Advertisement
E-Paper

ঝিল পাহাড়ের দেশ, হাফলং

শহরের মাঝখানে প্রকাণ্ড লেক, আকাশছোঁয়া সবুজ পাহাড়ের মাথায় বুড়ো চার্চ... এই সব নিয়েই যেন তৈরি হয়েছে অসমের এক স্বর্গরাজ্যশহরের মাঝখানে প্রকাণ্ড লেক, আকাশছোঁয়া সবুজ পাহাড়ের মাথায় বুড়ো চার্চ... এই সব নিয়েই যেন তৈরি হয়েছে অসমের এক স্বর্গরাজ্য

অনির্বাণ রায়

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৮ ০৯:২০
রেলপথে হাফলং

রেলপথে হাফলং

গোঁফ দিয়ে মানুষ চেনা যায়, সুকুমার রায় বলেছিলেন। কিন্তু জায়গা চেনা যায় কী দিয়ে? রসিকজনেরা বলেন খাবার দিয়ে। বেনারসের পান, দিল্লির লাড্ডু, লখনউয়ের বিরিয়ানি... আমিও অসমের হাফলংকে চিনেছি পোলাও দিয়ে। থুড়ি আন্ডা পোলাও দিয়ে। বরাক নদীর উপত্যকার এই পাহাড়ি শহরের কুলগোত্র যা-ই টেনে আনা হোক না কেন, আমার কাছে পোলাওই সেই জনপদের প্রথম আকর্ষণ।

এক সময়ে মিটার গেজ লাইন ছিল। পাহাড়ের কোল দিয়ে ৩৬টি গুহা পার হয়ে সর্পিল গতিতে ছুটত ট্রেন। বছর দুয়েক হল ছোট লাইন বড় হয়েছে। ব্রড গেজে লাইন বসায় নতুন স্টেশনও হয়েছে। নিউ হাফলং। সেই স্টেশনে নামতেই চোখের আরাম শুরু, সঙ্গে বিস্ময়ও। বিস্ময় অবশ্য শুরু হয়েছিল ঘণ্টাখানেক আগেই। লামডিং স্টেশনে দেখেছি ট্রেনের দু’দিকে দুটো করে ইঞ্জিন জোড়া হবে। চারটে ইঞ্জিন টেনে নিয়ে যাবে একটি মাত্র ট্রেনকে! লামডিঙে কর্মরত রেলের এক কর্তা জানালেন, পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে ট্রেনের কামরা টেনে তোলা একটি ইঞ্জিনের কম্মো নয়। সে কারণে চারটে ইঞ্জিন। বিস্মিত হলাম, খাড়া পাহাড় শুনে পুলকিতও।

তখনও বিরহী যক্ষ দূতরূপী মেঘ রওনা করাননি। আষাঢ় তখনও মাসখানেকের দেরি। প্রখর গ্রীষ্মে চরাচর ফ্রিজ-শীতল জলের আরাম খুঁজছে। ভাবলাম, উঁচু পাহাড়ে ঠান্ডা নিশ্চয়ই হবে। তবে এ যে দৃশ্য দেখি অন্য! হাফলঙে পৌঁছনোর আগে আগে তাপমাত্রা কমল। হোয়াট্সঅ্যাপে বার্তা আসছে কলকাতার সঙ্গে শিলিগুড়ির পাল্লা দিয়ে তাপমাত্রার প্রতিযোগিতা। কিন্তু হাফলঙে তখন মাত্র ১৫।

হাফলং ঝিল

স্টেশনে নামতেই দেখলাম সার দিয়ে পাহাড়ি মহিলাদের ভিড়। কোনও একটি স্টেশনে সারি সারি দোকানে একই খাবার বিক্রি হচ্ছে। এমনটা আগে দেখিনি, যেমন দেখলাম নিউ হাফলঙে। চোখ জুড়িয়ে গেল। সকলের সামনে থার্মোকলের বাটিতে পোলাও, সঙ্গে ডিম। কোথাও সিদ্ধ, কোথাও আবার লালচে ডিমের সারা শরীরে পেঁয়াজের মাখামাখি। নাম আন্ডা পোলাও। কবিগুরুর পেটেন্ট নিয়ে যেমন লড়াই নেই, তেমনই পোলাও-এর আঁতুড় নিয়েও কোনও সংশয় নেই বলেই জানতাম। বাঙালির ছেলেবেলায় পদিপিসির বর্মিবাক্সে যদি কোনও খাবার লুকোনো থেকে থাকত, তবে নির্ঘাৎ ইলিশ মাছ ভাজার তেল আর আমাদের বাসন্তী পোলাও-ই হত। বড়দের বলতে শুনেছি, “তোর চোখে ন্যাবা হয়েছে।” ন্যাবা মানে জন্ডিস। পুরো শরীর পীতবর্ণের হয়ে যায়। এক ফিচেল বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম, “হোক না ন্যাবা। সে তো হলুদ রঙেরই, আমার প্রিয় পোলাওয়ের রং।”

শহরের আকাশে

ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফুট। আমাদের কার্শিয়াংয়ের থেকে কিছুটা নীচে। ব্রিটিশরা মিটার গেজ লাইন তৈরি করেছিল, কিছু দিন আগে ভারতীয় সেনা নতুন স্টেশন তৈরি করে দিয়েছে। স্টেশন থেকে চড়াই শুরু। ন্যাড়া রাস্তা। ছোটবেলায় দেখা মা-ঠাকুমার হাত থেকে উলের বল গড়িয়ে গেলে যে রকম পেঁচিয়ে যেত, রাস্তা ঠিক তেমনই। তবে রাস্তার দিকে চোখ কমই গেল। চার দিকে তখন উঁচু উঁচু পাহাড়ের চুড়ো। পুরোটাই সবুজ। নীল আকাশকে যেন ফুঁড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে গাছগাছালি ভরা পাহাড়। কিছু কিছু জায়গায় সবুজ নেই। খয়েরি রঙের পাথর বেরিয়ে গিয়েছে। পাথর দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে জলের ধারা। অবিরাম, যেন কোনও তাড়া নেই। ব্যস্ততা নেই শহরটারও। শহরের মাঝখানে প্রকাণ্ড এক লেক। কিন্তু কী অদ্ভুত শান্ত! ঝিলের জলে ভেসে বেড়াচ্ছে রুই মাছের ছানাপোনারা। শ্যাওলা, পোকা খেতে অভ্যস্ত মুখ, হাত থেকে মুড়ি বা চিপস পড়ে গেলে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছের দল হাজির।

ঝিল ভাগ করেছে শহরটিকে। এ পার থেকে ও পার যাওয়ার জন্য তৈরি একটি ছোট্ট সেতু। একটি গামলা উল্টে দিলে যেমন আকার হবে, সেতুটিও তেমনই। সেতুর মধ্যে দাঁড়িয়ে কয়েক জন তরুণী নিজস্বী তুলতে ব্যস্ত। মুখে মঙ্গোলিয়ান ছাপ। অসমেরই বাসিন্দা। পর্যটক বলতে পাশের কোনও শহর থেকে ছুটি কাটাতে আসা দম্পতি অথবা ছেলে-ছোকরার দল। পেশাদারি পর্যটন চালু হয়নি। ভাগ্যিস হয়নি! না হলে শান্তিটুকু তলিয়ে যেত বরাক নদীর গভীরে। ঝিলের উল্টো দিকে বটানিক্যাল গার্ডেন। পাহাড়ি পাকদণ্ডি পথে কিছুটা উঠে একটি বুড়ো চার্চ। এই শহরের সব কিছু জানে চার্চটি। জানে এক সময়ে নানা অশান্তিতে অসম যখন উত্তাল ছিল, তখনও বিকেলে ঝিলের ধারে স্থানীয়রা বসে আড্ডা দিতেন, এখনও যেমন দেন।

যে কোনও কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পড়ুয়াকে পাহাড়ি শহর বললে যেমন বাড়ি-ঘর পাহাড় এঁকে দেবে, হাফল‌ং তেমনই। এই জনপদের কোলেই রয়েছে জাটিঙ্গা। জঙ্গলমহল বলা যেতে পারে। শীতকালে আগুন পোহানোর জন্য আদিবাসীরা আগুন জ্বালায়, সেই আগুনে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা এসে ঝাঁপ দেয়। প্রতি শীতে অসম সরকার মেলার আয়োজন করে। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা আসেন। সে সময়েই যা ভিড় হয় হাফলংয়ের গোনাগুনতি হোটেলে।

সবুজে ঢাকা পাহাড়-শহর

দু’ দিনের অলস ছুটির পরে নিউ হাফলং স্টেশন থেকে ফের ট্রেনে উঠলাম। পোলাও আর ডিমভাজার সুগন্ধ সঙ্গে নিয়ে। আর স্মৃতিতে থাকল ঝিল পাড়ের বেঞ্চে, সবুজ মাঠের ঢালু জমিতে স্থানীয়দের অলস আড্ডার ছবি।

মনে প্রশ্নও জাগল, এই যে পোলাও-আড্ডা-শান্তিপ্রিয়তা শহরের গায়ে গায়ে জড়িয়ে, হাফলং কি আদতে বাঙালি? জনান্তিকে স্টেশনকে বলে রেখেছি, উত্তর খুঁজব পরের বার এসে, এই শহরের অলিগলিতে।

কীভাবে যাবেন

• শিয়ালদহ অথবা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস চড়ে সোজা নিউ হাফলং স্টেশনে পৌঁছনো যায়।

• রাজধানী অথবা অন্য যে কোনও ট্রেনে গুয়াহাটি স্টেশনে পৌঁছে শিলচর ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার ধরে সোজা পৌঁছে যেতে পারেন নিউ হাফলং।

• ফেরার পথে নিউ হাফলং থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ধরতে পারেন।

Travel and Tourism Haflong Assam
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy