায় ভিন্ন।

ফিরে আসুক দাদু-দিদার গল্পের আসর। বাঙালি একটু বাঙালি হোক না!

অলংকরণ: সুব্রত চৌধুরী

abpnewsletters story grandmother kolkata mahabharata sindarela shankarlal bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy