রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে
শিল্পীর এই নিজেকে পালটে নেওয়ার ইতিহাস ধরা আছে যামিনী রায়ের নিজস্ব কথনেও। স্টারে থিয়েটার দেখতে যাওয়ার পথে এক দিন বন্ধুর বাড়িতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের একটা বই পেয়ে হাতে নিয়ে উলটে-পালটে দেখতে গিয়ে কী যে ঘটে গেল! চৈতন্যদেবের সুভক্ত পার্শ্বচর স্বরূপ দামোদরের কথা লেখা সেখানে। পুব বাংলা থেকে এক মহাপণ্ডিত চৈতন্যদেবকে উৎসর্গ করে একখানি বই লিখে এনেছেন, স্বয়ং মহাপ্রভুকে শোনাতে চান। কিন্তু আগে সেন্সর-রূপী স্বরূপ দামোদরকে পেরোতে হবে। দামোদর-সহ সব পণ্ডিতের সভা বসল, তাঁদের সবার ভাল লাগলে মহাপ্রভুর কাছে যাওয়ার ভিসা মিলবে। গ্রন্থলেখক পণ্ডিত শুরুর শ্লোকটি পড়লেন, তাতে বলা হচ্ছে, চৈতন্যদেব ‘দারুব্রহ্মতুল্য’। সভা ‘সাধু সাধু’ করে উঠল। স্বরূপ দামোদর নির্বিকার, একটি শব্দ শুধু বললেন, ‘কাকবিষ্ঠাতুল্য’। সবাই হতভম্ব। স্বরূপ দামোদর বললেন, এই যে জীবিত কোনও ব্যক্তিকে দারুব্রহ্মতুল্য বলা, এ ব্যাপারটা আসলে কাকবিষ্ঠাতুল্য। গল্প পড়ে যামিনী রায় ভাবলেন, এই যে আমরা ইউরোপীয় গতে ছবি আঁকি, ওতে যত গুণই থাক, আদতে সেও যেন ওই রকম, ওই কাকবিষ্ঠাতুল্য! রাফায়েলের ছবির কথা মনে এল। জিশু-কোলে মেরি দাঁড়িয়ে আকাশে, অথচ ছবিতে তাঁর শেড, লাইট, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিক মানুষের মতো— এ কী করে হয়? মনে হল, এই ছবি আর যা-ই হোক, ছবি হচ্ছে না। কোন পথে যেতে হবে, ঠিক হয়ে গেল মুহূর্তে।
শিল্পের সাধনে তিনি ছিলেন অনন্ত উৎসাহী এক ছাত্র। যখন খুব নাম হয়েছে, তখনও বলতেন, কাকে কী শেখাবেন! নিজেই এখনও শেখার জন্য অস্থির হয়ে আছেন। রাতে নিজের ঘরে বসে ভুসো দিয়ে স্কেচ করছেন, পাশে ওঁর ছোট্ট ছেলে অমিয় (ডাকনাম পটল)। চার বছর মাত্র বয়স তখন, সেও আঁকছে। ছোট্ট ছেলের আঁকা ছবি দেখে শিল্পীর মনে হল, তিনি যা চাইছেন তা ওই শিশুর আঁকাতেই আছে। তক্ষুনি নিজের ছবি পালটে সেই রকম আঁকতে শুরু করলেন! আবার প্রেরণা পান রবীন্দ্রনাথেও, দাগ দিয়ে পড়েন ‘তপোবন’ প্রবন্ধ: ‘মানুষের মধ্যে বৈচিত্র্যের সীমা নেই। সে তাল গাছের মতো একটি মাত্র ঋজু রেখায় আকাশের দিকে ওঠে না, সে বট গাছের মতো অসংখ্য ডালেপালায় আপনাকে চারিদিকে বিস্তীর্ণ করে দেয়।...’ বইয়ের মার্জিনে নোট লেখেন যামিনী রায়, ‘আমার মনের কথা আজ লিখায় পড়লাম...’
বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি’ নামে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন যামিনী রায়। রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে বিস্তর সমালোচনার আবহে প্রকাশিত সেই প্রবন্ধ পড়ে আনন্দিত কবি চিঠি লিখেছিলেন শিল্পীকে, ‘তোমাদের মতো গুণীর সাক্ষ্য আমার পক্ষে পরম আশ্বাসের বিষয়।’ কলকাতার এগজিবিশনে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছেন, জিভে প্যারালিসিস, কথা বলতে পারেন না। যামিনী রায় দেখলেন, তাঁর আঁকা ছবি দেখে গগনেন্দ্রনাথের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সরোজিনী নাইডু যামিনী রায়কে বলেছিলেন শিল্পবোদ্ধা হাসান শাহিদ সুরাবর্দির কথা। তাঁর বাড়িতে শোওয়ার ঘরে যামিনী রায়ের আঁকা গোপিনীর ছবি ছিল, দাঙ্গার সময় উন্মত্ত জনতা সব ভেঙে চুরমার করে দিয়ে গেল, যামিনী রায়ের ছবিতে হাত দেয়নি!
পদ্মভূষণ, ললিত কলা অকাদেমি সম্মান, গুগল ডুডলে কি মাপা যায় তাঁকে? বহুমুখী প্রতিভার নিরিখে পিকাসোর সঙ্গে তাঁর তুলনা করেছিলেন বিষ্ণু দে। সব ছাপিয়ে মনে পড়ে ভ্যান গঘ-এর সেই উক্তি, শিল্পীর জীবনযাত্রা মঠের ব্রহ্মচারী, গুহাবাসী তপস্বীর মতো, তাঁর মন্ত্র শুধু কাজ— সব সুখ-আরাম ত্যাগ। সেই বোধেরই পুনরুচ্চারণ করেছিলেন যামিনী রায়: শিল্পধর্ম পালন করতে গিয়ে যদি অনন্ত নরকেও যেতে হয়, তিনি প্রস্তুত।