Advertisement
E-Paper

অনাঘ্রাতা এক পাহাড়ি

উত্তরাখণ্ডের হরসিল। শিল্পীর ক্যানভাসের মতোই সুন্দর সে.... হরসিলের সঙ্গে পরিচয়টা কিন্তু হঠাৎই। দেহরাদূন থেকে গন্তব্য ছিল গঙ্গোত্রী। কিন্তু গাড়ির টায়ারটা মাঝপথে বিগড়ে গেল। উত্তরকাশীতে দু’ঘণ্টা লেট। ওখান থেকে গঙ্গোত্রী অনেকটা পথ, প্রায় ১০০ কিলোমিটার।

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৮ ০৯:৩০
ছবিই কথা বলে! হরসিলে

ছবিই কথা বলে! হরসিলে

কুয়াশার চাদর সরিয়ে মাথার উপর পুরু বরফে ঢাকা উদ্ধত হিমালয় আর নীচে প্রমত্ত পান্না-সবুজ ভাগীরথী। দুইয়ের মাঝে সারি সারি আপেল বাগান। ঘুমজড়ানো চোখে যখন প্রথম দেখলাম এই রূপ, ঠিক যেমনটা হয় প্রথম প্রেমে পড়লে, হুবহু একই অনুভূতি! অদ্ভুত ভাললাগার শিহরন। চারিদিকে সম্মোহনের আহ্বান। সমর্পণের ইশারা। উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়ালে হরসিলও যেন ছিল এমনই, প্রথম প্রেমের মতোই... তার পর যখন জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা রঙের আপেলগুলো থেকে পা বাঁচিয়ে আরও এগোলাম, আর একটি মোহময়তার সন্ধান। গাড়ির কাচ ঢেকে গিয়েছে পাতলা বরফের আস্তরণে, রাতের শিশির জমে বরফ... সব প্রেমের গল্পেই একটা ভূমিকা থাকে। এখানেও তাই...

হরসিলের সঙ্গে পরিচয়টা কিন্তু হঠাৎই। দেহরাদূন থেকে গন্তব্য ছিল গঙ্গোত্রী। কিন্তু গাড়ির টায়ারটা মাঝপথে বিগড়ে গেল। উত্তরকাশীতে দু’ঘণ্টা লেট। ওখান থেকে গঙ্গোত্রী অনেকটা পথ, প্রায় ১০০ কিলোমিটার। সন্ধে নেমে আসায় পাহাড়ি রাস্তায় আমাদের গাড়ির ড্রাইভারের ভরসা ছিল না অত দূর পথ পাড়ির। তাই মাঝপথে ২৫ কিলোমিটার আগেই থামতে হয়েছিল হরসিলে। জায়গাটির সম্পর্কে ছিল না কোনও আগাম আভাস। কয়েকটি টুরিস্ট বাংলো, হোম স্টে নিয়ে ছোট্ট পটে আঁকা পাহাড়ি গ্রাম। এ যেন প্রকৃতির লুকোনো রত্ন। নির্জন, শুনশান হরসিল এখনও ভ্রমণ মানচিত্রে চেনা নাম নয়। এমন এক অনাঘ্রাতা পাহাড়ি গ্রামে পথশ্রান্ত পর্যটক প্রথম প্রেমের আস্বাদ খুঁজে পাবেন! এটাই প্রতিশ্রুতি। আমিও পেয়েছিলাম। গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের টুরিস্ট বাংলো বেছে নিয়েছিলাম সে রাতের আস্তানায়।

ভাগীরথী সঙ্গী হয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু গঙ্গোত্রী না গিয়ে ফেলে আসা পাকদণ্ডি ছেড়ে গ্রানাইটের ঢালে নামতেই এক অন্য জগৎ। দু’পাশে জঙ্গলে মোড়া পথে নিকষ কালো অন্ধকার কী ভাবে যেন জড়িয়ে গেল! গাড়ির হেডলাইট ছাড়া আর কোনও আলো নেই। এমন পথে নাকি দেখা মেলে ভল্লুকের! কিন্তু বিশ্বাস বা চোখের দেখা কোনওটাই হয়নি বলে এই রোমাঞ্চকর পথটুকু উপভোগের সময় ছিল সীমিত। সেতু পেরিয়ে ও পারে ছোট ছোট আলোর রেখা ফুটতেই বুঝলাম, পৌঁছেছি হরসিলে। কিন্তু অল্প আলোমাখা সেই মায়াবী রাতে হরসিলের সঙ্গে আলাপের সুযোগ হয়নি। গরম রুটি আর ডিম তরকা খেতেই ক্লান্তিতে দু’চোখের পাতা এক হয়ে এল।

ভোরের হিমালয়

আলোর আবছা রেখা আর কুলকুল শব্দে ঘুম ভাঙল। ঘুমজড়ানো চোখে টুরিস্ট বাংলোর বারান্দায় এসেই সে এক অনন্য অনুভূতি। এক অবাক আবাহন! যার কথা বলেছিলাম শুরুতেই। কুয়াশার চাদর সরিয়ে প্রথম আলোর চরণধ্বনি হিমালয়ের শিরে... তার পর দেখি, গাড়ির কাচে গরম জল ঢালছেন আমাদের ড্রাইভার। শিশির জমা বরফ গলানোর আপ্রাণ চেষ্টা। আমাদের যে তাড়া আছে, পরের গন্তব্য গঙ্গোত্রী। কিন্তু না! পুরনো প্রেম ঢাকা পড়ে গেল নব কলেবরে। অল্প চেনাতেই হরসিলের প্রতি এতটাই ভাললাগা মিশে গিয়েছিল যে, ঠিক করেছিলাম পুরোপুরি না চিনে ফিরব না! তাই সে রাতটাও উত্তরাখণ্ডের এই ছোট্ট গ্রামেই রয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলি। খুঁজে বেড়াই গভীরে গভীরে। আর সেও সম্মোহনের যাবতীয় উপকরণই প্রস্তুত রেখেছিল এমন পথভোলা পর্যটকের জন্য। পাহাড়ি পথে বাঁকে বাঁকে আপেল বাগান, পাইন ও দেওদার বন, ঝোরা... কী নেই! চিকন পাতায় গলে গলে পড়ছে মেঘছেঁড়া রোদ। পথের মাঝে মাঝে বিশ্রামের ব্যবস্থাও। স্থানীয়দের কাছেই জানতে পারলাম, রাজ কপূরের ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’র শুটিং হয়েছিল এখানেই। সেই শুটিংয়ের গল্পের স্বাদ অনেকের কাছে আজও টাটকা। উৎসুক হতেই চললাম পায়ে হাঁটা পথে মন্দাকিনী ঝোরায়। এই ঝোরাতেই ‘রাম তেরি...’ ছবির সেই বিখ্যাত দৃশ্য, মন্দাকিনীর স্নানের শুটিং হয়েছিল। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে ছোট ছোট বাড়িঘর পেরিয়ে যখন পৌঁছলাম সেখানে, নিজেকে থামাতে পারিনি আর। মন্দাকিনী ঝোরায় ছিল হরসিলের প্রতি সমর্পণের জলকেলি!

পাহাড়ি গ্রাম

হরসিল থেকে মাত্র ছ’কিমি দূরেই রয়েছে আর একটি ছবির মতো গ্রাম, ধারালি। আপেল ও রাজমার খেত, পাহাড়ি ঝর্না, পাইনের বন মিলিয়ে এটিও হতে পারে কিছুক্ষণের আরামের আবাস।

আপেলের বাগিচা

পরদিন ভোর ভোর হরসিল ছেড়ে রওনা দিলাম গঙ্গোত্রীর পথে। আবার পাহাড়ের চড়াই-উতরাই ভেঙে এগিয়ে চলা। গাড়ির ঘষা কাচে চোখ রেখে অনেক নীচে নির্বাক হরসিল!

সামনে আপেলের চারাগাছ আর ভাগীরথী

কিন্তু এ তো পুরোপুরি ছেড়ে যাওয়া নয়! সঙ্গে ছিল পূর্ণতার প্রাপ্তিও। তৃপ্তি জুড়ে ছিল পরতে পরতে। আর প্রশান্তিও। এই ভাষা কি পড়তে পেরেছিল সে! পথশ্রান্ত পথিককে যে পূর্ণতার আস্বাদ দিয়েছিল হরসিল, তাকে এখনও মনে পড়ে যায়।

ঈপ্সিতা বসু

জেনে রাখুন

•এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস

•নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি বরফে মুড়ে থাকে। তখন থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা পেতে অসুবিধে হতে পারে
•এখানে থাকার জন্য দু’দিনই যথেষ্ট
•কাছাকাছি রেলওয়ে স্টেশন দেহরাদূন। সেখান থেকে গঙ্গোত্রীর পথে হরসিলের দূরত্ব প্রায় ২১৭ কিমি

Travel Blog Harsil Uttarakhand
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy